মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের রূপায়ণে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। গত বৎসর দরিদ্র পরিবারগুলিকে মাত্র ২৬ দিন কাজ দেওয়া হইয়াছিল, এ বৎসর এ পর্যন্ত মাত্র ১৯ দিন কাজ দেওয়া সম্ভব হইয়াছে। ইহাতে রাজ্য সরকারের কার্যদক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠিতে বাধ্য। রাজ্য যখন উন্নয়নের অর্থের জন্য কেন্দ্রের নিকট নিয়মিত তদ্বির-তাগাদা করিতেছে, তখন বরাদ্দ অর্থ খরচ করিবার অক্ষমতা উন্নয়নের অপর সংকটকে নির্দেশ করিতেছে। তাহা এই যে, অর্থের জোগানই যথেষ্ট নহে, তাহা খরচ করিবার ক্ষমতাও থাকা চাই। যে দক্ষতা, তৎপরতা এবং নিয়মানুবর্তিতা থাকিলে গ্রামে নিয়মিত নানা উন্নয়নের প্রকল্প রূপায়ণ করিয়া, হিসাব জমা দিয়া, নূতন প্রকল্পের টাকা দাবি করা সম্ভব, তাহা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাইতেছে না। কিন্তু সমস্যা কেবল রাজ্য স্তরেই নহে, কেন্দ্রীয় সরকারের স্তরেও গলদ রহিয়াছে। এবং তাহা অতি মৌলিক স্তরে।
কেন্দ্রীয় সরকার যেখানে এই প্রকল্পের সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করিয়াছে, তাহার উদ্দেশ্য, বিধেয় এবং বরাদ্দ সকলই স্থির করিয়াছে, সেখানে রাজ্য সরকারের উপর প্রকল্পের ব্যয়ভারের অংশ চাপানো হইবে কেন? ইহা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার আদর্শের বিরোধী। উন্নয়নের দ্বারা দারিদ্র মোচনের কাজটি প্রধানত রাজ্য সরকারগুলির, অতএব রাজ্যের নাগরিকদের চাহিদা এবং স্থানীয় অর্থনীতির প্রয়োজন অনুসারে রোজগার প্রকল্প রাজ্যস্তরেই পরিকল্পিত হওয়া দরকার। কেন্দ্রীয় স্তরে তাহার কিছু প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন হইতে পারে, নিয়মিত পর্যালোচনা এবং মূল্যায়নের ব্যবস্থাও করা হইতে পারে। কিন্তু কেন্দ্র সম্পূর্ণ পরিকল্পনাটি তৈরি করিয়া রাজ্যগুলিকে নায়েবমশাইয়ের মতো ব্যবহার করিবে, ইহা গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিপন্থী। কেহ বলিতে পারেন, রাজ্যের ব্যয়ভার সামান্যই, এই প্রকল্পের মোট খরচের ১০ শতাংশের অধিক নহে। কিন্তু প্রশ্নটি নীতিগত। রোজগার প্রকল্পের পরিকল্পনায় যদি রাজ্যগুলি অংশগ্রহণ করিত, তাহা হইলে তাহাদের আর্থিক দায় লইতে অসুবিধা ছিল না। যেখানে মত জানাইবার অধিকার নাই, সেখানে খরচ জোগাইবার দায় চাপাইয়া দিলে তাহা ঘোর অন্যায় হয়।
যে কোনও পরিকল্পনা ভাল কাজ না করিলে তাহার রূপায়ণের সমস্যাগুলি কী, তাহা লইয়া প্রশ্ন উঠিতে থাকে। সরকারি কর্মীদের অপদার্থতা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক নেতাদের দায়বদ্ধতার অভাব, স্থানীয় মানুষের সরকারি প্রকল্পের প্রতি অনাস্থা, এমন নানা বিষয় লইয়া ঘোরতর চর্চা শুরু হইয়া যায়। কিন্তু গোড়ার কথাটা অনেকেই ভুলিয়া থাকেন। তাহা হইল, প্রকল্পের পরিকল্পনাই যদি যথাযথ না হইয়া থাকে, যদি তাহার বিধিব্যবস্থাগুলি তাহার উদ্দেশ্যসাধনের উপযোগী না হইয়া থাকে, তাহা হইলে রূপায়ণে ত্রুটি থাকিতে বাধ্য। কোন রাজ্য দু’দিন বেশি কাজ দিয়াছে, কোন রাজ্য কম, সেই বিবাদ করিতে গিয়া আমরা ভুলিয়াছি, গোটা দেশে গড়ে ৩৭ দিনের বেশি কাজ দেওয়া যায় নাই। একশো দিন কাজ করিয়াছে, এমন পরিবার মাত্র পাঁচ শতাংশ। ব্যর্থতা ঢাকিতে মূল্যায়নের পরিমাপই বদলাইয়া ফেলিয়াছে কেন্দ্র কোন রাজ্য কত পরিবারকে ১৫ দিনের অধিক কাজ দিতে পারিয়াছে, এখন তাহার হিসাব হইতেছে। পশ্চিমবঙ্গ, অসম বা ওড়িশার মতো রাজ্যগুলির ব্যর্থতা লইয়া সমালোচনা করা যাইতেই পারে, কিন্তু সমাধান সেখানে নাই। রোজগার প্রকল্পের পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় স্তরে হইবার জন্য, রাজ্যগুলির উপর তাহা চাপাইয়া দিবার জন্য পরিকল্পনা ব্যর্থ হইতেছে কি না, তাহার পর্যালোচনা প্রয়োজন। |