|
|
|
|
তবু চোখে তার নিত্য আনাগোনা |
একটা তারার আলো পৃথিবীতে পৌঁছতে সময় নিল ৬৫ মিলিয়ন বছর। হয়তো তারাটা মহাকাশে আর নেই,
কিন্তু আমাদের আকাশে এখনও মিটমিট। মানে, তারা নেই, আলো আছে। অনির্বাণ ভট্টাচার্য |
একটা রাত, একটা আকাশ আর একটা লোক। লোকটার কেউ নেই। ও শুধু বসে আকাশ দেখে। আজও দেখছে, হাঁ করে। ওকে সেই পর দিন সকালের আগে কেউ খুঁজে পাবে না আর। খুঁজে পাবে একমাত্র একটা ফাঁকা মাঠ। মাঠের সামনেটা ধু ধু, অনেক ক্ষণ ধরে কিচ্ছু নেই। একটা ক্রমবর্ধমান শূন্য শুধু। যেখানে শেষের খোঁজ বৃথা। আর পিছন ফিরলে, ভেসে যায় ফুটকি সব হেডলাইট, বাড়ি ফেরা পিঁপড়ের সারি। ওই সব হেডলাইটের আওয়াজ, এ সংসারে আসে না। শুধু আলো আসে। একগাদা তারার আলো। এমনি লোকে পাত্তা দেয় না, বলে একটা তারা নাকি অন্যটার ডুপ্লিকেট মাত্র। এই লোকটার অবশ্য ও ভুল ধারণা নেই। ও জনে জনে চেনে সব্বাইকে, নাম না জানলে কী? লোকটা আজ অপেক্ষা করছে একটা নতুন তারার। যে নাকি পৃথিবীর থেকে ৬৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে।
৬৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ খুব দূর, না? দূর মানে, সেই তারা থেকে নিঃসৃত আলো পৃথিবীতে পৌঁছতে নিল ৬৫ মিলিয়ন বছর। এক মূক অনন্ত চিরে, এই ৬৫ মিলিয়ন বছরের যাত্রা শেষ হবে যেই মাত্র, তখনই লোকটা আকাশে ওর অপেক্ষার তারাকে দেখতে পাবে। একটা নতুন তারার জন্ম হবে। ও মা! সে কী কথা? ওই তারার জন্ম তো সেই ৬৫ মিলিয়ন বছর আগেই হয়ে গিয়েছিল, আর সেখান থেকেই তো এই আলো আসছে। তা হলে, এখন আবার কীসের জন্ম?
জন্ম আমাদের চোখে। এত বছর ধরে একটা জিনিসের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু আমাদের চোখে সেটা ধরা পড়েনি। অন্য কেউ বললেও নির্ঘাত বিশ্বাস করতাম না। তার মানে তো হতে পারে না, যে সে ছিল না। সে ছিল, আমরা ধরতে অক্ষম হয়েছি। ফলে যে দিন তাকে প্রথম ধরলাম, বিশ্বাস করলাম, সেই ক্ষণ থেকেই আমরা তার জন্মতিথি গণনা করলাম। কিন্তু হিসেব অনুযায়ী এই তিথি তো ভুল। আবার আমরাও তো ভুল নই। |
|
তা হলে লোকটা আজ থেকে যে তারাটিকে দেখবে, সেটা কি এক রকম ছলনা? মিথ্যে? তা তো এক্কেবারেই নয়। সে যা দেখছে, তা সত্যি। কিন্তু একটু মাত্র সাড়ে ছ’কোটি বছর পিছিয়ে থাকা সত্যি। মানে ওটি তারার বর্তমান অবস্থা নয়। পুরনো এক অবস্থা। অনেকটা খেলার ডেফার্ড টেলিকাস্ট বা পিছিয়ে-যাওয়া সম্প্রচারের মতো। যা ঘটে গিয়েছে, তা আমি দেখতে পেলাম কিছু সময় পর। কিন্তু দেখতে পেলাম হুবহু সত্যিটাই। এখানে কোনও খটকা নেই। পুরো বিষয়টা ফের গুলিয়ে যায়, যখন ভাবি আর এক কথা। যদ্দিনে ওই তারার আলো পৃথিবী পৌঁছলো, তদ্দিনে তারাটি যদি মরেই গিয়ে থাকে?
তা তো হতেই পারে, হচ্ছেও অহরহ। তখন? তখন একটি তারা আসলে মরে গিয়েও, বেঁচে থাকবে অন্য কোনও জায়গায়। সেই ‘অন্য কোনও জায়গা’ আমাদের দৃষ্টিতে আটকে রয়েছে। এক রকম স্মৃতির বাঁচা। যে স্মৃতি খুব খুব জ্যান্ত। মানে কেউ শেষ হয়ে গিয়েও শেষ হচ্ছে না। সেটাই কি ‘অল্টারনেট রিয়্যালিটি’? অন্য-বাস্তব?
ওই লোকটা অতশত বুঝবে না, কিন্তু এইটুকু অনুভব করবে যে, ‘সময়’ আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। ‘এখন’-এর সংজ্ঞাটাই গুলিয়ে ছেড়েছে। যা ওই লোকটার ‘এখন’, তা ওই তারা’র ‘এখন’ মোটেও নয়। তারার ‘এখন’ আমরা দেখতে পাব ‘খানিক পর’। সেই ‘খানিক পর’ আসতে আসতে ওই লোকটাই হয়তো আর থাকবে না, কিন্তু আকাশ তো থাকবে, আকাশে স্রেফ একটা জায়গা টুপ করে ফাঁকা হয়ে যাবে, অলক্ষ্যে। মানে যে তারা হয়তো হাজার বছর আগে শেষ হয়ে গিয়েছে, সে আমাদের চোখের সামনে এই সবে শেষ হবে। আমাদের সত্য আর তারার সত্য এক ঘাটে এসে জল খাবে।
দুই সত্যের মাঝখানের বিরাট সময়টা নিয়েই যত বিভ্রান্তি। এখানে খুব কাজ দেবে একেবারে ওই লোকটার মতো হয়ে যাওয়া। ওই লোকটা জানে, যে মহাশূন্যের বিস্তার ধরতে চাওয়া ও যাওয়া ভয়ানক এক স্পর্ধা। ওতে লাভ নেই।
মহাশূন্য অনেকটা ওই ফাঁকা মাঠের মতো, যেখানে ও বসে আছে। যতই লাফাও, সেখানে কোনও আওয়াজই ঢুকবে না। তার চেয়ে ভাল ‘সময়’-এর হাতে নিজেকে সমর্পণ করে চলতি মেরি-গো-রাউন্ড-এ উঠে পড়া। এই মহাজাগতিক হিসেবটাকে খেলা মনে করে, বেট লাগালেই হয়, ওই তারাটা সত্যি, আর ওটা বোধ হয় মিথ্যে, ওই ওইটা সত্যি, ওটা মিথ্যে। আকাশে এই মেলা’র তো কমতি নেই। ফাঁকা কোনও স্থান খুঁজে পেলেই ভেবে নেব, কাল অবধি এখানে যে তারা ছিল, তার ‘মুহূর্ত’ শেষ হয়ে গিয়েছে। কাল বা আজই হয়তো সেখানে আলাপ হবে আর এক নতুন ‘মুহূর্ত’-এর সঙ্গে। মানে আলো এসে পৌঁছবে অন্য আর এক তারা’র।
আমরা যে কেন খামখা ‘এই মুহূর্ত’-র পিছনে ছুটি, কে জানে? কারণ ‘এই মুহূতর্র্র্র্’ কোনও স্থির বিন্দু নয়, পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। অল্প অল্প করে, হয়তো আমাদের অগোচরে, পাল্টে যাচ্ছে। হয়তো, এই অল্প অল্প পাল্টে যাওয়াটা খেয়াল করি না বলেই আমাদের নিত্যতার ভরসাটা ব্যাহত হয় না। যখন বদল নজর করি, তখন সেই পাল্টে যাওয়া অবস্থাটাই আমাদের নিত্যতা। সেটাকে গ্রহণ করতে আর ভয় করে না।
তাই ভোর রাতের দিকে একটা তারাকে দরজার বাইরে রাখা মোমবাতির মতো নিভে যেতে দেখেও ভয় করে না। কারণ আর এক জন তো নিশ্চয়ই এরই মধ্যে যাত্রা শুরু করেছে। আমাদের জন্য। |
|
|
|
|
|