|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
আমি তো বড় হইনি |
ঠিক মুকুলের মতো। সোনার কেল্লা থেকে রয়েল বেঙ্গল রহস্য।
বড় হতে দেন না যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে ক’দিন কাটানোর কথায় কথায় শিলাদিত্য সেন |
সোনার কেল্লা যে বছর ছবি হয়ে বেরল, সে বছরই রয়েল বেঙ্গল রহস্য লিখেছিলেন বাবা, ১৯৭৪। ততদিনে জিম করবেট, কেনেথ অ্যান্ডারসন, বা যাবতীয় শিকারের বই কিনে পড়া হয়ে গিয়েছে বাবার। শারদীয়া দেশ-এর জন্যে লিখতেন, মে মাসে লেখায় হাত দিয়েছিলেন। প্রথম খসড়ায় গোটা দু’য়েক নামও ভেবেছিলেন: ‘ফেলুদার অরণ্যকাণ্ড’ আর ‘যেখানে বাঘের ভয়’। বই হয়ে বেরয় পরের বছর, ’৭৫-এ। সন্দীপ রায় বলছেন, আর সূর্যাস্তের রোদ্দুর বদলে দিচ্ছে পাতার রং। যে বাংলোর বারান্দায় বসে বলছিলেন সন্দীপ, সেটা জঙ্গলের মুখে। মহানন্দা অভয়ারণ্যে শুকনা রেঞ্জ। মে মাস, সেদিনের মতো ‘প্যাক আপ’ হেঁকে শিলিগুড়ি ফিরে গিয়েছে শুটিংয়ের দল, সন্দীপের সঙ্গে রেখে গিয়েছে ফেলুদা/সব্যসাচী চক্রবর্তীকেও। |
|
জঙ্গলের মাথায় একটা লাল মেঘ এসে পড়ায় রাঙা আভা গাছগাছালির ডালে-পাতায়। সূর্য ডুবুডবু, কোথাও জনমানব নেই। সব্যসাচী ভিতরে, বাংলোর বাইরে ওই কাঠের পাটাতনঅলা চমৎকার বারান্দায় বসে কথা শুনছি রয়েল বেঙ্গল রহস্য-এর, পরিচালকের কথার ফাঁকে-ফাঁকেই কখন যেন সন্ধে নেমে আসে জঙ্গলে।
এই যে দিনমানে, সন্ধ্যায়, রাতে অনবরত রং বদলে যাচ্ছে জঙ্গলের... একদিন তো হঠাৎ বৃষ্টির পর আরও সবুজ হয়ে গেল চারপাশ... আর-একদিন মহানন্দার ধারে দাঁড়িয়েছি, শুকনো নদীর চর, তার থেকে কয়েকটা নিষ্পত্র গাছ উপরের দিকে উঠেছে, ডালপালা-আঙুল মেলে যেন আকাশটাকে ধরতে চাইছে... এসব নিয়েই রয়েল বেঙ্গল রহস্য। ছেঁড়া ছেঁড়া শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা জানাতে থাকেন সন্দীপ। ‘আসলে জঙ্গল তো এমনিতেই রহস্যময়, তাতে মিশেছে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির রহস্য!’
কী রকম? একটু নড়েচড়ে বসেন সন্দীপ, অন্ধকার বনপথে রাতচরা পাখিদের উড়ে যাওয়ার শব্দ। “ছ’লাইনের একটা সংকেত দিয়ে শুরু, ফেলুদার মূলধন এখানে মগজাস্ত্র। ধাঁধারহস্য তো বটেই, মহীতোষ বা তাঁর দাদা দেবতোষ সিংহরায়ের মতো জটিল চরিত্রের রহস্যভেদ করাটা বাঘের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে কম কঠিন নয়, বরং বেশি। গপ্পে এক জায়গায় ফেলুদা বলেই ফেলে ‘মানুষের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি সাদাসিধে, তারও মন একটা বাঘের মনের চেয়ে অনেক বেশি প্যাঁচালো।’ কিন্তু মনের এই অন্ধকারগুলো যাতে আবার ভারাক্রান্ত না করে, ক্যামেরা সেজন্যে প্রায় সব সময় নিসর্গে। চা-বাগান, রেললাইন, জঙ্গল, দূরে পাহাড়, নদীর ধারে ঝকঝকে আকাশ...!’’
|
২ |
বেড়াতে যাচ্ছি মনে হয়েছিল আমারও, সোনার কেল্লা দেখার সময়, ক্লাস ফাইভ-এ পড়ি। ‘তুই যে ভাবছিস আমি মুকুলের কেস্টা নেব, রাজস্থান যাব, আর এই ফাঁকে তোরও রাজস্থানটা ঘুরে আসা হবে স্কুল কামাই করে...’, ফেলুদা কথাগুলো যেন আমায় বলেছিল, আমি-ই যেন তোপসে। বড়দিনের ছুটিতে মুক্তি পেয়েছিল সোনার কেল্লা।
তোপসের বাবা-মা তোপসে আর ফেলুদাকে ট্রেনে তুলে দিতে হাওড়া স্টেশনে এসেছেন, ঘোষণা হচ্ছে: সাত নম্বর আপ তুফান এক্সপ্রেস আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ন’টা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিটে ছাড়বে। শীতে রাজস্থান বেড়ানোর সেই শুরু। তারপর জয়পুর স্টেশনে সকালবেলা শীতের রোদ পোহাতে পোহাতে চা খাওয়া। লালমোহনবাবু বলছেন: বাঃ, দিব্যি চা মশাই, দিব্যি তো। ফেলুদা যোগ করছে: চা-টা সাধারণ, দুধটা হয়তো উটের। ফের লালমোহনবাবু: উট! আশ্চর্য জানোয়ার! কিংবা তারও পরে যোধপুর সার্কিট হাউসে থামগুলোর লম্বা লম্বা ছায়া, তেরছা হয়ে পড়ে থাকে বারান্দার রোদের ওপর, শীত-সকালে একটা অটো করে এসে নামেন লালমোহনবাবু, ‘গুড মর্নিং’ বলেন তোপসে আর ফেলুদাকে, দল বেঁধে সেদিন বিকানির যাওয়া হবে। এই বেড়ানোটাই আবার কেমন থমথমে হয়ে ওঠে, যখন যোধপুর সার্কিট হাউসের বাইরে রাত বাড়ে, কাঁটাতারের বেড়ার সামনে টর্চ-হাতে ফেলুদা ‘আসল’ ডা. হাজরা-র মিলিয়ে যাওয়া দেখতে-দেখতে বলে ওঠে: নিশ্চিন্ত আর থাকা গেল না রে তোপসে। ‘এই যে গা-ছমছম ভয়, বেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এটা সারাক্ষণ আছে রয়েল বেঙ্গল রহস্য-এ, কখন বাঘ এসে পড়ে! বাঘ হয়তো সামান্য সময়ের জন্যেই আসে, কিন্তু তার অদৃশ্য উপস্থিতিটা আগাগোড়া টের পায় সকলে। সন্ধে, রাতে, এমনকী দিনেদুপুরেও।’ সন্দীপের কথা থামার সঙ্গে সঙ্গে সামনের খোলা নির্বাক জঙ্গল আরও নিঃশব্দ অন্ধকার হয়ে ওঠে। দূরে নিঃসীমে দাঁড়ানো গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হয়: ওদের ভয় করে না? |
৩ |
ফেলুদা নির্ভয়ে মাথাখোলা জিপের ভিতর বসে, না চালালেও হাত স্টিয়ারিংয়ে। আকাশ ঘন নীল, তাতে লম্বা লম্বা সাদা মেঘ, সকাল-দুপুরের সন্ধিক্ষণ। শুটিংয়ে দু’টো শটের মাঝখানে খানিকটা সময়। তখনই বলে ফেলেন সব্যসাচী: আমিও ফেলুদার ফ্যান। জিন্স-এর ওপর পাঞ্জাবি এরকম ক্যাজুয়াল পোশাকে যে গোয়েন্দাগিরি করতে পারে আমি তার ফ্যান।
সেই ফুরফুরে দুপুরে অজানা জঙ্গল দেখতে দেখতে সব্যসাচীর সঙ্গে নিরিবিলি কথাবার্তায় জেনে নিতে থাকি আর কী কী কারণে তিনি ফেলুদার ফ্যান: ‘সত্তর দশকে যখন বয়ঃসন্ধি পার হচ্ছি, ফেলুদা আমাদের কাছে অনেকটা আইডিয়াল টিচার-এর মতো। অসম্ভব পাওয়ারফুল, অথচ ডাজ্ন্ট ডিসপ্লে হিজ পাওয়ার। কী লো প্রোফাইল, কখনও নিজের পাবলিসিটি চায় না। সকলের সঙ্গে মেশে, কিন্তু কারওর সঙ্গেই বেশি কথা বলে না।’ বলতে বলতেই মোক্ষম কারণটায় চলে আসেন রয়েল বেঙ্গল রহস্য-র ফেলুদা: ‘বেড়াতে ভালবাসি বলেই বোধহয় আরও ভাল লাগে ফেলুদাকে। যেখানে যাচ্ছে, সেই জায়গাটা সম্পর্কে কী চমৎকার হোমওয়ার্ক! আবার কী অর্গানাইজড... সোনার কেল্লা ছবিটা মনে করুন একবার...যেখানে যাবে, সেখানকার ওয়েদার, কী কী পোশাক নিতে হবে, কবে রেলের বুকিং করতে হবে, তোপসের সঙ্গে কথার ফাঁকে ফাঁকেই সে সব হিসেব করতে থাকে। তারপর ট্রেনে বা সার্কিট হাউসে নিপুণ ভাবে প্যাকিং খোলে, ব্যাগ গুছোয়...। রয়েল বেঙ্গল রহস্য-এও জঙ্গলটা আছে বলেই বোধহয় এত আনন্দ পাচ্ছি কাজ করায়!’
|
৪ |
গোগোল আমার বন্ধুর ছেলে, বয়স এগারো, ওর মা-র কাছে শুনেছি ছ’বছর বয়সে ও প্রথম সোনার কেল্লা দেখে। দেখার পর থেকে মাঝে মাঝেই স্বগতোক্তির মতো ও সোনার কেল্লা-র সংলাপ বলে, যেন সত্যজিতের সঙ্গে দেয়ালা করে, গোটা ছবিটার প্রায় সব সংলাপই ওর মুখস্থ। সে দিন রোববার শীতের দুপুরে দেখা হতেই সোনার কেল্লা-র সংলাপ শুনিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করে: রয়েল বেঙ্গল রহস্য দেখবে না? বলি: নিশ্চয়ই দেখব। গোগোলের বাবা, আমার বন্ধু হাসে, বুড়ো হতে চললি, ছেলেমানুষি গেল না? আমি মুকুলের মতো গম্ভীর হয়ে যাই, তার পর বলি: আমি তো বড় হইনি!
|
|
|
|
|
|