হাওড়া-চক্রধরপুর লাইনে ছোট্ট এক রেল স্টেশন, বাগালিয়া। সাত কিলোমিটার দূরে গ্রাম তিলাবনি। পঞ্চয়েত কলাবনি। শহর পুরুলিয়া থেকে তিলাবনির দূরত্ব প্রায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার। যাতায়াত করতে দু’চাকা বা প্রাইভেট গাড়িই ভরসা।
তবে এই ঠিকানাটা গুরুত্বপূর্ণ নয় রতন মাহাতর জীবনে। এই ছৌ শিল্পীর জীবনে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল মুখোশহীন ‘ছো’। ছৌ নৃত্যশিল্পের আদিযুগ। গুরু? কেঁদা গ্রামের প্রয়াত রমজান ওস্তাদ। “উয়ারা সব মারা গেছে। তা ধরুন কেনে চড়দার (চড়িদা, বাগমুণ্ডি) গম্ভীর সিং মুড়া বড় শিল্পী, মারা গেছে। ধরুন কেনে তারও আগে জীপা-মধু-ভিখা-লাল, সব বড় বড় শিল্পী। এক বিখ্যাত নাচনী লাচা করত কাঁড়দার অজমত সেখ। ইনি গম্ভীর সিং মুড়ার সময়ের। উয়ার শিষ্য গিয়াসুদ্দিন, বাম-পলমা গেরামের। বড় ভাল লাচে। আমি তো মুখোশ ছাড়াই ছো করতুম। পরে মুখড়া এল। ছোটা ছৌ হল। বদলাই গেল। তবে আনন্দটা একই রইয়েছে।” গ্রামের বাঁশতলার ছায়ায় বসে দীর্ঘ সংলাপে বিরতি টানেন সত্তর বছরের রতন। রতনের কাছে জানা গেল, মুখোশ পরে ছৌ করা অনেক সহজ। তুলনায় পোশাক ছাড়া, মুখোশ ছাড়া মুখ নিয়ে ছো নাচ অনেক কঠিন। রতন মাহাতোর এমন তথ্যের সায় মিলল মানভূমি-গবেষক ও শিক্ষক সুভাষ রায়ের কাছে। তাঁর কথায়, “আগে ছিল ছো। এখন হল ছৌ। আগে ছিল গায়ে রং, মুখে রং। এখন ঝলমলে পোশাক। অত্যাধুনিক বাদ্যযন্ত্র মায় সিন্থেসাইজার। কাজটা অনেক সহজ হল ঠিকই। কিন্তু হারিয়ে গেল পারফর্মারদের কঠিন নিষ্ঠা। এখন লোকের চাই সব কিছু চড়া। সুর চড়া। আলো চড়া। শব্দ চড়া। ফলে আসল পুরনো শিল্পের প্রবাহে ‘চরা’ পড়ল। বলতে পারেন পরিবর্তন।” তা ঠিক। ছৌ এর মুখোশ অবশ্যই এক পরিপূর্ণ শিল্প। চড়িদার খ্যাতি এই মুখোশে। এই শিল্পের কারিগররা জীবিকা খুঁজে পেয়েছেন মুখোশ তৈরি করে। পুরুলিয়ার কালচারাল লোগো তো ‘ছৌ’। তবে এই মুহূর্তে রতনের গায়ে নেই রং। বাঘের ভূমিকায় সে এখন। মুখে নেই ডোরাকাটা হলুদ-কালোর টান। মধ্য দুপুরে তিলাবনির বাঁশবাগানকে করে তুললেন পঞ্চাশ বছর আগের ছো-স্টেজ। শুধু মুখ ও শরীর ভাষায়, কণ্ঠের হুঙ্কারে বোঝালেন, অযোধ্যা পাহাড় থেকে ‘বাঘবাবু’ বের হলেন।
সে দিন ছিল মিট মিটে আলো। পরে এল হ্যাজাক। ছো এর সঙ্গে ঝুমুর গান। প্রতিটি আসরে নতুন বানানো তালপাতার বাঁশি বাজত। ধামসাটা ছিলই। সানাই থাকলে রাজকীয়। করতাল থাকত অবশ্যই। মুখ ঢাকা পড়ল মুখোশে। তা হলে এখন আর কী কাজ সত্তর বছরের রতনের? “একলা ‘এ কৈড়া ছো’ টা আমি করি একা একা ঘরের ভিতরে, পুকুর পাড়ে। অভ্যেসটা বাঁচাই রাখি। উটা আমার পেরথম পক্ষ। পাড়ার ছেলেরা একটা ছো দল খুলেছে। বিশ বরষ হবে। ‘পাহাড়িয়া গণেশ ছৌ সংস্থা।’ সবাই খুব সম্মান করে। ছেলেদের শিখাই। পুরানো-লতুন সব ভাবনা ছৌ-তে মিল খাওয়াই।” সাফল্যের কণ্ঠস্বর অর্ধশতাব্দীর সাক্ষী রতনের। “দল কলকাতায় ডাক পেলে সঙ্গে যাই। সেখানে আমার শিষ্যরা কেমন কাজ করছে, দেখা দরকার। শহরের বাবুদের সামনে ভড়কাই গেল কি না দেখি। আর দেখি অনেক মুখ।” নমস্কার দিয়ে বিদায় জানালেন কলাবনি পঞ্চায়েতের ছৌ-গুরু। |