এ বছর বিধানসভা নির্বাচনে দলের যে বিপর্যয় হয়েছে, তা মোটেও ‘আকস্মিক’ নয়। বরং তিন বছর আগের পঞ্চায়েত ভোট থেকেই স্পষ্ট হয়েছিল যে, জনসমর্থন ক্রমশ কমছে। কিন্তু দল তা থেকে শিক্ষা নেয়নি।
দলের ২০ তম জেলা সম্মেলনের সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে এই স্বীকারোক্তি করেছে বাঁকুড়া জেলা সিপিএম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পার্টির নেতা, কর্মীদের একটা বড় অংশ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে ‘পার্টিনীতি বর্জিত কাজে’ই বেশি মন দিয়েছিলেন। এর সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে দলীয় সদস্যদের একাংশের ‘অনৈতিকতা’ ও ‘অসদাচরণ’। কিছু নেতা-কর্মীর প্রতি অনাস্থাই যে শেষ পর্যন্ত সার্বিক ভাবে পার্টির প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা পার্টিকে ‘প্রত্যাখ্যান’ করেছেন।
দলের নেতা-কর্মীদের একাংশের তীব্র সমালোচনা করার পাশাপাশিই রয়েছে পরের পর ভোটে জনসমর্থন হারানো নিয়ে আশঙ্কার কথা। প্রতিবেদনে সাফ লেখা হয়েছে, ‘গত জেলা সম্মেলনের পরে ২০০৮পঞ্চায়েত, ২০০৯লোকসভা, ২০১০পুরসভা এবং ২০১১বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চারটি নির্বাচনেই পার্টির জনসমর্থন ধারাবাহিক ভাবে হ্রাস পেয়েছে। জনগণের সমর্থন ও আস্থা আকস্মিক ও সাময়িক ভাবে হ্রাস পায়নি। বলা যেতে পারে পার্টিকে প্রত্যাখ্যান করার মনোভাব এই নির্বাচনী রায়েই প্রকাশ পেয়েছে’।
প্রতিবেদনে আঞ্চলিক কমিটিকে জেলার পার্টি সংগঠনের দুর্বলতম ক্ষেত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘নিস্ক্রিয়তা ও নেতৃত্বদানে ঘাটতি’ এই দুটি লক্ষণই আঞ্চলিক কমিটিগুলিতে ভাল রকম রয়েছে। শুধু আঞ্চলিক কমিটিকেই নয় প্রতিবেদনে শাখা কমিটিগুলোকেও একহাত নেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘শাখা সভাগুলিতে এযাবৎ রাজনৈতিক আলোচনার ধারাবাহিকতা ছিল না। গৃহীত সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার ক্ষেত্রেও দুবর্লতা ছিল’। শাখা পরিচালনার ক্ষেত্রে উচ্চতর কমিটির ভূমিকায় ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করেছেন জেলা নেতৃত্ব। একই সঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের পর সাংগঠনিক কাজের পর্যালোচনার ভিত্তিতে ৭ জন লোকাল সম্পাদক এবং ৮ জন জেলা কমিটির সদস্যের ভূমিকা ‘সন্তোষজনক ছিল না’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
পার্টিতে নতুন সদস্য নিয়োগ করা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, ‘সদস্যদের যে ন্যূনতম চেতনা নিয়ে পার্টিতে যুক্ত হওয়ার কথা তার অভাব দেখা গেছে। দেখা গেছে পছন্দ অপছন্দের ভিত্তিতে সদস্যভুক্তির প্রবণতা। জণগণকে আকৃষ্ট করার পরিবর্তে সদস্যদের একাংশের অসদাচরণ, অস্বচ্ছতা, অনৈতিকতা জণগণকে দূরে ঠেলে দিয়েছে’। আরও বলা হয়েছে, ‘পার্টি পরিচালিত পঞ্চায়েত, সমবায়, পুরসভা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে যে কমরেডগণ দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদের একাংশ এবং কোনও প্রশাসনিক দায়িত্বে না থাকা সত্ত্বেও কিছু কমরেড পার্টির প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে নীতিবর্হিভূত কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছেন’।
রাজনৈতিক সন্ত্রাসের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। দলীয় কর্মীদের একাংশের আচরণের প্রবল সমালোচনা করলেও যে-সব নেতা-কর্মী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ছেন, তাঁদের দলের ‘সম্পদ’ হিসাবেও আখ্যা দিয়েছেন জেলা নেতৃত্ব। বস্তুত, বিধানসভা ভোটের পর থেকে এই জেলায় খুন হয়েছেন পাঁচ জন সিপিএম নেতা-কর্মী। প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে। প্রতিবেদনে সেই হিংসার উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, ‘পার্টিকর্মী, সদস্য ও অনুগামীরা বিরোধীদের প্রতিহিংসামূলক সন্ত্রাস, আক্রমণ প্রতিরোধ করছেন। আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রাণ দিচ্ছেন। জীবিকার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু পার্টি ছেড়ে যাচ্ছেন না। মাথা নতও করছেন না। এরাই আমাদের সম্পদ’। বর্তমানে ২৭টি আঞ্চলিক কমিটি কাযার্লয় সন্ত্রাসের কারণে বন্ধ রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ‘কুফল’ যে দলে পড়েছে, প্রকারান্তরে তা-ও মেনে নিয়েছেন সিপিএম নেতৃত্ব। সেই সূত্রেই প্রতিবেদনে অকপট স্বীকারোক্তি, ‘পঞ্চায়েত ও পুরসভায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কাজ করার মধ্যে দিয়ে একপেশে মনোভাব গড়ে উঠেছিল। এবং এই একপেশে মনোভাব শ্রেণি ও গণসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হওয়ার প্রক্রিয়ার ক্ষতি করেছে। সরকারমুখীনতা, আন্দোলনের পরিবর্তে তদারকি, পার্টির গণভিত্তিকে সংহত ও সম্প্রসারিত করার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে’। প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে, ‘পার্টিকর্মী ও সদস্যদের একাংশ পার্টিনীতি বর্জিত কাজে জড়িয়ে পড়ায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সেভাবে গুরুত্ব পায়নি।’
নির্বাচনী ভরাডুবির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকেই জনসমর্থন বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যায়। পঞ্চায়েত নির্বাচনে জনসমর্থন হ্রাসের হার ৩.৭৮ শতাংশ কমে যায়। পার্টির নেতা, কর্মীদের একাংশের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ক্রমেই প্রকট হয়। এই অনাস্থা অবশেষে পার্টির প্রতি অনাস্থায় পরিণত হয়। নেতৃত্বের যে বোঝাপড়া, যে দৃঢ়তা এই নীতিচ্যুতির বিরুদ্ধে কয়েকটি ক্ষেত্রে হলেও কঠোর হতে পারত তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি’।
এত বিপর্যয়ের মধ্যেও একটা সান্ত্বনা অবশ্য খুঁজে পেয়েছেন সিপিএম নেতৃত্ব। প্রতিবেদনে বোধহয় সে জন্যই বলা হয়েছে, ‘৩৪ বছর ক্ষমতাসীন থাকার পর এবং এই বিপর্যয়কর পরাজয়ের মধ্যেও প্রায় ২ কোটি মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছেন’। |