এক দিকে মানুষের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান, শিক্ষাগত যোগ্যতা আর অন্য দিকে ক্যানসারের মতো জটিল রোগের চিকিৎসা। দুইয়ের মধ্যে যোগসূত্র নির্ধারণ করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
সোমবার জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রেক্ষাগৃহে ‘সোশ্যাল এপিডেমিওলজি অফ ক্যানসার’ বা ক্যানসারের উপর সামাজিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করছিলেন তিনি। সেখানেই জানান, অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া দেশে অশিক্ষা বেশি। অশিক্ষা বাড়লে সচেতনতা কমে। তা ছাড়া দারিদ্র নিজেই একটা বড় সমস্যা। এক জন দরিদ্র মানুষের নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা হয় না, তাই তাঁর রোগ সময়মতো নির্ধারণ করা যায় না। তিনি চিকিৎসা পরামর্শও জোগাড় করতে পারেন না। আধুনিক চিকিৎসা, দামি ওষুধ সবই তাঁর ধরা ছোঁওয়ার বাইরে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের বক্তব্য, “অর্থ না-থাকলে চিকিৎসা করানোর স্বাধীনতাও চলে যায়। গরিব মানুষ বুঝতে পারে না, সে আগে পরিবারের পেট চালানোর কথা ভাববে, নাকি এক দিনের মজুরি নষ্ট করে চিকিৎসকের কাছে যাবে।” |
কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে।-নিজস্ব চিত্র |
অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মেয়েদের অবস্থা আরও খারাপ বলে উল্লেখ করেছেন অমর্ত্য সেন। কারণ, রোজগার করেন না বলে মেয়েরা সেখানে পরিবারে আরও ‘ব্রাত্য’। তাঁদের চিকিৎসার খরচ পরিবারের পুরুষের কাছে ‘বোঝা।’ সামাজিক ভাবেও তাঁরা এতটাই নিপীড়িত যে, নিজেদের শারীরিক অসুবিধার কথাটা মুখ ফুটে বলতেও পারেন না। যখন তাঁদের ডাক্তারের কাছে আনা হয় ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। জরায়ুমুখ ক্যানসার বা স্তন ক্যানসার সঠিক সময়ে ধরা পড়লে যেখানে মেয়েটি বেঁচে যেতে পারে, সেখানে স্রেফ সামাজিক বাধা তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।
অর্থনীতির সঙ্গে ক্যানসারের এই সম্পর্ক যে নেহাত তথ্যের কচকচি বা খাতায়-কলমে বন্দি অনুমান নয়, তা স্বীকার করেছেন ফলিত স্তরে ক্যানসার নিয়ে কাজ করা চিকিৎসকেরা। প্রতিদিন হাসপাতালে অসংখ্য ক্যানসার রোগীর চিকিৎসার সময় সামাজিক ও অর্থনৈতিক পার্থক্যের বিষয়টি তাঁরা স্পষ্ট অনুভব করতে পারেন বলেও জানিয়েছেন। যেমন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামীণ এলাকায় মূলত নিম্ন আয়ের পরিবারের মহিলাদের জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্ণয়ের এক প্রকল্প শুরু করেছিল চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতাল। কিন্তু পরীক্ষার সুযোগ বাড়ির প্রায় দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সত্ত্বেও দেখা যায়, মাত্র ৬০ শতাংশ মহিলা পরীক্ষা করাতে আসছেন। এর কারণ খুঁজতে শুরু করেন চিকিৎসকেরা।
চিত্তরঞ্জনের অন্যতম চিকিৎসক পার্থ বসুর কথায়, সমীক্ষায় দেখা যায়, যে মহিলারা আসছেন না, হয় তাঁদের স্বামী বা পরিবারের লোক বাধা দিয়েছেন, যাতায়াতের খরচ দিতে চাননি অথবা বাড়ির কাজ কে করবে, বাচ্চাদের কে খেতে দেবে এ কথা ভেবে মহিলারা আসতে পারেননি। তাঁদের নিজেদের স্বাস্থ্য গুরুত্বই পাইনি।
ক্যানসার চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতাতেও দারিদ্র ও অশিক্ষার সঙ্গে ক্যানসার চিকিৎসার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাঁর অভিজ্ঞতা বলে, চিকিৎসায় খরচ হবে ভেবে রোগ বেড়ে না-যাওয়া পর্যন্ত গরিব মানুষ সচরাচর ডাক্তারের কাছে আসে না। সেই সঙ্গে নিম্ন আয়ের পরিবারে অল্পশিক্ষাও দেখা যায়। ফলে রোগ কত মারাত্মক হতে পারে সেই ধারণাও তাঁদের মধ্যে কম থাকে। গৌতমবাবু বলেন, “বসিরহাট থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মহিলাকে আমার কাছে আনা হল। জরায়ু ক্যানসার, লাস্ট স্টেজ। তাঁকে বাড়িতে স্রেফ টোটকা খাইয়ে ফেলে রাখা হয়েছিল।” অর্থাৎ, মহিলার পিছনে কেউ খরচ করতে চাননি। গৌতমবাবুর মতে, মহিলা রোজগেরে হলে বোধহয় তাঁর প্রতি অবহেলা খানিকটা কমত!
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়েরও একই রকম অভিজ্ঞতা। নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের রোজগেরে পুরুষের ক্যানসার হলে তবু যতটা চিকিৎসা করা হয়, সেই পরিবারের মেয়েরা তার সিকিভাগও পান না বলে জানিয়েছেন তিনি। বর্ধমানের প্রত্যন্ত গ্রামে এক মহিলার স্তন ক্যানসার হয়েছিল। রোগ নির্ণয়ের পর তাঁকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে আসতে বলেছিলেন। তিন মাস পরেও তিনি এলেন না। তখন লোক পাঠিয়ে তাঁকে ডেকে আনা হল। তিনি এলে জানালেন, চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এলে তাঁর স্বামী ও ছেলেকে ভাত করে দেওয়ার লোক নেই। ভাত না খেলে তাঁরা মাঠে কাজ করবেন কী করে? তাই বাড়ির লোক তাঁকে আসতে দেননি! অমর্ত্য সেন এ দিন জানান, মুম্বইয়ের দু’টি সরকারি হাসপাতালে তিনি এক সময় সমীক্ষা চালিয়েছিলেন। তখন দেখা যায়, যে মেয়েরা ভর্তি হচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগকে অনেক দেরি করে, একেবারে শেষ মুহূর্তে ভর্তি করা হচ্ছে। ৭০-এর দশকে সিঙ্গুরে বিধবা মহিলাদের উপর এক সমীক্ষাতেও তিনি দেখেছিলেন, তাঁদের অসুস্থতা যে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ বা তা নিয়ে ভাবা উচিত, এই ধারণাটাই ওই মহিলাদের নেই।
অর্থনৈতিক অবস্থার পাশাপাশি ক্যানসার রোগীদের ইতিবাচক মনোভাব, চিকিৎসকের মানসিক সাহায্য ও সচেতনতাও চিকিৎসার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান অমর্ত্য সেন। সচেতনতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নিজে ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার কথাও উল্লেখ করেন। ১৮ বছর বয়সে মুখে ক্যানসার হয়েছিল তাঁর। নিজেই রোগ বুঝতে পেরে নীলরতন সরকার হাসপাতালে দেখাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এক চিকিৎসক হেসে উড়িয়ে দিয়ে জানিয়েছিলেন, কিচ্ছু হয়নি। পরে অন্য চিকিৎসকেরা তাঁর চিকিৎসা করেন। এ দিন চিনের উদাহরণ টেনে চিকিৎসা ক্ষেত্রে জাতীয় আয়ের আরও বেশি অংশ খরচ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। |