চুল পাকুক না পাকুক, আজ হসন্ত!
সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে আসছে স্মৃতি। বাইরের দরজায়, কলিং বেলে আঙুল চেপে দাঁড়িয়ে কন্দর্পকান্তি যৌবন। উল্টো দিকের রকে বসা বেকার ছোকরা। বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে কড়া নজর রাখছে ঘটমান বর্তমানের দিকে। স্মৃতি তার বুকের পাঁজর, যৌবন ভাগ্যবান গানের মাস্টার! মেগাসিরিয়াল যৌবনস্মৃতি! ব্লকব্লাস্টার! বাঙালিকে পায় কে! গা-হাত-পা ছেড়ে সোফায় বসে রোমন্থন। দু’হাতে ডাম্বেল তুলে এক্সারসাইজ করার কষ্ট কে নেবে বাছা! দু’চোখে স্মৃতির ডোরবেল ঘণ্টি বাজাও, পর্দা উঠুক, সিরিয়াল শুরু হোক।
যৌবনের সংজ্ঞাটি বড় গোলমেলে। এমনিতে সময়টা ধাঁ করে কেটে যায়, রেখে যায় শুধু বাকি জীবনে আক্ষেপ করার অবসর। কিন্তু একটু গুগ্লিয়ে দেখুন। যৌবনের হিসেব হ-য-ব-র-ল’কেও হার মানাবে। রাষ্ট্রপুঞ্জ আর বিশ্বব্যাঙ্ক নিয়ম বানিয়েছে যে, যৌবনের দৌড় হল পনেরো থেকে চব্বিশ। ডেনমার্ক সেটাকে টেনে নিয়ে গিয়েছে চৌত্রিশে। আবার মরক্কোর লোকসভা দাবি জানাচ্ছে, চল্লিশ বছর বয়স অবধি সে দেশের সবাই যুবক। জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালি বেশি অপশন দেখলে ঘাবড়ে যায়। তাই আমাদের যৌবন মাপা হয় হাঁটুর বয়স দিয়ে! শুনেছি, এ কথা পুরাণেও লেখা আছে (বিশ্বাস না হলে ঘেঁটে দেখে নিতে পারেন)! যে দিন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বাঁ-হাঁটুতে খচ্, সে দিন থেকেই আপনার যৌবনের ইতি। তা সে চুল পাকুক না পাকুক, আজ হসন্ত! তবে এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আপনার কালো চুল বা পাকা চুল বা পরচুলের নীচে যে খুলি এবং তার মধ্যে সযত্নে রক্ষিত যে ব্রেন, তার চড়াই-উতরাই সামলে সযত্নে পাতা হয়েছে স্মৃতির রেল লাইন, ছুটে যাচ্ছে যৌবনের ট্রেন। চেপে বসুন। দু’মিনিটে হাওয়া হাঁটুর খচ্! উল্লাসে গলায় ঢালুন ইমপোর্টেড স্কচ।
পূর্ণবয়স্ক মানুষের (মূলত বাঙালির, কারণ বাঙালি এক বিশেষ ধরনের মানুষ) জীবনকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায় জন্ম থেকে যৌবনের আগে পর্যন্ত, যৌবন এবং বাকি জীবন (বার্ধক্য বললে অনেকে রাগ করবেন)। এর মধ্যে আবার বাঙালির যৌবন বেজায় ক্ষণস্থায়ী। কলেজের শেষ বছর, ইউনিভার্সিটি, হাত ধরলাম, তুমি ইন্টু আমি ইজ ইকোয়ালটু মিন্টু, ল্যাং, আবার ইন্টু, চাকরি... ফুস্। হসন্ত। তবে কিনা ছবিখানি থুড়ি ভিডিয়োটি ফ্রেমে বাঁধা রয়ে গেল। এই স্মৃতির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে, সাত পাক ঘোর ঘোর স্ট্যাচু খেলে এমন মাখো মাখো রেসিপি বানিয়েছি যে অফিসের চেয়ার, পার্কের বেঞ্চ, গাড়ির সিট বা বাড়ির সোফায় বসে একটু ঢুলতে থাকলেই তার স্বাদ-গন্ধে মন আনচান।
এক সাইকোলজিস্টের কথা মনে ধরল। সটান প্রশ্ন করি ভাই, শৈশবটৈশব তো কিছু মনে পড়ে না! আপদে বিপদে চোখ বন্ধ করে হরি’কে ডাকতে গেলেই হরিণ শিশু দেখতে পাচ্ছি। ও পারে শকুন্তলা, এ পারে আমি। স্মৃতিভ্রংশ হল নাকি? উনি বললেন, ইহাই ন্যাচরাল! দেখ বাপু, ছোটবেলা থেকে যৌবন পর্যন্ত তুমি-আমি যা করেছি, সব এক। অন্যের কথায় উঠেছি, বসেছি, নেচেছি, হেঁচেছি। কোমরে ঘুন্সি পরেছি, বাঁ-দিকে টেরি কেটেছি, কানমলা খেয়েছি আর তেঁতুলের আচার, টেস্ট পরীক্ষার আগে রাতে আলো জ্বেলে পড়ার নাম করে বেমালুম ঘুমিয়েছি, আবার সকালে উঠে উল্টো দিকের বাড়ির জানলায় জুলজুল তাকিয়েছি। ব্রেন কি এই সব আবর্জনা ধরে রাখে? দরকার মতো অন্যের থেকে টুকে নিলেই হল! আসল মাস্তানি শুরু যৌবনে। যা করবে পাথরে খোদাই। তখন থেকেই ব্রেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। জানে, কিছু দিন পরেই আপশোসের বড়া আর টক আঙুর খেয়ে থাকতে হবে বাপধনকে, তাই লাভের গুড় স্টক করে রাখ! হাত, পা, ঘাড়, কলজে ঢিলে হয়ে গেলে তারিয়ে তারিয়ে খাও। আমাদের পিতামহ, প্রপিতামহ সরকারি আফিম মেরে ঝিম হয়ে যৌবনের স্মৃতি হাতড়াতেন আর তুমি-আমি বেসরকারি স্কচ টেনে বুঁদ হয়ে স্মৃতির যৌবন হাতড়াই। এই যা তফাত! বোঝা গেল।
গত দশ বছরে স্কুলের বন্ধুদের ঠেকে এই অ্যানালিসিস বারে বারে প্রমাণিত। এক টুকরো চিকেন, এক গণ্ডুষ অশুদ্ধ জল আর এক চামচ জেলুসিল পেটে পড়েছে কি পড়েনি, যৌবন বেরিয়ে পড়ল কলেজের বারো নম্বর ঘর থেকে, লন পেরিয়ে, পাঁচিল টপকে হেদুয়া, আড়চোখে বেথুন, ট্রাম লাইন, কলেজ স্কোয়্যার, পার্ক স্ট্রিট, চেলো কাবাব। প্রত্যেক বছর এক চরিত্র, এক গল্প, এক হুল্লোড় (মাঝে মাঝে একটু চোখ ছলছল)। অথচ পুরনো হয় না। অধরা মাধুরী হেঁটে যাচ্ছেন কলেজের চৌকাঠ ডিঙিয়ে অচেনা রাস্তায়। বউদির চায়ের দোকানে বসে আবাল-বৃদ্ধ (অর্থাৎ ফার্স্ট-থার্ড ইয়ার) পল্টন এক মনে দেখছে সেই হন্টন। এই ক্যাটওয়াক-এর নামকরণ হল বাইশ-চব্বিশ! যেন দু’টো বন্ধনী। যৌবন আটকা পড়ল এই নামে।
কিছু দিন আগে স্কুলের রি-ইউনিয়নে আমাদের অতি প্রিয় ক্লাস টিচারের সঙ্গে দেখা। বহু দিন পর। বয়স হয়েছে, কিন্তু পরিচয় দিতেই আমাদের নাম ধরে একের পর এক ঘটনা বলতে আরম্ভ করলেন। আমাদের কান লাল, মাথা হেঁট, মুখে লাজুক হাসি। মাস্টারমশাই থামতেই চান না। আমরা আর চাইছি না ওই লালুভুলু স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু কী আর করা। আমাদের কৈশোর তো ওনার যৌবন। স্মৃতিচারণ আটকাবে কে। এই বৈপরীত্যই আমাদের সঞ্জীবনী বুস্টার ডোজ।
কবি, সাহিত্যিক, আঁতেল সম্প্রদায় জীবনের বেশির ভাগ সময়ই যৌবন হাতড়ে বেড়ান এবং সুযোগ পেলেই আঁকড়ে ধরেন। সে রবীন্দ্রনাথই বলুন বা ইয়েট্স। রবিবাবু যে লাইনে যৌবন লিখেছেন ঠিক তার পরের লাইনেই ‘মিলন’ শব্দটি ব্যবহার করলেন। ও দিকে ইয়েট্স সাহেব বলে দিলেন যৌবনের প্রেমের কপালে লেখা অকালমৃত্যু! ল্যারির কথা মনে পড়ে গেল। পঞ্চাশোর্ধ্ব সুঠাম শরীর। মার্কিন মুলুকে আমরা এক সঙ্গে কাজ করেছি কয়েক বছর। নিউইয়র্কের ঠিক বাইরে ল্যারির ফার্মহাউস। বিশাল বাংলো। হোম অফিস। সুইমিং পুল। ড্রইংরুমে ভিডিয়ো প্রজেকশন। আর একটি ল্যাব্রাডর। ল্যারির পাকা চুল, গোঁফ-দাড়ি। চক্চকে স্যুট চাপিয়ে, চুলে জেল লাগিয়ে নিত্য অফিস আগমন। আমরা উত্ত্যক্ত করি বিয়ে করোনি কেন, রাতে ক’বার ঘুম ভাঙে ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই ল্যারি এক দিন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাদের একটি প্রেজেন্টেশন দেখাল। কুড়ি থেকে চল্লিশের মধ্যে ল্যারির চার বার বিয়ে! স্লাইডের পর স্লাইড সেই চার স্ত্রীর ছবির কোলাজ, নানা বিভঙ্গ। সঙ্গে ল্যারির ভাষ্য তুলনামূলক ভার্যাতত্ত্ব! কিছু কিছু ছবিতে যৌবনরহস্য সম্পূর্ণ উদ্ঘাটিত! আমরা চোখ গোল, মুখ হাঁ হা হতোস্মি! প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেওয়াল জোড়া স্ক্রিনে ল্যারি এই যৌবন-স্মৃতি সিরিয়াল দেখে, দু’পেয়ালা পান করে, ল্যাব্রাডরের ঘাড় চুলকে দিয়ে সুখস্বপ্নে নিমজ্জিত হয়। আর আমরা, জনাতিনেক বঙ্গসন্তান, হাতে হাঁটু ধরে অমোঘ ভবিতব্যের দিকে অগ্রসর হই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.