বণিকসভার ‘হুঁশিয়ারির’ পাল্টা ‘রাজধর্ম’ পালনের কথা বললেন রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আমরি-কর্তাদের একাংশ সম্পর্কে বণিকসভা ‘ফিকি’ যতই ‘সহানুভূতিশীল’ হোক বা তাদের না-ছাড়লে বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল ‘বার্তা’ যাবে বলুক, নিজের অবস্থান থেকে নড়ছেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার মহাকরণে হাতজোড় করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “ক্ষমা করবেন। আমি এই চেয়ারে বসেছি মানুষকে বিচার দেব বলে। আইন এ ব্যাপারে নিজের পথেই চলবে। প্রশাসনিক কিছু সীমানা থাকে। আমি আমার এক্তিয়ার লঙ্ঘন করব না।”
মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের বক্তব্যকে অবশ্য ‘ফিকি’ স্বাগতই জানিয়েছে। সংগঠনের মহাসচিব রাজীব কুমারের (ঘটনাচক্রে, যিনি ফিকি-তে রাজ্যের বর্তমান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের উত্তরসূরি) কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শুনেছি। ন্যায়বিচারের যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন, তাকে ফিকি স্বাগত জানাচ্ছে। ফিকি কখনওই কোনও বেআইনি কাজকে সমর্থন করে না। আমরা মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলাম, যাতে এমন একটা ঘটনায় দোষীদের শাস্তির ব্যাপারে কোনও রকম বৈষম্য না-করা হয়। রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতি নিয়ে শিল্প মহলের মনোভাবও তাঁর নজরে আনতে চেয়েছিলাম। ভাবী প্রজন্মের কথা ভেবেই রাজ্যের শিল্প ভবিষ্যৎ আমাদের গড়ে তুলতে হবে।”
আমরিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এবং তার ফলে প্রায় একশো রোগীর মৃত্যুর পর যথেষ্ট ‘কঠোর’ অবস্থান নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আমরির পরিচালন বোর্ডের কর্তাদের অধিকাংশকেই গ্রেফতার করে পুলিশ। এখনও তাঁরা জেল হেফাজতে। তার প্রেক্ষিতেই সোমবার বণিকসভা ‘ফিকি’ জোরালো বিবৃতি দেয়। যাতে বলা হয়, ‘আমরি হাসপাতালের দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন না, তাঁদের এখনই মুক্তি দেওয়া উচিত। তা হলে দেশের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আর কোনও নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে না’।
|
ক্ষমা করবেন। আমি এই চেয়ারে বসেছি মানুষকে বিচার দেব বলে। আমরা শিল্প চাই। কিন্তু মানুষ
মারার শিল্প চাই না। খুন যে করবে, সে খুনি।
তার অন্য কোনও পরিচয় বড় হতে পারে না।
আইন নিজের পথেই চলবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
|
|
ন্যায়বিচারের যে প্রতিশ্রুতি মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন, তাকে স্বাগত। আমরা মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলাম
যাতে এই রকম ঘটনায় দোষীদের শাস্তির ব্যাপারে বৈষম্য
করা না হয়। রাজ্যের শিল্পপরিস্থিতি নিয়ে শিল্পমহলের মনোভাবও তাঁর নজরে আনতে চেয়েছিলাম।
রাজীব কুমার, মহাসচিব, ফিকি |
|
|
স্পষ্টতই ওই বিবৃতি প্রকারান্তরে মমতার প্রতি ‘হুঁশিয়ারি’। সিঙ্গুর থেকে ন্যানো প্রকল্প চলে যাওয়ার পরে বণিকমহলের কাছে যে ‘বার্তা’ গিয়েছিল, তা যথেষ্ট ‘নেতিবাচক’ ছিল এবং পাশাপাশিই তা মমতার একটি ‘শিল্প-বিরোধী’ ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল। রাজনীতির ময়দানে সিঙ্গুরের ‘ফসল’ তুললেও ‘প্রশাসক’ মমতা কিন্তু বারবার তাঁর সেই ভাবমূর্তি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন। রেলমন্ত্রী হওয়ার পরে বারবার বণিকসভার সঙ্গে আলোচনা, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে একাধিক বার বিভিন্ন শিল্পপতির সঙ্গে ‘জনসংযোগ’ মমতা এবং শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত করে এসেছেন। কারণ, তাঁরা জানেন, শিল্প না-এলে কর্মসংস্থানের আশা নেই।
সেই প্রেক্ষিতেই বণিকসভার সোমবারের বিবৃতি ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। বস্তুত, ‘ফিকি’র মহাসচিব রাজীব ওই দিনই বলেছিলেন, “আমরির প্রসঙ্গে বাণিজ্য মহলে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। আমাদের মনে হয়েছে, সরকারের পদক্ষেপ পুরোপুরি নিরপেক্ষ হয়নি।” যা সরাসরি রাজীব বলেননি, তা হল, ওই ঘটনায় পরিচালন বোর্ডে যে চিকিৎসক এবং সরকারের প্রতিনিধিরা ছিলেন, তাঁদের গ্রেফতার করা হয়নি। অথচ, যাঁদের সঙ্গে হাসপাতালের দৈনন্দিন কাজের কোনও সম্পর্ক ছিল না, তাঁদের গ্রেফতার করে নিয়মিত আদালতে জামিনের বিরোধিতা করা হচ্ছে। সেই জন্যই গোটা বিষয়টিতে বণিকমহলে ‘ভুল বার্তা’ যাবে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছিল। যার ফলে রাজ্যে বিনিয়োগ আসারউপরেও প্রশ্নচিহ্ন দেখা দেবে।
রাজ্যে বিনিয়োগের ‘স্বার্থে’ই আমরি-কর্তাদের মুক্তি দেওয়া যে জরুরি, ফিকি-র বিবৃতিতে প্রকারান্তরে সে কথাই বলার চেষ্টা হয়েছিল। বিচারের ক্ষেত্রে ‘বৈষম্য’ থাকলে তা যে বিনিয়োগকারীদের ‘মনোবল’ ভেঙে দিতে পারে, দেওয়া হয়েছিল সেই ইঙ্গিতও। ফিকি-র কর্তারা জানান, আমরি-কাণ্ডের বিচার ‘যথাযথ’ পথে এগোলে ফিকি-র পক্ষেও রাজ্যে ‘ইতিবাচক’ ভূমিকা পালনে সুবিধা হবে।
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সরাসরিই বলেছেন, “আমরা শিল্প চাই। কিন্তু মানুষ-মারার শিল্প চাই না! খুন যে করবে, সে খুনি। তার অন্য কোনও পরিচয় বড় হতে পারে না। সন্ত্রাসবাদী বাঙালি হলে তাকে ছেড়ে দিতে হবে? হিন্দু হলে তাকে ছাড়তে হবে? শিখ হলে তাকে ছাড়তে হবে? মুসলিম হলে তাকে ছাড়তে হবে? সন্ত্রাসবাদী সন্ত্রাসবাদীই! সে যে সম্প্রদায় বা জাতির লোক হোক না কেন।” শিল্পমন্ত্রী পার্থবাবুও বলেন, “এটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। আইন আইনের পথে চলবে।” পরে তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে ১১টি বণিকসভা আছে। তার মধ্যে কয়েকটি জাতীয় স্তরের। আগে সিঙ্গুর নিয়েও অনেকে অনেক বিবৃতি দিয়েছিল। কোনও বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করব না।” শিল্পায়নের ক্ষেত্রে কি এর প্রভাব পড়বে? শিল্পমন্ত্রীর জবাব, “যাঁরা সেটা ভাবছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করুন। গত ৩৪ বছর কী হয়েছে? আমরা সকলকে নিয়ে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করতে চাই।” পার্থবাবুর অভিমত, “একটা বিষয়ের সঙ্গে অন্য বিষয় জুড়ে দেওয়া ঠিক নয়।”
আমরি-কাণ্ডের দিনই মুখ্যমন্ত্রী ‘কড়া’ অবস্থানের পরে পুলিশ আমরি-র ১৪ জন ডিরেক্টরের মধ্যে সাত জনকে গ্রেফতার করে। শ্রবণ তোদি, রবি তোদি, প্রশান্ত গোয়েন্কা, মণীশ গোয়েন্কা, রাধেশ্যাম গোয়েন্কা এবং দয়ানন্দ অগ্রবাল এখনও আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। রাধেশ্যাম অগ্রবাল ভর্তি এসএসকেএম হাসপাতালে। এক দিকে আদালতে প্রতিটি শুনানির দিন ওই ধৃতদের জামিনের বিরোধিতা, অন্য দিকে নতুন করে পরিচালন বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে আর কাউকে গ্রেফতার না-করার ফলে (হাসপাতালের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রোজেক্টস সত্যব্রত উপাধ্যায় এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার সঞ্জীব পালকে অবশ্য গ্রেফতার করেছে পুলিশ) বণিকমহলের একাংশে এই ধারণার জন্ম হয় যে, ‘শাস্তিদানের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা একেবারে বৈষম্যমুক্ত নয়’। কিন্তু এত দিন তা কেউই প্রকাশ্যে বলেনি। সোমবারের বিবৃতির পিঠোপিঠিই রাজীব বলেছিলেন, “বণিকসভাগুলি অবশ্যই মনে করে, দোষীদের শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু সেটা হওয়া উচিত স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। আমাদের মনে হয়েছে, এ ক্ষেত্রে সেটা পুরোপুরি মানা হয়নি।”
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, কিছু দিন আগেই শহরের শিল্পপতিদের একাংশ লালবাজারে গিয়ে কলকাতা পুলিশের পদস্থ অফিসারদের একাংশের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি নিয়ে তাঁদের ‘উদ্বেগের’ কথা জানিয়েছিলেন। মমতার ঘনিষ্ঠমহলেও বিষয়টি পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মমতা তখনই জানিয়ে দেন, তিনি ‘বিচার’ দেওয়ার পক্ষে। কলকাতা পুলিশকেও তিনি ‘নির্ভয়ে’ এবং কোনও মহলের দ্বারা ‘প্রভাবিত’ না-হয়ে তদন্তের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যেও স্পষ্ট যে, বণিকসভার ‘হুঁশিয়ারি’র পরেও তিনি তাঁর অবস্থান থেকে নড়ছেন না। যতই এর ফলে রাজ্যে বিনিয়োগ-সম্ভাবনা ‘ধাক্কা খাবে’ বলে তাঁকে সতর্ক করা হোক না কেন। মমতা-ঘনিষ্ঠ এক নেতা বলেই দিয়েছেন, “সিঙ্গুরের সময়েও বণিকমহলের একংশ বিরোধিতা করে নেত্রীর গায়ে শিল্প-বিরোধী তকমা এঁটে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মানুষকে ভুল বোঝাতে পারেনি। মানুষ আমাদের নেত্রীর পাশেই আছেন। মানুষের রায়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের দায়িত্বভার পেয়েছেন। তাঁর কাছে মানুষকে বিচার দেওয়াটা অগ্রাধিকারের তালিকায় এক নম্বরে। আমাদের বিশ্বাস, শিল্পপতিরাও সেটা বোঝেন। কারণ, তাঁরাও মানুষের ভালোর জন্যই কাজ করেন।”
|
হাইকোর্টে আর্জি হাসপাতালের |
ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের তরফে কলকাতা হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দাখিল করা হয়েছে। আমরি সূত্রের খবর, কর্তৃপক্ষ চান, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিপূরণ কার মাধ্যমে দেওয়া হবে, তা আদালতই ঠিক করে দিক। এবং কারা ক্ষতিপূরণ পাবেন, তার তালিকা প্রকাশ করুক রাজ্য সরকার। ওই অগ্নিকাণ্ডে মৃতদের পরিবারকে পাঁচ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা আমরি-কর্তৃপক্ষ আগেই ঘোষণা করেছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ওই রিট আবেদন। ওই অগ্নিকাণ্ডে মৃতদের পরিবারকে রাজ্য সরকারের তরফে তিন লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেবে বলে ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই অনুসারে মৃতদের মধ্যে ২৯ জনের পরিবারের হাতে সোমবার ওই টাকা তুলে দেওয়া হয়। |