লোকপাল বিল উপলক্ষ মাত্র। লোকায়ুক্ত গঠনে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের বিষয়কে সামনে রেখে রাজ্যের অধিকারের প্রশ্নে সর্বভারতীয় রাজনীতির মহানায়িকা হয়ে উঠেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আঞ্চলিক দলগুলির মুখ্যমন্ত্রীরা তো বটেই, মমতার ‘আন্দোলনকে’ সমর্থন জানিয়েছেন জাতীয় দলগুলির মুখ্যমন্ত্রীরাও।
কেন্দ্রে লোকপাল গঠনের বিলে রাজ্যে লোকায়ুক্ত গড়ার বিষয়টি আনা চলবে না, রাজ্যসভায় এই মর্মে সংশোধনী এনে কার্যত গোটা দেশে তোলপাড় ফেলে দিয়েছেন মমতা। কলকাতায় বসেও তিনি যে জাতীয় রাজনীতির নির্ণায়ক শক্তি, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর প্রতিবাদ যে শুধু লোকায়ুক্তেই সীমাবদ্ধ নয়, তা-ও স্পষ্ট করে দিচ্ছেন মমতা। তাঁর কথায়, “মানুষের শরীরে রক্ত সংবহন হওয়া জরুরি। শুধু হৃদ্পিণ্ডে রক্ত জমে থাকলে চলবে? ঠিক তেমনই দিল্লিতে ক্ষমতাকে জমিয়ে রাখলে দেশের গণতন্ত্র
বিপন্ন হবে।” বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায় বলেন, “লোকপাল একটি বিচ্ছিন্ন বিষয়। আসলে কেন্দ্র ও রাজ্যের পারস্পরিক সম্পর্কেরও পূর্ণ মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রাখা অনুচিত। রাজ্যের অধিকার স্বীকার করা প্রয়োজন।”
মমতার এই অবস্থানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছেন জেডি (ইউ) মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার থেকে শুরু করে গুজরাতের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এমনকী কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী রাজস্থানের অশোক গহলৌত বা মহারাষ্ট্রের পৃথ্বীরাজ চহ্বাণও বলছেন, এটা কোনও দলীয় সঙ্কীর্ণ বিষয় নয়। ভারতের শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্রীয় ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা প্রয়োজন।
এটা স্পষ্ট যে, রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবিতে আন্দোলন গড়ে মমতা ধীরে ধীরে দেশের অন্য মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে নিজস্ব নেতৃত্বের পরিসর গড়ে তুলতে চাইছেন। তৃণমূল সূত্রে জানা যাচ্ছে, ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক থেকে উত্তরপ্রদেশের মায়াবতী যোগাযোগ রাখছেন মমতার সঙ্গে। যোগাযোগ করেছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা, অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডুও। ক্রমে আঞ্চলিক দলগুলির সাধারণ যোগসূত্রে পরিণত হচ্ছেন মমতা। তাঁকে সামনে রেখে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে আঞ্চলিক দলগুলির একটি মঞ্চ গঠনের প্রয়াসও শুরু করে দিতে চাইছেন কেউ কেউ।
অতীতে আঞ্চলিক দলগুলিকে একজোট করার এই কাজটি করত বামেরা। মাসুল সমীকরণ নীতি থেকে শুরু করে সরকারিয়া কমিশন একাধিক বিষয়ে কেন্দ্র-বিরোধী আন্দোলন করেছে সিপিএম। ‘কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণ’-এর স্লোগান জ্যোতি বসুকে যথেষ্ট জনপ্রিয়ও করেছিল। মমতা কি বামেদের সেই পরিসরটা দখল করতে চাইছেন? এই প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কমিউনিস্টদের পরিসর দখল করার প্রয়োজন কোথায়? ওঁরা তো গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করেন না। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাও তো একনায়কতন্ত্র। এক দলীয় শাসন। বহুত্ববাদ, যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র হল কমিউনিস্টদের কাছে গ্রিক-হিব্রু। ওঁদের অভিধানে বিকেন্দ্রীকরণ নেই।”
মমতার এই বক্তব্যকে সমর্থন করেন ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহও। তাঁর মতে, সিপিএম স্তালিন-বাদী দল হওয়ার কারণে মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত ঘুরেফিরে একনায়কতন্ত্রেই গিয়ে পৌঁছয়। সাবেক সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধানে রাজ্যগুলির পৃথক হওয়ার অধিকার থাকলেও বাস্তবে সবটাই ছিল কেন্দ্রীভূত। সিপিএমের দলীয় কাঠামোর ক্ষেত্রেও এটা সত্য। আর নীতিগত প্রশ্নে এই ‘ফাঁকিবাজি’টা থাকার কারণে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষায় তাদের লড়াইটা আখেরে সফল হয়নি।
সিপিএম অবশ্য রাজ্যের অধিকারের প্রশ্নে মমতার অবস্থানকেই কটাক্ষ করছে। দলের নেতা নীলোৎপল বসু বলেন, “মমতা যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন, তখন তিনিই রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারি করার পক্ষে ছিলেন। আর আজ ভূতের মুখে রাম নাম!” যার পাল্টা মমতার বক্তব্য, “রাজ্যে সিপিএম গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিল। কিন্তু মা-মাটি-মানুষ রাজ্যে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছে। রাজ্যকে উপেক্ষা করে কেন্দ্র যদি লোকায়ুক্ত ঠিক করে দেয়, তবে সেটা ৩৫৬ ধারা জারি করার থেকেও ভয়ঙ্কর হবে। তাই রাজ্যের অধিকারের আন্দোলন কোনও দলীয় রাজনীতির বিষয় নয়। এ আন্দোলন এ দেশে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য রক্ষার আন্দোলন।”
মমতা রাজ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বললেও, অনেকে আবার কয়েক ধাপ এগিয়ে বলছেন, আদর্শ ব্যবস্থা হল কেন্দ্রে কোনও সরকারেরই প্রয়োজন নেই। রাজ্য সরকারগুলিই দেশ চালাক। শুধু প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য একটা কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা থাকুক। কেন্দ্রের বদলে রাজ্যগুলি কর সংগ্রহ করুক। মমতা অবশ্য বলছেন, “কেন্দ্রকে অবলুপ্ত করতে চাই না। কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্য সুষ্ঠু সাংবিধানিক সম্পর্ক তখনই হতে পারে, যখন রাজ্যের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।”
দেশের দুই প্রধান জাতীয় দল কংগ্রেস এবং বিজেপি কিন্তু দাবি করছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষায় তারা যথেষ্ট যত্নবান। লোকায়ুক্ত প্রশ্নে মমতার পাশে দাঁড়ানো বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী ও অরুণ জেটলির বক্তব্য, বিজেপি-ই প্রথম রাজ্য তথা আঞ্চলিক দলগুলিকে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছে। জেটলির কথায়, “কংগ্রেসের আচরণের মধ্যে একটা জমিদারি আছে। কিন্তু আমরাই প্রথম আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে জোট করেছি। ছোট রাজ্য গঠন করেছি। আমরা মনে করি, রাজ্য শক্তিশালী হলে কেন্দ্র দুর্বল হয়ে পড়বে, এটা ঠিক নয়।”
বিজেপি-র এই দাবি উড়িয়ে কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেন, “আঞ্চলিক দলগুলিকে প্রাধান্য দেওয়াটা ছিল বিজেপি-র রাজনৈতিক কৌশল। তা না হলে ওরা ক্ষমতায় আসতে পারত না। কিন্তু কংগ্রেস ঐতিহ্যগত ভাবেই আঞ্চলিক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করেছে। বহুত্ববাদকে মর্যাদা দিয়েছে বলেই কংগ্রেস জাতীয় দল হয়ে উঠতে পেরেছে।”
কিন্তু এই দাবি কি ঐতিহাসিক সত্য? তা হলে কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই কামরাজ থেকে বিধানচন্দ্র রায় আঞ্চলিক চাহিদার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন কেন? আঞ্চলিক রাজনীতির অন্যতম বর্ণময় চরিত্র বিজু পট্টনায়ক কংগ্রেস ছেড়ে নিজের দল গড়ে জাতীয় রাজনীতির নির্ণায়ক শক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁরা কখনও সফল হয়েছেন, কখনও ব্যর্থ। কিন্তু তাঁদের দেখানো পথেই কি এ বার হাঁটতে চাইছেন মমতা? |