জাতপাতের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার কথা বললেও উত্তরপ্রদেশে জাতপাতের সমীকরণ ও তার বদলের উপরেই ভরসা রাখছে কংগ্রেস। এ রাজ্যে তাদের প্রচারের কাণ্ডারী রাহুল গাঁধী। ভোটের প্রচারে উন্নয়ন আর বহুত্ববাদকেই মূল দাওয়াই করার কথা বলছেন তিনি। কিন্তু জোর দিচ্ছেন সামাজিক পুনর্বিন্যাসে। সোজা কথায় রাজ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সমর্থনচিত্রে একটা বড়সড় পরিবর্তন ঘটানোই তাঁর লক্ষ্য। এক সময় মুলায়ম সিংহ যাদব, পরে মায়াবতী লখনউয়ের তখ্ত দখল করেছেন এই পথেই। মুলায়ম তাঁর সমাজবাদী পার্টির শিবিরে এক জোট করেছিলেন মুসলিম ও যাদবদের ভোট। মায়াবতী আবার জাতপাতের চেনা সমীকরণ ভেঙেচুরে এক পঙ্ক্তিতে নিয়ে আসেন দলিত ও ব্রাহ্মণকে।
রাহুলের নেতৃত্বে কংগ্রেস এখন যে পুনর্বিন্যাস চাইছে, তাতে ধর্ম-জাত-বয়স তিনটি দিককেই মাথায় রাখা হচ্ছে। কংগ্রেসের ভোটভাগ্য উজ্জ্বল করতে তাঁদের পাখির চোখ এখন মুসলিম ও কুর্মী সম্প্রদায়ের সমর্থন। একই সঙ্গে, এ বার যাঁরা প্রথম ভোট দেবেন, সেই যুব সম্প্রদায়কেও পাশে টানার যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছে কংগ্রেস। নবীন ভোটারদের পেতে পরিবর্তনের স্লোগানকেই সামনে রাখছে রাহুলের দল। কংগ্রেসের মতে, তাদের এই সামাজিক পুনর্বিন্যাসের ধারণাটা একেবারেই ‘মৌলিক’।
হিন্দি বলয়ে বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশে জাত-নির্ভর রাজনীতিই গুরুত্ব পেয়ে এসেছে বরাবর। মুলায়ম যখন মুসলিম ও যাদব জনভিত্তি-নির্ভর সমীকরণের ভিতে দাঁড়িয়ে সরকারে এসেছিলেন, রাজনীতির অলিন্দে তখন তা মুখোরোচক কোনও তকমা পায়নি। একে তখন মুলায়মের ‘এম-ওয়াই’ (মুসলিম-যাদব) সমীকরণ তথা জাতপাতের সমীকরণ হিসেবেই দেখা হত। ‘সামাজিক পুনর্বিন্যাস’ শব্দটির বহুল প্রচলন ঘটতে শুরু করে গত বিধানসভা ভোটের সময়। সে বারই প্রথম জাতপাতের প্রচলিত সমীকরণ উল্টে দিয়ে ব্রাহ্মণ-দলিতকে এক ছাতায় আনার মতো ‘অসম্ভব কাজকে সম্ভব’ করেন মায়াবতী। সামাজিক পুনর্বিন্যাসের নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করেন মায়াবতী। ‘বহুজন’-এর পরিবর্তে ‘সর্বজন হিতায়’ মন্ত্রে দলিত নেত্রী দখল করে নেন দেশের সব থেকে বড় রাজ্যটি।
পাঁচ বছর পরে কিন্তু মায়াবতীর সেই ব্রাহ্মণ-দলিত সমীকরণ দুর্বল হয়ে পড়ার কিছু লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠেছে। মায়াবতীর ‘চাণক্য’ সতীশ মিশ্র বা ব্রজেশ পাঠকের মতো হাতে গোনা কিছু ব্রাহ্মণ নেতার শ্রীবৃদ্ধি ব্যতিরেকে উচ্চ বর্ণের বিশেষ উন্নতি হয়নি। উচ্চ বর্ণের অনেকেই এখন মায়াবতীর উপর রুষ্ট। প্রশ্ন হল, উচ্চ বর্ণের ভোট এ বার কোন দিকে যাবে? তাঁদের পুরনো ভরসা-স্থল বিজেপি-র দিকে, নাকি কংগ্রেসের দিকে? স্পষ্ট নয় ছবিটা। এমন ক্ষেত্রে কংগ্রেস বা বিজেপি, শেষ মুহূর্তে যাদের বেশি শক্তিশালী বলে মনে হবে, তার দিকেই যেতে পারে উচ্চ বর্ণের ভোট। ফলে তাঁদের মন পেতে আগামী কিছু দিন যে কংগ্রেস-বিজেপি টানাটানি চলবে, তা বেশ স্পষ্ট।
কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের মতে, সমীক্ষায় এই সম্ভাবনার কথা বুঝতে পেরেই নতুন সমীকরণ খুঁজতে শুরু করে কংগ্রেস। গত লোকসভা ভোটে সংখ্যালঘুদের একাংশের ভোট পেয়েছিল কংগ্রেস। তাদের আরও কাছে টানতে তৎপর হন রাহুল। সংখ্যালঘু সংরক্ষণের নীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার। আর সেই সঙ্গে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বিশেষ করে কুর্মী সম্প্রদায়কে কাছে টানতে সচেষ্ট হয় কংগ্রেস। কুর্মীদের মন জয়ে কংগ্রেসের প্রধান সেনাপতি এখন কেন্দ্রীয় ইস্পাত মন্ত্রী বেণীপ্রসাদ বর্মা, উত্তরপ্রদেশে দলের অবিসংবাদিত কুর্মী নেতা। এরই পাশাপাশি সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া শ্রেণি তথা এমবিসি এবং যুব সম্প্রদায়ের ভোটের ওপর বড় রকমের ভরসা রাখছেন রাহুল। উত্তরপ্রদেশে এ বার নতুন ভোটার ১ কোটি ৩৯ লক্ষ। তার মধ্যে ৬৫ লক্ষই ১৮-১৯-এর কোঠায়। কংগ্রেসের সমীক্ষা বলছে, এই নতুন ভোটাররা কমবেশি সকলেই উত্তরপ্রদেশে পরিবর্তন চান। উন্নয়ন চান। বিশ্বাস রাখতে চান বহুত্ববাদে। তাঁদের পাশে পাওয়ার লক্ষ্যে উন্নয়ন আর বহুত্ববাদের স্লোগানকেই সামনে রাখছেন গাঁধী পরিবারের নবীন প্রজন্মের নেতা।
এ নিয়ে দলের এক শীর্ষ নেতার ব্যাখ্যা, “ভুলে গেলে চলবে না রাহুল গাঁধী কিন্তু মুখে জাতের রাজনীতির কথা বলবেন না। তিনি যেমন উন্নয়ন ও বহুত্ববাদের কথা প্রচার করছেন, সেটাই করবেন। কিন্তু জমিতে মূল সমীকরণ থাকবে কুর্মী ও মুসলিমের।” এ রাজ্যে প্রার্থী বাছাইয়ের ভারপ্রাপ্ত নেতা মোহন প্রকাশ জানান, মোট ৪০৩টি আসনের মধ্যে ৩০৫টিতে কমবেশি কুড়ি হাজার করে মুসলিম ভোট রয়েছে। আবার ৯৫টি আসনে কুড়ি হাজারের বেশি কুর্মী ভোট রয়েছে। হিসাব মতো ১০৭টি আসনের প্রতিটিতে মুসলিম ও কুর্মী মিলিয়ে ৫০ হাজার ভোট রয়েছে। এই ১০৭টি কেন্দ্র কংগ্রেসের ২২ জন সাংসদের নির্বাচনী ক্ষেত্রে। ফলে এই ১০৭টি আসনে কংগ্রেস বিশেষ জোর দিচ্ছে। ভোট পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে মূল নজর দেওয়া হচ্ছে মুসলিম-কুর্মী সমীকরণে। |