|
|
|
|
নটে গাছ তবু মুড়োয় না কিছুতেই |
ছোটগল্প যেন একটি ব্রহ্মাণ্ড! কিংবা ক্যালেন্ডার। শেষ হয়, আবার হয়ও না।
ফুরোয়, কিন্তু আসলে বয়ে চলে অনন্তকাল। শোভন তরফদার |
জানেন মিস্টার টেগোর, তারপর তো আমি সেখানে গেলাম। একাই গেলাম। কথাটা বলে সামান্য থামলেন নিবারণ চক্রবর্তী। তাঁর সামনে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘মিস্টার টেগোর’ সম্বোধনটি তাঁর কেমন লাগছে, জানার উপায় নেই, কিন্তু নিবারণ চক্রবর্তী মোটেই ‘গুরুদেব’ বা ‘কবিগুরু’ গোছের কিছু বলবেন না, তাই রবীন্দ্রনাথ, অন্তত সামনাসামনি, নিরুত্তাপ। বললেন, কোথায় গেলে নিবারণ?
সেই ঘরে। প্রায় পাতাল-প্রবেশের মতো, জানেন, ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে, আমাকে নামিয়ে দিয়ে লোকটা চলে গেল। বলে গেল, এখানেই আছে। অপেক্ষা করো, দেখতে পাবে।
কে? জিজ্ঞেস করলেন রবীন্দ্রনাথ।
কে না স্যর, বলুন কী, ঈষৎ তাচ্ছিল্য ছুঁয়ে বললেন নিবারণ চক্রবর্তী, আলেফ!
আলেফ! রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে বিস্ময়।
গুরুদেব, আলিফ নয় তো, ওই আলিফ লায়লা-টায়লা..., পাশ থেকে বললেন জনৈক ব্যক্তি।
নিবারণ চক্রবর্তী বরফের মতো দৃষ্টিতে সেই ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন, রবীন্দ্রনাথের চক্ষুতেও ভর্ৎসনা, সেই ব্যক্তি সঙ্কোচে প্রায় মাটিতে মিশে গিয়ে শেষ আশ্রয়ের মতো রবীন্দ্রনাথের পদযুগলের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। নিবারণ চক্রবর্তী চোখ তুললেন, সামান্য বঙ্কিম হেসে বললেন, আনিলাম অপরিচিতের নাম ধরণীতে, পরিচিত জনতার সরণীতে...
কবিকে তার জীবনচরিতে পাওয়া যায় না নিবারণ, বললেন রবীন্দ্রনাথ, হয় কবিতা বলো, নয়তো কী যেন বলছিলে...!
হ্যাঁ, আলেফ! আমাকে তো বলল, অন্ধকার ঘরে একলা শুয়ে থাকো, তাকে দেখতে পাবে। শুয়ে আছি, তাকিয়েই আছি। হঠাৎই তাকে দেখা গেল। সে এক বিচিত্র বস্তু। আকারে ছোট্ট, কিন্তু বিশ্বাস করুন, তার মধ্যে সব আছে। স-অ-ব!
সব মানে?
এই পৃথিবীতে যা যা ছিল, আছে, এবং থাকবে, সেই সব কিছু সেখানে হাজির। খুদে একটি ব্রহ্মাণ্ড!
সেই ব্রহ্মাণ্ডটি তুমি দেখতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি, নিবারণ চক্রবর্তী রুদ্ধশ্বাস, কোনও শেষ নেই তার। শেষ হয়তো হয়, কিন্তু আসলে হয় না। একটা ছোট্ট আলোর বল যেন, আসলে তারই মধ্যে অনন্তের ছোঁয়া! পৃথিবীর সমস্ত স্থান সেখানে আছে। পৃথিবীর সমস্ত সময় সেখানে আছে। তার এক দিকে রাত্রি হয়। এক দিকে সকাল। কোথাও মেঘ করে বৃষ্টি এল তো কোনওখানে ঝলমলে রোদ। কেউ হেসে উঠল তো কারও চোখে গভীর বিষাদ।
জয় তব বিচিত্র আনন্দ, হে কবি...চক্ষু বন্ধ করে উপবিষ্ট রবীন্দ্রনাথ। স্থির। বাকচপল নিবারণও সহসা কথা বলতে পারলেন না! রবীন্দ্রনাথ চোখ খুললেন, বললেন, সেই ব্রহ্মাণ্ড, যার নাম বললে আলেফ, তাকে তুমি প্রত্যক্ষ করেছ ঠিক কার মতো জানো?
কার মতো? নিবারণ কৌতূহলী। একটু অস্থিরও। |
|
ঈশ্বরের মতো। কারণ, যে চোখে আলেফ দৃশ্যমান হয়, সেই সর্বত্রগামী এবং সর্বশক্তিমান চক্ষুর নাম কল্পনা। এবং, ঈশ্বরও আদি এবং অনন্ত কল্পনা।
নিবারণ কিছু বলার আগেই রবীন্দ্রনাথ আবার বললেন, তোমার চোখের সামনে অজস্র টুকরো টুকরো সময়, তাই না?
রাইট মিস্টার টেগোর, আমার সামনে যেন অজস্র আয়না, কিন্তু কারও মধ্যেই আমার ছায়া নেই..., উত্তেজিত নিবারণ চক্রবর্তীর স্বর।
মায়া-দর্পণ, নিবারণ! এই মনে হবে শেষ! এই মনে হবে, নয়। রবীন্দ্রনাথ বাইরের দিকে তাকালেন, আমিও দেখেছিলাম, জানো!
নিবারণ বললেন, কী দেখেছিলেন?
তুমি যা দেখেছ, তা-ই! আমি তখন পদ্মাবোটে। একদিন, তখন ভোর হয় হয়, এসে দাঁড়ালেম ডেক-এ। পৃথিবীটি নীরব। নদী বয়ে চলেছে। আকাশে কী বিচিত্র আলো। নাকি, অন্ধকার, কে জানে! মনে হল, একটা আমি দাঁড়িয়ে আছি এই বোটে, আর এক আমি ছুটে চলেছে, ঘুরে চলেছে বিশ্বময়...আমি দেখছি মেঘ ও রৌদ্র, দেখছি কোথাও ভেঙে যাচ্ছে ঘর, কোথাও আবার কেউ আনন্দে হেসে উঠল খানিক, কোথাও আশ্চর্য বিচ্ছেদ, যার কারণ জানা নেই, কোথাও অভাবিত মিলন...সেই সব কার্য-কারণের মধ্যে আমি কোথাও নেই, আবার আমি যে একেবারে নেই, তা-ও বোধহয় নয়। টুকরো টুকরো সব মুহূর্ত! এক-একটি মুহূর্ত জ্বলে উঠছে অগ্নিশিখার মতো। নিভে যাচ্ছে, তারপর। কিন্তু, সত্যিই কি নিভে যাচ্ছে?
টানা কথা বলে সামান্য থামলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নিবারণ চক্রবর্তী হেসে বললেন, নিভে আর গেল কই? আপনি তো ধরে রাখলেন গল্পগুচ্ছের মধ্যে!
রবীন্দ্রনাথ হাসলেন, বললেন, ছোটগল্প! শেষ হয়, আবার হয়ও না। কিছু লিখে রাখা গেল, কিছু গেল না, কিছু লিখে রাখা হবে, এই রকম একটা আশা নিয়ে কেউ চলে গেল, কেউ সেই জায়গায় আসবে, কিন্তু গল্পটা, গল্পগুলো থেকেই যাচ্ছে...
এমন একটি মন্তব্যের পরে ঈষৎ স্তব্ধতাই স্বাভাবিক, কিন্তু নিবারণ চক্রবর্তী দৃষ্টি তীক্ষ্ন করে বললেন, একটা প্রশ্ন ছিল মিস্টার টেগোর, এক বার সেই ঈশ্বরের চক্ষু পাওয়ার পরে কি জীবনে কোনও বিস্ময় থাকে? ভেবে দেখুন, জীবনে কিছু নতুন নেই আর! কোনও প্রতীক্ষাও নেই। সবই তো দৃশ্যমান।
রবীন্দ্রনাথ বললেন, সে তো ঈশ্বরের সংকট, নিবারণ, আবার গল্পলেখকেরও। তিনি সবই জানেন, অথচ চরিত্রেরা জানে না। তিনি সবই দেখছেন, কিন্তু চরিত্রেরা দেখছে না। তিনি তাদের নিয়ে চলেছেন, যাকে যার মতো করে... যে ভাবে আমরা এগিয়ে চলি, একটি বছর থেকে আর এক বছরে। সেই বয়ে চলার ফাঁকে, মাঝে মাঝে, সেই ঈশ্বরের চোখ আমরাও ধরতে পারি যেন।
মানে?
বছর ফুরোনোর ঠিক আগে সেই বছরটার দিকে কখনও ফিরে তাকিয়েছ? সেই বছরের গোড়ায় কিছু জিনিস হওয়ার কথা ছিল, তার কিছু হল, কিছু হল না, কেউ কেউ চলে গেল, কেউ থাকল... আচমকা সব একটা কাহিনির মতো তোমার সামনে জ্বলে উঠল একটি মুহূর্তে। বছরের শেষে। তুমি দেখছ। ঈশ্বরের মতো।
যে ভাবে আলেফ-কে দেখেছি!
হ্যাঁ, ছোটগল্পও যেন তেমনই একটি ব্রহ্মাণ্ড! ফুরোয়, কিন্তু আসলে বয়ে চলে অনন্তকাল। একটি মুহূর্ত লেখক ধরে রাখল, অতঃপর? আর লেখকই কি একমাত্র? চরিত্রেরা কিছু নয়? তাদের মধ্যেও কি প্রবেশ করো না তুমি? তাদের বিস্ময় কি ঈশ্বরেরও বিস্ময় নয়? সেই বিস্ময় কি তাঁকেও স্পর্শ করে না?
নিবারণ চক্রবর্তী আর কথা বললেন না। দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের শেষ পাতাটি দুলছে বাতাসে। রবীন্দ্রনাথ গুনগুন করে একটি গান ধরলেন কি? পৌষের কুয়াশামাখা আকাশপটে সেই দৃশ্যটি আশ্চর্য। নিবারণ চক্রবর্তী অস্ফুটে বললেন, আলেফ...
|
ঋণ: দ্য আলেফ, হর্হে লুইস বর্হেস |
|
|
|
|
|