বিতর্ক...
এ দেশে ওয়ালমার্ট এলে চাষিরই লাভ
পক্ষে
পাব উন্নত প্রযুক্তি, ভাল বিপণন

সবুজ বিপ্লবের পরেও পশ্চিমবঙ্গ বা এর মতো আরও কিছু রাজ্য কৃষিতে বেশ পিছিয়ে, তার অন্যতম বড় কারণ সেচ ব্যবস্থার অনুন্নতি। মাটির উর্বরতা নির্ণয়, উন্নত প্রযুক্তি, কৃষিজাত দ্রব্যের বিপণনের পরিকাঠামো প্রভৃতির উন্নতি হয়নি। ফলে শুধু সার-বীজ প্রভৃতিতে ভর্তুকি দিলেও চাষের খরচ ক্রমবর্ধমান।
প্রভৃতি দেশি-বিদেশি বিপণন সংস্থাগুলি কৃষি বিপণনে নিয়োজিত হলে এই সমস্যাগুলির অনেকটাই সমাধান সম্ভব। যেমন, চাষিরা সংস্থাগুলি থেকে উচ্চ ফলনশীল বীজ, ভাল সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক পাবে। সঙ্গে জানতে পারবে তার প্রয়োগবিধি। তা ছাড়া, কৃষিবিজ্ঞানীদের সাহায্যে জমির উর্বরতাশক্তি নির্ণয় ও চাষের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ পাবে চাষিরা। এতে শুধু ফলনই বাড়বে তাই নয়, ওয়ালমার্ট সংস্থাগুলি ফসল তথা সবজি ভাল দামে কিনবে। তাই খোলা বাজার অপেক্ষা চাষিরা বেশি দাম পাবে। এখন ফড়েরা কৃষিজাত দ্রব্যের কম দাম নির্ধারণ করে। তাই ফলন বেশি হলে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ে। তা ছাড়াও চাষের সবজি বাজারে নিয়ে যেতে পরিবহণ খরচ, হাটে চাঁদা-তোলাবাজদের জুলুম, অবিক্রিত সবজি ফেলে আসার জরিমানা ইত্যাদি কারণে চাষি যে টাকা বিনিয়োগ করে, তার সামান্য অংশই আয় করে বা কখনও ক্ষতির মুখ দেখতে হয়। ফলে ঋণ বাড়তে থাকে। ওয়ালমার্ট এলে কোম্পানিই সবজি ঝাড়াই-বাছাই করে জমি থেকে নিজেদের খরচেই নিয়ে যাবে। ফলে পরিবহণ খরচ বা তোলাবাজদের শোষণের হাত থেকেও চাষিরা বাঁচবে। সর্বোপরি প্রযুক্তিগত সহায়তা পাওয়ায় চাষিরা অসময়ের সবজি চাষ করে সারা বছর আয় করতে পারবে। এ দেশের চাষিরা দীর্ঘ দিন ফড়ে বা দালালের কাছে পাচ্ছে অতি স্বল্প লাভ, কখনও বা লোকসান। কিন্তু উত্তর ২৪ পরগনার পূর্ব খিলকাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের চাষিদের জীবনে আমূল পরিবর্তন এসেছে ‘মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি’ সরাসরি তাদের কাছে আসার পর থেকে। সেখানে চাষিদের মিলিত বক্তব্য, গত বছরের তুলনায় এ বছরে আমাদের লাভের পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি। ওয়ালমার্টের মতো কোম্পানিগুলির থেকে চাষিরা বিনামূল্যেই উন্নত গুণমানের প্রযুক্তি এবং কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ লাভ করতে পারবেন, চাষিদের লাভের অঙ্কও বর্ধিত হবে।
আটের দশকের প্রথমভাগে যাঁরা ‘কম্পিউটার এ দেশে এলে শ’য়ে শ’য়ে বেকার সৃষ্টি হবে’ রব তুলে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, ওই দশকের শেষ প্রান্তে এসে তাঁরাই আবার তাকে সাদরে বরণ করে নিলেন। পরিবর্তনের স্রোতে গা ভাসাতে না পারলে বিপদের সম্ভাবনা থেকেই যায়। স্বাধীনতার চৌষট্টি বছর পার হতে চলল অথচ আজও বিদর্ভের তুলাচাষি, নাসিকের পেঁয়াজচাষি কিংবা এ রাজ্যের ধান-আলু-বেগুন জাতীয় শস্যের ক্ষেত্রে চাষি তার ন্যায্য মূল্য না পেয়ে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে। বাজারে যখন হিমঘরের মজুত আলু কুড়ি-বাইশ টাকা কিলো দলে বিক্রি হচ্ছিল, চাষি পেয়েছিল কিলো প্রতি তিন থেকে চার টাকা। এখন যেমন বাঁধাকপি দশ টাকা কিলো দরে বিক্রি হচ্ছে, অথচ দেশি ফড়ে বা দালালেরা চাষির থেকে কিনছে হাজারটি কপি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। লভ্যাংশ দূরে থাক, ঋণ পরিশোধটুকুই কি চাষির পক্ষে সম্ভব? ওয়ালমার্ট এলে দেশি দাললরা মার খাবে ঠিকই, কিন্তু চাষি বাঁচবে, তার লাভ হবে।

বিপক্ষে
মহাজন থেকে মহারাক্ষসের গ্রাসে
বিদেশি পুঁজি এলে যে কর্মরীতি নিয়ে ওয়ালমার্টের মতো সংস্থাগুলি চলতে পারে, তা এ রকম
১) মাঠ থেকে কৃষিপণ্য বাজারজাত করার বর্তমান যে ব্যবস্থা আছে, তাকে ওরা প্রথমে ধ্বংস করে দেবে। অনেক ফড়ে ওদের স্থানীয় এজেন্টে পরিণত হবে। প্রথম দিকে ওরা কৃষিপণ্যের বর্তমান দামের তুলনায় একটু বেশি দামের ব্যবস্থা করবে, তার পর বিপণনের বিষয়টি করায়ত্ত করার পর স্বমূর্তি ধারণ করবে।
২) এই পর্যায়ে চাষিদের ওপর শর্ত আরোপ করতে শুরু করবে ওরা। ওদের বীজে, ওদের দেওয়া সার ও কীটনাশকে ওদের প্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদন করতে হবে চাষিকে। দামও বেঁধে দেবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি। জমি চাষির কিন্তু আর সবই বহুজাতিক কোম্পানির। এক ধরনের চুক্তিচাষ প্রথা চালু হবে এ দেশে, যার এক দিকে বহুজাতিক কোম্পানি, অন্য দিকে মধ্য-নিম্ন-প্রান্তিক চাষি। ফল সহজেই অনুমেয়।
৩) প্রয়োজনে বহুজাতিক সংস্থাগুলি বিদেশ থেকে কৃষিপণ্য আনবে। ফলে এ দেশের চাষিকে ঠেলে দেওয়া হবে এক ভয়ঙ্কর অসম প্রতিযোগিতার দিকে।
৪) বহুজাতিক সংস্থা আন্তর্জাতিক বাজারে ভাল দাম পেলেও এ দেশের চাষির কোনও লাভ নেই।
৫) তিন-চার ফসলি উর্বর কৃষিজমির মালিকদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেবে এই সব বহুজাতিক সংস্থা। প্রথম দিকে এদের উদার হস্তে দাদন দিয়ে চুক্তিবদ্ধ করার চেষ্টা হবে। শেষ পর্যন্ত ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলে ইচ্ছামতো শর্তে প্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদন করিয়ে নেওয়া হবে।
৬) যত উচ্চ ফলনশীল বীজ, তত বেশি সার-তেল-জল-কীটনাশক, খরচও তত বেশি। ক্রমবর্ধমান এই চাষের খরচ মেটানো মধ্য-নিম্ন-প্রান্তিক চাষির পক্ষে অসম্ভব। জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনও যে-ভাবে তুলে দেওয়া হচ্ছে, তাতে চাষিদের হাতছাড়া হবে জমি।
৭) ওদের উন্নত প্রযুক্তি খেতমজুরদের আরও কর্মহীন করবে। বর্তমানে এ রাজ্যে এক জন মজুর বছরে গড়ে ১১৪ দিন কাজ পায়, বাকি ২৫১ দিন কর্মহীন। এই কর্মহীন দিনের সংখ্যা আরও বাড়বে।
তাই খুচরো ব্যবসায় বিদেশি পুঁজি এলে চাষির কোনও লাভ নেই, লাভ শুধু দেশি-বিদেশি কর্পোরেট সংস্থার।
বিশ্বের ২৮টি দেশে যাদের শাখা, সেই ওয়ালমার্টের মতো বিশালাকার সংস্থার কাছে মুনাফাই হল শেষ কথা। সাধারণ ক্রেতাদের কাছে সস্তা দরে পণ্য দেওয়ার চটকদারি প্রতিশ্রুতির আড়ালে ছোট ব্যবসায়ীদের উৎখাত করে দেবার ষড়যন্ত্র যাদের, তারা কখনও এ দেশের কৃষকদের বন্ধু হতে পারে না। সস্তায় পণ্য বিক্রি করতে হলে চাষির উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী ও কাঁচামালও সস্তায় ক্রয় করতে হবে এটা জানার জন্য অর্থনীতির জটিল অঙ্কের প্রয়োজনীয়তা নেই। কৃষককুলের প্রতি সহমর্মিতা ও আন্তরিকতার স্পর্শ কৃষকস্বার্থ ঢাকা পড়বে ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির অন্তরালে, সরকারি ভর্তুকির ছিটেফোঁটাও কখনও জুটবে না চাষির কপালে। চাষির কী লাভ হবে? ফড়ে-মহাজনের হাত থেকে বেঁচে ওয়ালমার্টের মতো মহারাক্ষসের গর্ভে ঢুকে চাষি থাকবে সেই তিমিরেই।
এ দেশে ওয়ালমার্ট এলে লাভবান হবেন মূলত শহরবাসীরা অধিকাংশ কৃষকের, বিশেষত প্রান্তিক চাষিদের অবস্থা যে তিমিরে, সে তিমিরেই রয়ে যাবে। প্রথমত, সংস্থাগুলি বড় বড় চাষিদের কাছ থেকেই কৃষিজাত দ্রব্য ক্রয় করতে আগ্রহী হবে। ফলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের এবং চাষের কাজের সঙ্গে যুক্ত একটা বিরাট অংশের শ্রমিকের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির কোনও সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রেও যে কৃষিপণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দালাল রাজের উদ্ভব হবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ভারতের মতো কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে ওয়ালমার্ট-এর মতো বিপণন সংস্থাগুলির লক্ষ্য থাকে ৫০ শতাংশ কৃষিপণ্য নিজেদের খামার থেকে উৎপাদন করার। অতএব, কৃষকদের অধিক মূল্যে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রয়ের আশা সুদূরপরাহত।

ফেব্রুয়ারি মাসের বিতর্ক
আপনার চিঠি পক্ষে না বিপক্ষে, তা স্পষ্ট উল্লেখ করুন।
চিঠি পাঠান ২৫ জানুয়ারির মধ্যে এই ঠিকানায়
ফেব্রুয়ারি মাসের বিতর্ক,
সম্পাদকীয় বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.