বৈধ হকারদের উচ্ছেদ করতে চান না মুখ্যমন্ত্রী। তবে, হাসপাতাল বা স্কুল-কলেজের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গার সামনে ফুটপাথ দখল করে নতুন করে হকার বসতে দেবে না তাঁর সরকার। হকার সংগ্রাম কমিটির নাম করে আর এ সব চলবে না বলে মঙ্গলবার সাফ জানিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ দিন সকালে এসএসকেএম হাসপাতালের সামনে থেকে কয়েক জন হকারকে সরানো নিয়ে তুলকালাম বাধে। পুলিশের সঙ্গে বচসার জেরে রাস্তা জুড়ে বসে পড়েন হকারেরা। অবরোধ উঠে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে ওই পথে মহাকরণ যাচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আচমকাই গাড়ি থেকে নেমে পড়েন তিনি। হাঁটতে থাকেন রবীন্দ্র সদনের দিকে। হাঁটতে হাঁটতেই বলেন, “এই রাস্তার উপরে নতুন করে হকার বসছে। বড় বড় স্টোভ, গ্যাস জ্বালিয়ে রান্না করছে। পাশেই হাসপাতাল।” তাঁর অভিযোগ, “সিপিএমের লোকেরা লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে হকারদের বসিয়েছে। ওরা সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করতে চায়। এ সব বরদাস্ত করব না।” কথার ফাঁকেই তিনি হাত দিয়ে দেখাচ্ছিলেন, ফুটপাথে বসা উল ও কাপড়ের স্টলগুলো। মমতা বলেন, “যে কোনও মুহূর্তে আগুন লাগলে সব কিছু জ্বলে ছারখার হয়ে যাবে।” |
হকারদের বিক্ষোভ ও পথ-অবরোধের খবর পেয়ে
এসএসকেএমের সামনে পৌঁছন মুখ্যমন্ত্রী। নিজস্ব চিত্র |
সম্প্রতি কলকাতায় পরপর কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডে উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন, “পাশেই গোখেলে কত বাচ্চা পড়তে আসে। ওদের মায়েরাও আসেন। এক পাশে হাসপাতাল, অন্য ফুটে স্কুল। সুরক্ষার কথা ভেবেই সদ্য গজিয়ে ওঠা ওই হকারদের সরতে বলা হয়। কিন্তু প্রতিবাদ জানিয়ে ওঁরা হরিশ মুখার্জি রোডের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা আটকে দেন। অবরোধ করতে দেব না। আমিও বাঘের বাচ্চার মতো লড়াই করি।”
হকার-প্রশ্নে মমতার এই অবস্থান নিয়ে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, “সব কিছুর একটা পদ্ধতি আছে। তার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে দৌড়তে হবে কেন? বেচারা হকারদের জন্য বাঘ বা বাঘের বাচ্চা, দু’টোই বিপজ্জনক!” তাঁর কথায়, “হকার উচ্ছেদে আজ বাঘের বাচ্চা নেমেছিলেন! এটা আমাদের কথা নয়, মুখ্যমন্ত্রীর নিজেরই ভাষা! এ সব দেখে ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসের সেই রাতের কথা মনে পড়ছিল। হকার উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ওঁরই নেতৃত্বে প্রবল বিক্ষোভ হয়েছিল। পুলিশকে ইট-পাটকেল ছোড়া হয়েছিল। পরবর্তী কালে মেট্রো সম্প্রসারণের জন্য হকার তোলার কথা হলে উনিই বিরোধিতা করেছিলেন। মেয়র হিসেবে সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন।”
১৯৯৬ সালে হকার উচ্ছেদ অভিযান ‘অপারেশন সানশাইন’-এর সেই রাতের প্রসঙ্গে মমতাও মানছেন, “তখন প্রতিবাদ করেছিলাম। চার দিন ধরে পাহারা দিয়েছি।” হকার সমস্যার স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি খুব মানবিক। কিন্তু কেউ যদি অন্যায় করে, তা বরদাস্ত করব না।” তবে হকারদের আশ্বস্ত করে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “সৌন্দর্যায়নের পাশাপাশি ওঁদেরও বৈধ করা যায় কি না, তা-ও দেখা হচ্ছে।”
এ দিন মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছতেই এসএসকেএমের সামনে রাস্তায় ভিড় বাড়তে থাকে। মমতাকে ঘিরে রাখেন পদস্থ পুলিশ অফিসারেরা। দলের হকার সংক্রান্ত পুরনো নীতির কথা স্মরণ করাতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি হকারদের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু হাসপাতাল এবং স্কুলের সামনে নতুন করে হকার বসতে দেওয়ার বিরোধী।”
পরে মহাকরণে পৌঁছে নানা বিষয়ের সঙ্গে এই ঘটনা নিয়েও সাংবাদিকদের কাছে মুখ খোলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “তিন-চার দিন ধরে দেখছি, কিছু জায়গায় নতুন করে হকার বসতে শুরু করেছে। রবীন্দ্র সদন, বিড়লা তারামণ্ডল, নন্দন এবং এসএসকেএম চত্বরটা অন্য রকম। ওখানে কেন হকার বসবে? ওই চত্বরে হকার বসা চলবে না। যেখানে অন্য হকার আছে, ওঁরা সেখানে যান।” তিনি জানান, হকারদের উপরে সমীক্ষা করা হবে। তাতে একটু সময় লাগবে। এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “ফুটপাথে বসার জন্য অনেকে দালালদের টাকা দেন। কাউকে চাঁদার নামে টাকা দেবেন না। ওই টাকা জমিয়ে দশ বছর বাদে নিজের বাচ্চাকে দেবেন। পরিকল্পনা করেই সরকার হকারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে।”
মুখ্যমন্ত্রীর সুরেই বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্তবাবুরও অভিমত, পুনর্বাসন দিয়ে তবেই হকারদের উচ্ছেদ করা উচিত। সেই প্রসঙ্গে এ দিন তিনি বলেন, “হকারদের নিয়ে একটা কেন্দ্রীয় নীতি আছে। জানি না, ওঁরা সেটা দেখেছেন কি না। বাম সরকারের আমলেও একটা নীতি ছিল। হকারদের দরকার পুনর্বাসন। এটা ঠিকই যে, কেউ যেখানে সেখানে বসে পড়বেন বা তাঁদের বসিয়ে দেওয়া হবে, এটা সমর্থন করা যায় না।” বিরোধীদের দাবি, হকারদের জন্য চাই ‘বিজ্ঞানসম্মত পুনর্বাসন’। হকারদের জন্য আধুনিক কিয়স্ক তৈরির চেষ্টা যে বাম আমলে হয়েছিল, সে কথাও উল্লেখ করেন বিরোধী দলনেতা। |