পাশের ছবিটি দেখিয়া মূর্ছিত হইবার কারণ নাই। নিছকই একটি সিনেমার প্রচারচিত্র, সত্যই প্রলয়পয়োধিজল এমন ফুঁসিয়া উঠে নাই। রিও শহরের সেই বিশ্রুত যিশু, ‘ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার’-ও দিব্য বিদ্যমান। সভ্যতায় নানাবিধ সংকট চলিতেছে বটে, কিন্তু এন্তেকালটি নিতান্ত সমাগত, এমন কালান্তক বার্তা কি আসিয়াছে? রোনাল্ড এমেরিচ প্রতিবাদ করিবেন। মুচকি হাসিয়া বলিবেন, আসিয়াছে। সেই দুই হাজার নয়েই বলিয়াছিলাম, দুই হাজার বারো-তেই ইতি। ভদ্রলোক জাতিতে জার্মান, করিয়া খান মার্কিন মুলুকে। হলিউড-এ। তিনি পরিচালক। ছবি করেন। প্রিয়তম বিষয়, প্রলয়। কত রকম উপায়ে পৃথিবী উৎসন্নে যাইতে পারে (এবং, হলিউড তাহাকে রক্ষা করিতে পারে), সেই বিষয়ে তিনি সমধিক জ্ঞানবান। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটি ছবিতে এমন ধ্বংসের বিবরণী পেশ করিয়াছেন। সেই ধারাতেই এই ছবিটির আগমন। দুই সহস্র বারো।
কিন্তু, আর সব ছাড়িয়া কেনই বা দুই সহস্র বারো? এমেরিচ-এর সিনেমায় বিবিধ তাত্ত্বিক অবতারণা আছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নাসিকা কুঞ্চন করিয়াছেন। তাহাতে কী? জনতা স্ফীতচক্ষু হইয়া শুনিয়াছে ‘মেসোঅ্যামেরিকান লং কাউন্ট ক্যালেন্ডার’ এবং মায়া সভ্যতা-র বৃত্তান্ত। পরিভাষায় যাহার নাম ‘টু থাউজ্যান্ড ওয়ান টু ফেনোমেনন’। সেই আখ্যান বলিতেছে, পাঁচ হাজার একশত পঁচিশ বৎসরের একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হইবে যে দিন, সেই দিনটি চলতি গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার মতে দুই হাজার বারো খ্রিস্টাব্দের একুশ ডিসেম্বর। সুতরাং, এমেরিচ একটি আস্ত সিনেমা বানাইয়া যেন বলিতে চাহিয়াছেন, মনে করো, শেষের সে দিন ভয়ংকর...! শুনিয়া ব্রিস্টলে কবরের ভিতর রাজা রামমোহন রায় নড়িয়া উঠিলেন কি? গানখানি তাঁহারই রচনা। অবশ্য শেষের সে দিন লইয়া জনমনে কৌতূহল বিস্তর। রহস্য যেমন, রোমাঞ্চও তেমনই। যে কালবৃত্তটি এই বৎসরের একুশে ডিসেম্বর ফুরাইবে বলিয়া ধারণা, তাহা প্রকৃতপক্ষে মেসোআমেরিকান যুগ ‘বা’ক-তুন’-এর অন্ত সূচিত করে। তাহার পর কী? তখনই বা কী হইবে? গণমনে বারংবার ভাসিয়া উঠে প্রলয়ের ছবি। সব শেষ হইয়া গিয়াছে। প্রাণের চিহ্নমাত্র নাই। ‘উদাস শান্তি করিতেছে দান চিরমানবের প্রাণে’ বলিয়া মৃতদেহে ভারাক্রান্ত কুরুক্ষেত্রের ধারে বসিয়া থাকিবার মতো কোনও কবিও নাই। অস্যার্থ, পরিবর্তন যেন না হয়। যাহা চলিতেছে, চলিতে থাকুক। হাজার গাল পাড়ি, পীড়িত হই, পীড়া দিই অন্যকে, ক্ষতি নাই। পশ্চিমবঙ্গীয়গণ এই গড্ডল প্রবাহে আক্রান্ত বটে, কিন্তু তাঁহারা পরিবর্তন চাহেন না, অন্তত দুই হাজার এগারোর পরে তাহা আর বলা চলিবে না। পরিবর্তনই এক্ষণে বঙ্গভূমে সেই চাবি-শব্দ, যাহার প্রতাপে দীর্ঘকাল বন্ধ একটি দ্বার খুলিয়া গিয়াছে। আশা, পরিবর্তনের আরও নানা ইতিবাচক দিগন্তের প্রতি বঙ্গজগণের আগ্রহ বাড়িবে। ইতিমধ্যে নূতন বৎসর। এই সূর্যকরে, এই পুষ্পিত কাননে হৃদয় বিমল হউক। পৃথিবী চলিতে থাকুক। |