বাম আমলের আর্থিক অনিয়ম খুঁজে বের করার কাজ শুরু করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশে রাজ্যের বিভিন্ন দফতর ও স্বশাসিত নিগমগুলির খরচখরচা অভ্যন্তরীণ ভাবে অডিট করার কাজ শুরু করে দিয়েছে অর্থ দফতর। আর তার জেরেই নানা আর্থিক অনিয়ম প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে বলে অর্থ দফতরের কর্তাদের দাবি।
মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী নিজেও অভিযোগ করেছেন, বামেরা ‘দুর্নীতির আঁতুড়ঘর’ তৈরি করে গিয়েছে। তাঁর কথায়, “বাম আমলে টেন্ডার না-ডেকে কাজ দিয়ে কোটি কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে। এ সব নিয়ে কয়েকটা অডিট করানো হয়েছে। প্রতিটিতে চূড়ান্ত দুর্নীতি ধরা পড়েছে। প্রমাণ ছাড়া প্রকাশ্যে বলব না। অর্থমন্ত্রীকে বলেছি, এ সব একটু একটু করে প্রকাশ্যে আনতে।” আর এই অভিযোগ সম্পর্কে সরাসরি কোনও মন্তব্য না করে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী কী করেন, সেটাই আগে দেখতে চান তাঁরা।
কী ধরনের দুর্নীতি ধরা পড়েছে?
উদাহরণ হিসেবে অর্থ দফতরের সূত্র জানাচ্ছে, বাম আমলে আয় বাড়ানোর কৌশল হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম ৪৫০ কোটি টাকা বিভিন্ন মিউচ্যুয়াল ফান্ডে লগ্নি করেছিল। বিশেষ অডিট করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, ওই টাকার ৮০ শতাংশই এমন এক জন মিউচ্যুয়াল ফান্ড এজেন্টের মাধ্যমে লগ্নি করা হয়েছিল, যিনি ছিলেন নিগমেরই এক পদস্থ কর্তার ছেলে। অভিযোগ, বাম-ঘনিষ্ঠ ওই কর্তার ছেলেকে লগ্নির দায়িত্ব দিয়ে, কয়েক কোটি টাকা কমিশন পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। অথচ খোঁজ করা হয়নি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের ব্যাপারে অভিজ্ঞ, পেশাদার কোনও সংস্থার।
আরও উদাহরণ দিয়েছেন অর্থ দফতরের এক কর্তা। তিনি বলেন, সুন্দরবনের দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের সাইকেল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদ। সেই মতো সরকারি টাকায় প্রায় ২০ হাজার সাইকেলও বিলি করা হয়। কিন্তু সরকারি নিয়ম মেনে ওই সাইকেল কেনার ক্ষেত্রে পর্ষদ দরপত্র ডাকেনি। একতরফা ভাবে একটি সংস্থার কাছ থেকে সাইকেল কিনে নেওয়া হয়। |
মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: অশোক মজুমদার |
অর্থ দফতরের ওই কর্তা আরও জানান, বন দফতরে অভ্যন্তরীণ অডিট করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, ২০০৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০১১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে তারা বাড়তি ১২১ কোটি টাকা খরচ করেছে। বাজেটের বাইরে একটি দফতরেরই এত টাকা খরচের বহর অর্থ দফতরের কোষাগার থেকেই জোগান দিতে হয়েছে।
ক্ষমতায় এসেই সরকারি কাজে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মমতা। আর সেই সূত্র ধরেই রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের অধীনে থাকা নিগম, পর্ষদ ও পরিচালন সমিতিগুলির ‘ঘুঘুর বাসা’ ভাঙতে অভ্যন্তরীণ বিশেষ রিপোর্ট তৈরি করে ফেলতে চাইছেন তিনি। রাজ্যের বিভিন্ন দফতর বা স্বশাসিত নিগমগুলির বিরুদ্ধে অনেক সময়ই কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (ক্যাগ) রিপোর্টে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সরকারি ভাবে ওই সব অভিযোগের বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না। নতুন মুখ্যমন্ত্রী চিরাচরিত সেই প্রথা ভেঙে ফেলে, নতুন করে অভ্যন্তরীণ অডিট রিপোর্ট তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন।
আর তাতেই দুর্নীতির নানা তথ্য হাতে আসতে শুরু করেছে বলে অর্থ দফতরের দাবি। অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিগমগুলির কাজে আর্থিক নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। উল্টে বেহিসেবি খরচ
করার পাশাপাশি চলেছে বছরের পর বছর স্বজনপোষণ-ক্ষমতার অপব্যবহার করে কর্মী নিয়োগ। অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, “অধিকাংশ নিগম ও পর্ষদই নিজেদের মতো করে নিয়ম তৈরি করে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি কাজে কোনও টেন্ডার তো ডাকা হয়ই না আবার অর্থ দফতরের বিধি-নিষেধও মানতে চায় না। নতুন সরকার সেই নিয়মেরই বদল আনতে চাইছে।”
পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন বিত্ত নিগম, সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদ, পশ্চিমবঙ্গ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যানচর্চা উন্নয়ন নিগম, বন দফতর-সহ মোট ২০টি সরকারি বিভাগে প্রথম পর্যায়ে বিশেষ অডিট করা হবে বলে ঠিক হয়। যার মধ্যে ৭টি বিভাগের অডিট রিপোর্ট তৈরি হয়ে গিয়েছে। কয়েকটি নিগম ও পর্ষদ সম্পর্কে অর্থ দফতরের তৈরি করা ওই রিপোর্ট মমতার দফতরে জমাও পড়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর দফতর সূত্রে খবর, মমতা সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য মুখ্যসচিব সমর ঘোষকে শীর্ষে রেখে একটি কমিটি গঠন করেছেন। মুখ্যসচিব এখন সিদ্ধান্ত নেবেন, রাজ্য ভিজিল্যান্স না সিআইডি কাকে দিয়ে নিগমের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলির তদন্ত করাবেন।
বাকি ১৩টি বিভাগে গিয়ে অর্থ দফতরের আধিকারিকরা এখন হিসেব করেছেন। মমতা অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে নির্দেশ দিয়েছেন, যত দ্রুত সম্ভব অডিট শেষ করে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দিতে হবে। অর্থ দফতরও কোমর বেঁধে নেমেছে। দফতর সূত্রে খবর, অথর্মন্ত্রী দফতরের অডিট বিভাগের আধিকারিকদের ডেকে এক-একটি বিভাগের অডিট করার জন্য তাঁদের উপর সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছেন। আর তাতে ম্যাজিকের মতো কাজ হচ্ছে বলে দফতরের দাবি। মাত্র ৫০ দিনের মধ্যে বেশ কয়েকটি রিপোর্ট তৈরি করেছেন দফতরের কর্মীরা। সেগুলি খতিয়ে দেখে পাঠানো হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে। চলতি আর্থিক বছরেই কমপক্ষে ১৫টি রিপোর্ট অর্থ দফতরের কর্তারা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জমা দেবেন বলে ঠিক করেছেন।
বাম আমলে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে সূর্যকান্ত মিশ্রর মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী কী পদক্ষেপ করেন দেখা যাক। তবে এনডিএ ও ইউপিএ আমলে উনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। ওই সময় কেন, গত ৩৪ বছরে সিবিআই বা অন্য কোনও ‘এজেন্সি’-র মাধ্যমে বামফ্রন্টের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে মামলা করা হয়নি।” |