গোলা বোঝাই,
দাম না-পেয়ে বিপন্ন ধানচাষিরা
ত বছর মেরেছিল খরা। এ বার অতিফলনের ধাক্কায় পথে বসতে চলেছেন রাজ্যের ধানচাষিরা।
রবিবার বর্ধমানের মেমারিতে এক ধানচাষির ‘আত্মহত্যা’ এরই ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অনেকে। অমিয় সাহা নামে ওই চাষির মৃত্যুর জন্য প্রশাসন ‘শারীরিক অসুস্থতাজনিত মানসিক অবসাদ’কে দায়ী করলেও অমিয়বাবুর বাড়িতে মজুত অবিক্রিত তিনশো বস্তা ধান ঘটনাটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ‘শস্যগোলা’ হিসেবে পরিচিত বর্ধমানেই গত তিন মাসে আরও তিন ধানচাষি আত্মঘাতী হয়েছেন। এবং প্রত্যেকেরই পরিজনের দাবি, ধানের দাম না-পাওয়ারই ‘মাসুল’ প্রাণ দিয়ে চুকিয়েছেন ওঁরা।
দু’মরসুম আগে আলুর ফলন কম হওয়ায় আলুচাষিরা দাম পাননি। আবার গত মরসুমে (২০১০-’১১) অতিফলনের জেরে আলুচাষিদের মাথায় হাত পড়েছিল। সেই আলু এখনও হিমঘরে, যা রাখতে সরকারকে ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। এ দিকে নতুন আলুও উঠতে শুরু করেছে। বর্ষায় অতিবর্ষণে সব্জিচাষ মার খেয়েছিল। অথচ পুজোর পরে অতিফলনের কারণে সব্জির দাম পড়ে গেল। তবে সবচেয়ে বড় ‘বিপর্যয়’ সম্ভবত হতে চলেছে ধান চাষে। যার প্রধান কারণ, অনুকূল আবহাওয়ায় বিপুল ফলন ও তার জেরে চাষিদের দাম না-পাওয়া। সরকারের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে। কেন?
ধান, পাট, তুলো, গম, আখ ইত্যাদির অতিরিক্ত ফলনের পরে চাষিরা বাজারে সে ভাবে দাম না-পেলে রাজ্য সরকারগুলো সহায়ক-মূল্যে ফসলের একাংশ কিনে নেয়। রেশনের জন্যও সরকারকে চাল কিনতে হয়। কিন্তু এ বার রাজ্যের উদ্যোগে চাষিরা তেমন সন্তুষ্ট নন। সেই অসন্তোষেরই আঁচ ছড়িয়ে পড়ছে জেলায় জেলায়। বিক্ষোভ-অবরোধ নৈমিত্তিক। কোথাও ধান পুড়িয়ে প্রতিবাদ হয়েছে। আন্দোলনে নেমেছে সিপিএমের কৃষকসভাও। সব মিলিয়ে রাজ্য সরকারও কিছুটা কোণঠাসা। ক্ষোভের কারণ কী?
এর মূলে সরকারি ধান খরিদের নতুন পদ্ধতি। যেমন সপ্তাহ তিনেক হল, জেলায় জেলায় শিবির করে ধান কিনছে সরকার। মোটা ধানের কুইন্টালপিছু দাম ধার্য হয়েছে ১০৮০ টাকা। সরু ধানের ১১১০ টাকা। কৃষকমহলের বক্তব্য, ধান কেনার পরিমাণ আদৌ যথেষ্ট নয়। ব্লকপিছু দু’-একটা মাত্র শিবির বসছে। তা-ও কোথায়, কবে হবে, ঠিকঠাক জানা যাচ্ছে না। ক্যাম্পে ধান নিয়ে যেতে অনেকটা খরচ পড়ছে। ধান ‘না-শুকোনো’ ও ‘ধুলো থাকার’ যুক্তি দেখিয়ে বস্তাপিছু পাঁচ কেজি বাদ দেওয়ার চাপও আসছে বলে অভিযোগ। পাশাপাশি অনেক কৃষকের আক্ষেপ, ধানের দাম বাবদ সরকারের থেকে পাওয়া চেক ভাঙাতে দশ-বারো দিনও লেগে যাচ্ছে।
হুগলির কামারপাড়া কৃষকগোষ্ঠীর কোষাধ্যক্ষ লক্ষ্মণচন্দ্র ঘোষ বলেন, “শিবিরে ধান দেওয়ার অনেক হ্যাপা। আগে পঞ্চায়েতে আবেদন। পঞ্চায়েত ঠিক করে দিচ্ছে, কতটা ধান নেওয়া হবে। পুরো ধান বেচতে পারছি না।” পুড়শুড়ার দেউলপাড়ার মঙ্গলময় কুণ্ডু ন’বিঘেয় আমন ফলিয়েছেন। বিঘেপিছু খরচ পড়েছে ছ’হাজার টাকা, উৎপাদন ছ’কুইন্টাল (অন্যান্য বার হয় গড়ে ৫ কুইন্টাল)। সরকারি শিবিরে পুরো ধান বেচেও মঙ্গলবাবুর ক্ষোভ, “লাভ হয়েছে বিঘেয় ৪৮০ টাকা। অন্য বার বাজারে ধান বেচে প্রায় দু’হাজার টাকা লাভ থাকে।”
রাজ্যের অবশ্য দাবি, চাষিদের স্বার্থেই ধান কেনার পদ্ধতিতে এই পরিবর্তন। যেমন, ফড়ে-দালালদের হাত এড়িয়ে চাষিরা যাতে পুরো দাম পান, তাই সরাসরি চেক দেওয়া হচ্ছে। যে সব বিক্রেতার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই, তাঁদের নামে নিখরচায় অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা হচ্ছে। কিন্তু চাষিদের থেকে ‘বাঞ্ছিত’ পরিমাণ ধান সরকার কিনছে কি?
খাদ্য দফতর-সূত্রের দাবি, এ বার তারা ২০ লক্ষ টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সাম্প্রতিককালে যা সর্বাধিক। বস্তুত এর বেশি কেনার সামর্থও তাদের নেই। কেননা, অর্থ দফতর এ বাবদ দিয়েছে দু’শো কোটি টাকা। অন্য দিকে আমন-বোরো-আউশ মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এ বছরে ধানের উৎপাদন প্রায় দেড় কোটি টন। এমনকী, পুরুলিয়ার মতো ‘শুখা’ জেলাতেও ভাল ফলন হয়েছে। সুতরাং সরকার কুড়ি লক্ষ টন কিনলেও বাকি ১ কোটি ৩০ লক্ষ টন বিক্রির জন্য চাষির ভরসা সেই খোলা বাজার। অথচ বাজার এখনও তেমন চাঙ্গা নয়। সরকার ধান কেনা শুরুর আগে বাজারে বস্তাপিছু (৬০ কেজি) ধানের দাম যাচ্ছিল ৫৪০ টাকা। এখন বিভিন্ন জেলায় তা ৪৭০ টাকার আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। অর্থাৎ, খোলা বাজারে দাম উঠছে না। আবার সরকারকে ধান বেচেও চাষিদের সুরাহা হচ্ছে না। গোলায় ধান জমে থাকছে। মানসিক অবসাদে ভুগছেন অনেকে। কেউ কেউ ক্ষতি পোষাতে ধানের জমিতে আলু চাষ শুরু করে দিয়েছেন।
ধানের দাম না-ওঠার জন্য আরও কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করেছে ব্যবসায়ী ও কৃষিজীবী মহল। তার অন্যতম, বাংলাদেশে চাল রফতানি মার খাওয়া। ২০১০-এর অগস্ট থেকে দু’দেশে চাল পারাপারে নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়েছে বটে, তবে বাংলাদেশ এখন চিন-মায়ানমার থেকেও চাল আমদানি করছে। তা ছাড়া সহায়ক আবহাওয়া পেয়ে বাংলাদেশেও এ বার ধানের ফলন ভাল। উপরন্তু রাজ্যের একাধিক কৃষক সংগঠনের নেতাদের দাবি, অন্ধ্র-বিহার-ঝাড়খণ্ড থেকে সরু ও মিহি চাল পশ্চিমবঙ্গের বাজারে ঢুকে পড়েছে, যার দাম মধ্যবিত্তের নাগালে। রাজ্যের ধান-চালের বাজারে একে ‘নতুন সঙ্কট’ হিসেবে দেখছেন ওঁরা। একই সঙ্গে থাকছে পশ্চিমবঙ্গের ধানের গুণমান নিয়ে প্রশ্নও। দেশের গড় ফলনের ভিত্তিতে কেন্দ্রের হিসেব বলছে, এক কুইন্টাল (১০০ কিলোগ্রাম) ধানে ৬৮ কেজি চাল পাওয়া যায়। কিন্তু বহু চালকল-মালিকের মতে, এ রাজ্যের ধান থেকে কুইন্টালপ্রতি চাল মেলে বড়জোর ৬৪ কেজি। এখানেও বড় ধাক্কা খাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের চাষিরা। চালকল চালাতে অন্য রাজ্য থেকে ধান আনতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বেশ কিছু মিল-মালিক। কৃষি-আধিকারিকেরা কী বলছেন? রাজ্য কৃষি দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা (গবেষণা) প্রদীপ সেনের দাবি, “আমাদের রাজ্যে যে চাল বিক্রি হয়, তার ৮৫% পশ্চিমবঙ্গেই উৎপাদিত। গোবিন্দভোগ-কামিনীভোগ-তুলাইপাঁজির মতো সুগন্ধি চালও এর মধ্যে রয়েছে। ১৫% চাল অন্যান্য রাজ্য থেকে আসতে পারে। তবে সেই চাল উচ্চবিত্তেরাই কেনেন।”
বীজ-বিশেষজ্ঞ তথা রাজ্যের প্রাক্তন কৃষি-অধিকর্তা শুভেন্দুদেব চট্টোপাধ্যায় অবশ্য প্রদীপবাবুর এই বক্তব্য মানছেন না। শুভেন্দুদেববাবুর মতে, “বিহার, ঝাড়খণ্ডের মতো কিছু রাজ্যে এখন সরু ও মিহি চালের (ধান) চাষ পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বেশি হচ্ছে। ওই ধরনের বীজের ব্যবহার এ রাজ্যে এখনও কম।” বস্তুত চল্লিশ বছর আগে উদ্ভাবিত বীজ দিয়েই এ রাজ্যে আমন ও বোরো মরসুমে ধানচাষ চলছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রাক্তন কৃষি-অধিকর্তা।

(চলবে)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.