রাজার আদেশে আমলকি গ্রাম থেকে শ্রী গুপিনাথ গায়েনকে বার করে দেওয়া হচ্ছে...।
ঢ্যাঁটরা পিটিয়ে এই ঘোষণার পরেই গাধার পিঠে চেপে গুপি বেরিয়ে গেলেন গ্রাম থেকে। চোখ মুছে পর্দা থেকে সরে গেলেন তাঁর বাবা।
মাইকের ব্যবহার শুরুর পর থেকে গ্রাম-বাংলার এই বহু পরিচিত দৃশ্য এখন উধাও। এই জেট গতির যুগে প্রচার ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। এসএমএস এবং ই-মেলই এখন সবচেয়ে ক্ষুরধার উপকরণ। পাশাপাশি রয়েছে হোর্ডিং এবং সংবাদমাধ্যম। এই সময়ে গ্রামে ঢোল পিটিয়ে প্রচারের কথা বললে অবাক হওয়ারই কথা। রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর নতুন বছরে কিন্তু সেই পরিকল্পনাই নিয়েছে। ঢোল নয়, গ্রামের হাটে হাটে ঢাক পিটিয়ে দফতরের বিভিন্ন প্রকল্পের প্রচার করবেন ঢাকিরা। সেই মতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে তাঁদের। ঢাক বাজিয়ে, সামান্য কয়েকটি কথা বলে তাঁরা মানুষের হাতে তুলে দেবেন তথ্য-সম্বলিত প্রচারপত্র। |
দীর্ঘদিন পর্যন্ত কিন্তু প্রচারের কাজে অব্যর্থ উপকরণ ছিল ঢ্যাঁটরা বা চলতি কথায় ঢ্যাঁড়া-ই (বানান ভেদে ঢেঁটরা, ঢেড়রা বা ঢেঁড়া)। ঢ্যাঁটরা হিসেবে ব্যবহার করা হত ছোট মাপের ঢোল। সত্তর দশকের শেষেও পঞ্চায়েত নিজেদের প্রচারের জন্য ব্যবহার করেছে ঢ্যাঁটরা। শুধু ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’-ই নয়, ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতেও দেখা গিয়েছে স্কুল পড়ুয়াদের সামনে এসে ঢ্যাঁটরা পিটিয়ে স্কুল বন্ধের ঘোষণা করে যাচ্ছেন হীরক-রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র জানাচ্ছেন, ইংল্যান্ডের সম্রাজ্ঞী হিসেবে যে দিন রানি ভিক্টোরিয়ার অভিষেক হয়েছিল, সে দিনও ঢোল বাজিয়ে বা ‘ঢোল-সহরৎ’ করেই ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল সেই বার্তা। জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কোম্পানি যুগের অবসান ঘটিয়ে ভারতের নাগরিককুল এ বার থেকে সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার শাসনাধীন। ‘ঢোল-সহরৎ’ অথবা ঢ্যাঁটরা মাধ্যম যাই হোক না কেন, উদ্দেশ্য ছিল প্রচার। যাঁরা ঢ্যাঁড়া পেটাতেন, তাঁদের ঢ্যাঁড়াদার বলা হত। দফাদার যখন কর আদায় করতে যেতেন, জমিদার যখন মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতেন তখন ব্যবহার করা হত ঢ্যাঁড়া। সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষই এই কাজ করতেন। এই ঢ্যাঁড়াদারদের নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন অশোকতরু চক্রবর্তী। তিনি জানাচ্ছেন ভোটের দিন ঘোষণার মতো সরকারি ঘোষণা যেমন হত, তেমনই চিকিৎসক বা অন্য কেউ ব্যক্তিগত প্রচারের জন্যও ঢ্যাঁড়াদারদের ব্যবহার করতেন।
গৌতম ভদ্র মনে করিয়ে দিলেন, আদি কালে যিনি ঢোল বাজাতেন, তিনি নিজে প্রচারের কাজ করতেন না। প্রচারপত্র বা সরকারি নির্দেশনামা পড়ার জন্য ‘নকিব’ থাকতেন সঙ্গে। গৌতমবাবুর কথায়, “ঢোল বা ঢাকের আওয়াজ মানুষকে আকৃষ্ট করে। দেখবেন, এখনও বাঁদর-খেলার জন্য ডুগডুগি বাজানো হয়। সেটা আকৃষ্ট করার জন্যই।” আজকের দিনে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে প্রচারের উপযোগিতা কতখানি? গৌতমবাবু মনে করেন, টিভিতে বা খবরের কাগজে প্রচারের প্রভাব রয়েছে ঠিকই। তেমনই বহু বিজ্ঞাপনের মাঝে পিছিয়ে পড়া মানুষদের উন্নয়ন সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন হারিয়েও যায়। তাই আজও গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঢাক বাজিয়ে প্রচারের প্রভাব অনস্বীকার্য। বিশেষ করে সেটা যদি স্থানীয় মানুষদের উন্নয়ন-প্রকল্পের জন্য প্রচার হয়, বললেন তিনি।
সমীক্ষা জানাচ্ছে, যাঁরা দুর্গাপুজো, কালীপুজো বা অন্যান্য সময়ে ঢাক কাঁধে কলকাতায় চলে আসেন, তাঁদের প্রায় ৯৯ শতাংশই তফসিলি জাতিভুক্ত। বছরের মাত্র কয়েকটা দিন ঢাক বাজিয়ে উপার্জন হয়। বাকি সময়টুকু অন্যের জমিতে চাষ করে বা শ্রমিকের কাজ করে লড়াই চলে জীবনধারণের। অনগ্রসর কল্যাণ দফতরের মন্ত্রী, প্রাক্তন পুলিশ-কর্তা উপেন বিশ্বাস জানাচ্ছেন, রাজ্যের ৩৪১টি ব্লকের প্রতিটি থেকে এ রকমই এক জন করে ঢাকি বেছে নেওয়া হবে। গ্রামের হাটে হাটে ঘুরে তাঁদের প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হবে।
মন্ত্রীর মতে, এতে প্রতি মাসে সেই ঢাকিদের নির্দিষ্ট রোজগারের যেমন ব্যবস্থা করা যাবে, তেমনই মাগ্গি-গন্ডার বাজারে কমে আসবে বিভাগের প্রচারের খরচও। গুপ্ত যুগের সময় থেকে ইতিহাসে যে ঢাকের উল্লেখ রয়েছে, এই শতকেও বেঁচে থাকবে সেই ঢাকের ব্যবহার। পাশাপাশি ঢ্যাঁড়ার মাধ্যমে যে প্রচার সম্পর্কে মানুষ আজ বিস্মৃত, ফিরে আসবে সেই স্মৃতি। এক ঢিলে চার পাখি বলছেন মন্ত্রীই। |