খাদ্যের অধিকার সমর্থন করতেই হবে। কিন্তু রেশনে আরও খাবার দিলে গরিব শিশুর
স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে, এমন ভাবলে ভুল হবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা বিলটি
সম্পর্কে আলোচনা করেছেন ‘পুয়োর ইকনমিক্স’ গ্রন্থের অন্যতম লেখক
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় |
ভারতে অপুষ্টি কমাতে তৈরি হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা বিল। কিন্তু এই প্রস্তাবিত আইন সেই উদ্দেশ্য সাধন করতে পারবে বলে মনে হয় না।
এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে ভারতে অপুষ্টির চিত্র ভয়ঙ্কর। কোনও শিশু ঠিক মতো খাচ্ছে কি না, তা বোঝার উপায় হল তার বয়সের শিশুদের যা আন্তর্জাতিক গড় উচ্চতা, তার সঙ্গে তার উচ্চতার তুলনা করা। বিদেশে ভারতীয় বংশোদ্ভূত যে ব্যক্তিরা বাস করেন, দুই প্রজন্মের মধ্যে দেখা যায় যে তাঁদের শিশুদের উচ্চতা সেই দেশের শিশুদের গড় উচ্চতার সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছে। সুতরাং এটাকে একটা নির্ভরযোগ্য পরিমাপ বলে ধরা চলে। সেই পরিমাপ অনুসারে, ভারতে পাঁচ বছরের নীচে অর্ধেকেরও বেশি শিশুর উচ্চতা কম। এবং তা এতটাই কম যে তাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ দেখা দিচ্ছে। চার জনে এক জন অত্যন্ত বেঁটে (stunted), যা অত্যন্ত অপুষ্টি বোঝায়। ওজনের পরিমাপ নিলেও ছবিটা একই রকম পাঁচ বছরের নীচে প্রায় অর্ধেক ছেলেমেয়ের ওজন কম, সিকিভাগের ওজন অত্যন্ত কম (wasted)। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সর্বত্র অবস্থা প্রায় এক, কেবল শ্রীলঙ্কা হয়তো খানিকটা ভাল।
আরও অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, বিশ্বের যেটি দরিদ্রতম অঞ্চল, অর্থাৎ আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির নীচের দেশগুলি, সেখানেও অপুষ্টির প্রকোপ ভারতের অর্ধেক। তা-ও মনে রাখতে হবে, ভারতে অপুষ্টির যে হার বলা হচ্ছিল সেটা দরিদ্রতম পরিবারগুলির নয়, বিত্তের নিরিখে যাঁরা মাঝামাঝি, তাঁদের পরিবারের শিশুদের ছবি। ভারতের সবচেয়ে দরিদ্রদের মধ্যে অত্যন্ত কম উচ্চতার (stunted) শিশু প্রায় ৭০ শতাংশ। এই শিশুরা বড় হয়ে কর্মজগতে প্রবেশ করবে কেবল দুর্বল শরীর নিয়ে নয়, ক্ষীণ মেধা নিয়ে। শৈশবে অপুষ্টি যে মস্তিষ্কের বিকাশকে ব্যাহত করে, তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। |
শুধু ভাত দিয়ে নয়। পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামে। ছবি: সুদীপ আচার্য |
অপুষ্টি রুখতে খুব দ্রুত কিছু যে করতে হবে, তাতে সন্দেহ নেই। ‘খাদ্যের অধিকার’ নিয়ে যে কথাবার্তা চলছে, সেটা সেই তাগিদ থেকেই হচ্ছে, তা-ও বোঝা যায়। নৈতিকতার দৃষ্টিতে এই ‘অধিকার’ আমিও স্বীকার করি। কিন্তু যে ভাবে এই অধিকার নিয়ে চর্চা হচ্ছে, তা আসল সমস্যাটা এড়িয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার দরিদ্র বাবা-মা যদি তাঁদের সন্তানদের ঠিক মতো খাওয়াতে পারেন, ভারতের মাঝারি-বিত্ত, যাঁরা নিঃসন্দেহে অনেক বেশি ধনী, তাঁরাই বা পারবেন না কেন? শেষ বিচারে তা হলে পুষ্টি প্রধানত টাকাপয়সা থাকার বিষয় নয় (যদিও বহু লোকের কাছেই টাকার অভাব ঠিক মতো খেতে না-পাওয়ার একটা বড় কারণ) অপুষ্টির কারণ অশুদ্ধ পানীয় জল, পয়ঃপ্রণালীর খারাপ দশা, এবং আনুষঙ্গিক নানা অসুখ, যা শিশুদের শরীর থেকে পুষ্টিকর জিনিসগুলিকে বার করে দেয়। সব চেয়ে বড় কথা, বাবা-মায়েরা শিশুদের জন্য যে সব খাবার নির্বাচন করেন, সেগুলোতে প্রায়ই যথেষ্ট ক্যালরি থাকে না, এবং প্রায় কখনওই যথেষ্ট প্রোটিন বা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট (আয়োডিন, লোহা, প্রভৃতি) থাকে না।
খাদ্যের অধিকার আন্দোলন অপুষ্টির সমস্যার সমাধান করতে আরও বেশি মানুষের কাছে আরও সস্তায় খাদ্যশস্য পৌঁছে দিতে চাইছে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে। বিশেষ করে ডাল সস্তায় পাওয়া যেতে পারে, এমন একটা কথা হয়েছিল। তাতে কাজ হত, যদি মানুষ সত্যিই ভর্তুকি-দেওয়া খাবার খেত। কিন্তু লোকে যদি পুষ্টিকর খাবারকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে রাজি না থাকে, তা হলে বেশি বেশি চাল-গম খাবে কেন? যখন সবাই রেশন তুলতে পারত, তখন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি তাদের চাল গরিবদের বিক্রি করে দিত। এখন যদি রেশনে ডাল পাওয়া যায়, গরিব পরিবারগুলি তাদের ডাল বিক্রি করে দেবে মধ্যবিত্তকে। অবশ্য যদি চাল-ডাল তাদের কাছে পৌঁছয় এমনিতেই তো রেশন ব্যবস্থায় যত চাল-গম ঢোকে তার অর্ধেক পথেই ‘হারিয়ে যায়’ সেই একই ব্যবস্থার হেফাজতে আরও বেশি খাবার দিয়ে কোনও লাভ হবে না বলেই আমার মনে হয়।
কিন্তু পুষ্টির অনেক উপায়ই আদৌ খরচসাপেক্ষ নয়। ভারতে গর্ভবতী মায়েরা কেন আয়োডিন-যুক্ত নুন ব্যবহার করেন না? সেটা তো প্রতিটি গ্রামেই পাওয়া যায়। এমন হতে পারে যে তাঁরা নিজেদের জন্য, বা সন্তানের জন্য, এই নুন খাওয়ার উপকারিতা জানেন না। আয়োডিন, লোহার মতো ‘মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট’ খাওয়ার প্রয়োজন সম্পর্কে বিজ্ঞানীরাও খুব সম্প্রতি বুঝেছেন। যদিও এগুলোর দাম বেশি নয়, অথচ নিয়মিত খাওয়ার ফলে কর্মক্ষমতার উন্নতি হয় এবং রোজগার অনেকটাই বাড়ে বলে প্রমাণিত হয়েছে, তবু ঠিক কী খেতে হবে তা অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। নিজের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেও তা বোঝা সম্ভব নয়, কারণ আয়োডিন খেলে ছেলেমেয়েরা যদি বেশি বুদ্ধিমান হয়েও ওঠে, সেই বৃদ্ধিটা চোখে-পড়ার মতো হয় না। আর বেশ কয়েক বছর না গেলে বোঝাও যাবে না শিশুর মেধার কী উন্নতি হল, কতটা হল। খাবারে লোহা থাকলে শক্তি বাড়ে ঠিকই, তা বলে রাতারাতি কেউ সুপারহিরো হয়ে যায় না। যদি স্বাস্থ্য ভাল হওয়ার জন্য রোজগার বাড়ে, সেটাও সব সময়ে স্পষ্ট হয় না, কারণ অনেকেরই কোনও সপ্তাহে কিছু বেশি রোজগার হয়, কোনও সপ্তাহে কিছু কম। কী খেলে, কতটা খেলে লাভ হচ্ছে, তা বোঝা তাই সহজ নয়।
কী খাওয়া হবে কী নয়, সে বিষয়ে মানুষের পছন্দ-অপছন্দও কাজ করে। লোকে যা খেতে অভ্যস্ত, তা-ই পছন্দ করে। বাইরের কেউ খাওয়া বদলাতে বললে তাকে সন্দেহের চোখে দেখে। ১৯৬৬-৬৭ সালে চালের দাম খুব বেড়ে যায়, তখন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ভাত কম খেয়ে সবজি বেশি খেতে, যা পকেটের পক্ষেও ভাল হবে আর স্বাস্থ্যের পক্ষেও। তাঁর এই কথায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, তিনি যেখানেই যেতেন সবজির মালা দিয়ে লোকে তাঁকে অভ্যর্থনা করত। অথচ কথাটা তিনি বোধহয় ভুল বলেননি।
গরিব মানুষ যে পুষ্টির কথা মাথায় রেখে খাওয়াদাওয়া করেন না, আর পাঁচ জনের মতো স্বাদের কথা ভেবেই তা স্থির করেন, সেটা খুব আশ্চর্য কিছু নয়। ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন যে, যিনি কোটিপতি তিনি কমলালেবুর রস আর স্বাস্থ্যকর বিস্কুট দিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে পারেন, কিন্তু যারা গরিব, বেকার, তারা অমন বিস্বাদ, পুষ্টি-সমৃদ্ধ খাবার খেতে চাইবে না। তাদের লোভ দেখানোর মতো সস্তা, মুখরোচক খাবার কিছু না কিছু জুটেই যায়। মরক্কোর মতো গরিব দেশের গ্রামে গিয়ে আমরা দেখেছি, সেখানে জীবন নিতান্ত একঘেয়ে। সিনেমা-থিয়েটার নেই, নাচ-গান দেখার প্রেক্ষাগৃহ নেই, নতুন নতুন মানুষের আসা-যাওয়া দেখে সময় কাটানোর উপায়ও নেই। সেখানে পুষ্টিকর খাবারের চাইতে একটা টেলিভিশন, একটা ডি ভি ডি কেনা অনেক জরুরি মনে হয়। মরক্কোর এক গ্রামবাসী আমাদের বলেছিলেন, ‘খাবারের চেয়ে টেলিভিশন অনেক জরুরি।’ যে সব গ্রামে টেলিভিশন নেই, যেমন রাজস্থানের উদয়পুরে, সেখানে দেখা যায় দরিদ্রতম পরিবারগুলি পুজো বা উৎসবের দিনগুলোর জন্য তাদের আয়ের ১৪ শতাংশ খরচ করে। ভারত বা মেক্সিকোর মতো দেশগুলোতে, যেখানে দেশের ভিতরের অর্থনীতি যথেষ্ট বড় হওয়ার কারণে সস্তায় নানা ধরনের সামগ্রী পাওয়া যায় (যেমন শ্যাম্পুর ছোট ছোট প্যাকেট, সস্তা চিরুনি, লজেন্স, পেন, খেলনা, মোবাইল টক টাইম) সেখানে খাবারের জন্য পরিবারগুলি খরচ করে কম। পাপুয়া নিউ গিনির মতো দেশে সস্তায় কেনার মতো টুকিটাকি জিনিস নেই, তাই গরিব পরিবারগুলি রোজগারের ৭০ শতাংশ খরচ করে খাবারের জন্য। ভারতে গরিবরা খাবারের জন্য খরচ করে পারিবারিক আয়ের ৫০ শতাংশ।
তাই ভারতের গরিব পরিবারকে সস্তায় বা বিনামূল্যে চাল-গম দিলে তারা আরও বেশি খাবে, এমন না-ও হতে পারে। তারা হয়তো বাজার থেকে আগে যতটা চাল কিনত, তার চেয়ে কম কিনবে। এমনকী এমনও হতে পারে যে তারা আগের চেয়ে কম চাল খাবে। পুষ্টিবিধান সম্পর্কে আমরা এখনও অবধি যা যা জেনেছি, তা থেকে এমন কোনও ইঙ্গিত মেলে না যে মানুষের উপর বেশি বেশি চাল-গম চাপালে পুষ্টি বাড়বে।
সস্তায় চাল-গম দেওয়াকে অবশ্য ধন-বণ্টনে সাম্য আনার চেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে। তখন প্রশ্নটা একটু জটিল হয়ে যায়। বাজার থেকে যা ১২ টাকা বা ১৫ টাকা কিলোগ্রাম দরে কিনতে হয়, সেটা দু’টাকা বা তিন টাকায় দিলে গরিব পরিবারের মোট রোজগার বাড়ানো হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু রোজগার বাড়ানোর কাজটা তো নানা ভাবেই করা যেত সরাসরি টাকা অনুদান দিয়ে, কিংবা পেনশন দিয়ে বা বাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়ে। এমন অনেক উপায় আছে, তার মধ্যে কোনটা সবচেয়ে কার্যকর হবে, সেটা ভাবা দরকার।
অনেকে বলেন, রেশনে চাল দেওয়ার বদলে যদি টাকা দেওয়া হয়, পুরুষরা সেটা মদ খেয়ে উড়িয়ে দেবে। খাবার দিলে তা হবে না। কথাটা কিন্তু আসলে ঠিক নয়। এটা ঠিকই যে সরাসরি টাকা দেওয়ার প্রথা শুরু হলে নানা ধরনের জুয়াচুরি হতে থাকবে, যা এখনও আমরা ভেবে উঠিনি। কিন্তু সরাসরি খাবার দিলেই তার পুরোটা ক্ষুধার্ত মানুষের খিদে মেটাবে, আর টাকা দিলে তার সবটাই মদ খাওয়ায় নষ্ট হবে, এমন ধরে নেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়। বরং রেশন ব্যবস্থার উপর কোনও রকম নিয়ন্ত্রণ রাখা যে অত্যন্ত কঠিন, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এক জায়গা থেকে খাবার কিনে আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া, ঠিক জায়গায় খাবারটা যে পৌঁছল তা নিশ্চিত করা, এই পুরোটার জন্য যে ব্যবস্থাপনা লাগে তা অতিকায়, অতি জটিল। সরাসরি গরিবকে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা তুলনায় অনেক সহজ হবে বলে মনে হয়। এ দেশে বহু সরকারি প্রকল্প যে কাজ করে না, তার কারণ তার পরিকল্পনা ভাল নয়। কেমন করে, কীসের জন্য খরচ করলে টাকা গরিব মানুষের কাজে আসে, তা নিয়ে আরও যত্ন করে চিন্তা করতে হবে।
|
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’তে (এম আই টি) অর্থনীতির শিক্ষক |