লোকপাল বিল নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যসভায় সংশোধনী প্রত্যাহার না করায় কংগ্রেস হাইকম্যান্ড ক্ষুব্ধ ঠিকই, কিন্তু তৃণমূল যাতে জোট ছেড়ে চলে না যায় সেটা নিশ্চিত করাই এখন লক্ষ্য কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের মেয়াদ ফুরোতে এখনও আড়াই বছর বাকি। তার আগে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে উত্তরপ্রদেশে ভোটের পরে শরিকি-সমীকরণে কিছু রদবদল হতেই পারে। সমাজবাদী পার্টি নেতা মুলায়ম সিংহ যাদব হয়তো কংগ্রেসের সঙ্গে আসতেও পারেন। কিন্তু কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য, তা হলেও মমতাকে সঙ্গে রেখেই এগোতে হবে।
কংগ্রেসের একটি মহলের আশঙ্কা, ওড়িশায় নবীন পট্টনায়ক যে ভাবে বিজেপি-কে ত্যাগ করেছিলেন, মমতার ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটতে পারে। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন প্রশ্নে মমতার মতের অমিল যেমন আছে, তেমনই প্রদেশ কংগ্রেসের কিছু নেতার আচরণে তিনি ক্ষুব্ধ। কিন্তু মমতা জোট ছেড়ে চলে যান, সেটা কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের কাছে মোটেই কাম্য নয়। তাঁরা বরং মমতাকে বোঝাতে চান যে, স্বাধীন অস্তিত্বের স্বার্থে কিছু কর্মসূচি এবং ‘নিয়ন্ত্রিত বিরোধিতা’ করতেই হবে রাজ্য কংগ্রেসকে। তার জেরে কেন্দ্রীয় স্তরে সমন্বয় মুছে ফেলার প্রশ্ন নেই। দীপা দাশমুন্সি বা অধীর চৌধুরীর মতো নেতারা অবশ্য বলে আসছেন, মেরামতির চেষ্টা যতই করা হোক না কেন, সম্পর্ক ছিন্ন হবেই! এবং ‘যথাসময়ে’ তা করবেন মমতাই। কংগ্রেসের একাংশের প্রশ্ন, তবে কি সে ভাবেই প্রস্তুত হওয়া উচিত? সনিয়া গাঁধীর নির্দেশ, একেবারেই তা নয়। বরং এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে যাতে মমতাকে সঙ্গে রাখা যায়। |
বর্ষশেষে মমতা। মহাকরণে অশোক মজুমদারের তোলা ছবি। |
সংঘাত এবং সমন্বয় সঙ্গী করেই দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক রাজ্য শাসন করেছে বামফ্রন্ট। বিধানসভা ভোটে হারের পরে পারস্পরিক উষ্মা সত্ত্বেও সেই জোট অটুট। তৃণমূলের সঙ্গে জোটের বিষয়টিও কংগ্রেস সে ভাবেই দেখতে চাইছে। তবে দলের ‘ম্যানেজার’দের এই মুন্সিয়ানায় যে ঘাটতি রয়ে গিয়েছে, ঘরোয়া ভাবে তা-ও স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে এখন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা শুরু করেছে কংগ্রেস। আজ সনিয়া গাঁধী, মনমোহন সিংহ, প্রণব মুখোপাধ্যায়, সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি বৈঠকে বসেন। শীর্ষ নেতারা একমত, কোথাও একটা গলদ রয়েছে। কংগ্রেসের একটি অংশ রাজ্যসভার ঘটনার জন্য মমতাকে একতরফা দায়ী করলেও সনিয়া-মনমোহন দলের দায়িত্ব এড়াতে চাইছেন না। বরং জোট অটুট রেখে ভবিষ্যতের দিকে এগোনোরই পক্ষপাতী তাঁরা। রাজনৈতিক শিবিরের মত, জমিদারি মনোভাব বর্জন করে জোটমন্ত্রকেই আত্মীকরণ করতে হবে। সে জন্য মমতার মন বোঝা আশু প্রয়োজন।
কংগ্রেস সম্পর্কে মমতার অন্যতম গুরুতর অভিযোগ হল, দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের মেয়াদের অর্ধেক শেষ হয়ে গেলেও শরিকদের সঙ্গে আলোচনার কোনও বিধিবদ্ধ ব্যবস্থাই তৈরি হল না। কোনও সমন্বয় কমিটি নেই। নেই ন্যূনতম অভিন্ন কর্মসূচিও। সরকার চলছে ‘কেস টু কেস’ ভিত্তিতে। তৃণমূলের সংসদীয় নেতা মুকুল রায়ের বক্তব্য, “কংগ্রেস যখন আমাদের সঙ্গে আলোচনার কোনও ব্যবস্থাই তৈরি করেনি, তখন আমরা কেন আগ বাড়িয়ে তাদের সব কাজে মুচলেকা দিতে যাব?”
এই দিকটি নিয়েই সরকার চিন্তিত। প্রণববাবুর উপর প্রশাসনিক কাজের চাপ ক্রমশ বাড়ছে। অর্থ মন্ত্রক, অসংখ্য মন্ত্রিগোষ্ঠী, এবং হাজারো অভ্যন্তরীণ রাজনীতি তাঁকে সামলাতে হয়। তার উপরে রয়েছে লোকসভার নেতা হিসেবে বিরাট দায়িত্ব। এই অবস্থায় প্রয়োজন এমন এক জনের, যিনি প্রতিদিন নিয়ম করে মমতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। তাঁর চাহিদা, মতামত এবং মনোভাবের খবর নেবেন। এক কথায়, কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মমতার সেতু বাঁধার কাজটি করে যাবেন রুটিন ভিত্তিতে। জমি বিল পাশ করানোর সময় যে কাজটি করেছিলেন জয়রাম রমেশ।
সনিয়া মনে করেন, মমতা কোনও বিষয়ে এতটুকুও নমনীয় হবেন না, এমন নয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রের বক্তব্য কূটনীতিতে যেমন ‘ট্র্যাক টু’-র প্রয়োজন রয়েছে, তেমনই জোট সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও ‘ট্র্যাক টু’ অতীব কার্যকর। তার জন্য প্রয়োজন এমন এক জনের যিনি তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করে কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে একটি সহজ রাজনৈতিক বাতাবরণ গড়তে পারেন। তিস্তা চুক্তির সময় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননকে মমতার কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু পরিণামে গোটা বিষয়টি জট পাকিয়ে যায়। তার পর থেকে তিস্তা নিয়ে মমতার সঙ্গে কথা বলার প্রশ্নে কার্যত নিশ্চেষ্ট সাউথ ব্লক। কংগ্রেসের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, দক্ষিণে জয়ললিতার সঙ্গে চিদম্বরমের সংঘাত সুবিদিত। ফলে জয়ললিতার সঙ্গে দর কষাকষির ক্ষেত্রে কেন্দ্র যেমন চিদম্বরমকে পাঠাবে না, তেমনই মমতার সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রেও এমন কাউকে পাঠানো চলবে না, যাতে হিতে বিপরীত হয়।
সনিয়া-মনমোহন এত দিনে আর একটি বিষয়ও স্পষ্ট বুঝেছেন যে, মমতার সিদ্ধান্তই তৃণমূলে শেষ কথা। ফলে সর্বদলীয় বৈঠকে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বুঝিয়ে বা মন্ত্রিসভায় দীনেশ ত্রিবেদীর সঙ্গে আলোচনা করে কোনও লাভ নেই। উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর বদলে সতীশ মিশ্রের সঙ্গে আলোচনা করে যেমন কোনও লাভ নেই, পশ্চিমবঙ্গেও ঠিক তাই। তৃণমূল মানে মমতা এবং তাঁর সঙ্গে সব ব্যাপারে আগে থেকে কৌশলগত আলোচনা সেরে রাখা উচিত। |