দরজায় কড়া নাড়ছে উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন। তার আগে রাজ্যসভায় লোকপাল বিল পাশ না হওয়ায় আজ বিজেপিকেই কাঠগড়ায় তুলল সরকার। সেই সঙ্গে এ-ও জানিয়ে দিল, সংসদের আসন্ন বাজেট অধিবেশনে লোকপাল বিলটি পাশ করাতে ফের সচেষ্ট হবে কেন্দ্র।
রাজ্যসভায় কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। তার উপরে শরিক তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতাও হয়নি। ফলে গত কাল লোকপাল বিল নিয়ে ভোটাভুটি থেকে সরকার যে মুখ লুকোতে চেয়েছিল, তা শেষ পর্বে গিয়ে স্পষ্ট হয়ে যায় বলেই বিরোধীদের বক্তব্য। কিন্তু রাত পার হতেই আজ গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে কংগ্রেস এবং সরকার। অস্বস্তি আর গ্লানি কাটিয়ে উঠতে তারা পাল্টা আক্রমণের পথ নেয়। উত্তরপ্রদেশ ভোটের আগে যা রাজনৈতিক ভাবে জরুরিও। গত কাল মধ্যরাতে রাজ্যসভা মুলতুবি হয়ে যাওয়ার পরে বিজেপি নেতৃত্ব কড়া ভাষায় দুষেছিলেন কংগ্রেস ও সরকারের নেতৃত্বকে। সরকারের কোনও কোনও মন্ত্রী পাল্টা জবাব দিলেও দৃশ্যত কংগ্রেস কিছুটা ‘ব্যাকফুটে’ ছিল। আজ কিন্তু দল ও সরকারের শীর্ষ নেতারা সেই গ্লানি ঝেড়ে ধারাবাহিক ভাবে সাংবাদিক বৈঠক করে লোকপাল বিল নিয়ে বিজেপির সমালোচনায় নেমে পড়েছেন।
এমন সামগ্রিক ভাবে কেন বিজেপিকে আক্রমণ করে মাঠে নামল কংগ্রেস? রাজনৈতিক সূত্রে বলা হচ্ছে, এর কারণ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। লোকপাল বিল যে রাজ্যসভায় পাশ হবে না, সেই আশঙ্কা কংগ্রেসেরও ছিল। তারা ঠিক করে রেখেছিল, এমন কিছু ঘটলে বিজেপিকে কাঠগড়ায় তুলে উত্তরপ্রদেশে প্রচার চালাবে দল। শরিক তৃণমূল আচমকা বিরোধিতার পথ নেওয়ায় সেই পরিকল্পনা কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে। কংগ্রেস নেতারা অবশ্য মনে করছেন, উত্তরপ্রদেশে তৃণমূল রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বহীন। সেখানে এখনও লোকপাল বিল পাশ না হওয়ার জন্য বিজেপিকে আক্রমণ করা যাবে। একই সঙ্গে লোকপাল বিল পাশের জন্য কংগ্রেস যাতে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, সে কথা তুলে ধরেও উত্তরপ্রদেশে ভোট চাইবে দল। |
আগামী জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে রাজ্যসভার ৬৫টি আসনে ভোট হওয়ার কথা। তার মধ্যে যদি উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে বিজেপিশাসিত উত্তরাখণ্ড, পঞ্জাবেও কংগ্রেস ভাল ফল করে, তবে সমীকরণ ঘুরে যেতে পারে বলে দলের শীর্ষ নেতারা মনে করছেন। সেই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস ওই আসনগুলির মধ্যে কম করেও ১০-১২টি জিতবে বলে তাঁদের আশা। তা হলে রাজ্যসভায় সমীকরণ নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে পারবে বলেই মনে করছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
এখন তাই প্রথমে জোর দেওয়া হচ্ছে ভোটগুলিতে। এবং সেখানে লোকপাল প্রসঙ্গে বিজেপিকেই কাঠগড়ায় তুলছে কংগ্রেস।
উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের কাণ্ডারী রাহুল গাঁধী আজ ঠিক এই কৌশলেই হেঁটেছেন। সাহারানপুরের এক জনসভায় রাহুল আজ বলেন, “বিজেপি কেন লোকপালকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিতে বাধা দিয়েছে? কারণ সেই প্রস্তাব ছিল রাহুল গাঁধীর! কিন্তু ওই প্রস্তাব আমার নয়। যুব সম্প্রদায়ের। এর মাসুল দিতে হবে বিজেপিকে।”
রাহুল যখন জনসভায় এ কথা বলছেন, তখন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী তথা উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেস নেতা সলমন খুরশিদ এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, বিজেপি লোকসভাতেও লোকপাল বিলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিলটি রুখে দিতে সফল হলেও লোকপাল বিলের গতিরোধ করতে পারেনি। তাই রাজ্যসভায় অন্য বিরোধী দলগুলির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তারা আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে। কৌশলে ১৮৭টি সংশোধন প্রস্তাব পেশ করা হয়। এতগুলি প্রস্তাব বিবেচনা করে কোনও ভাবেই লোকপাল বিলটি গত কাল পাশ করানো সম্ভব ছিল না। তাই পূর্ব-পরিকল্পিত নাটক ছিল বিজেপির। কংগ্রেস বা সরকারের নয়।
তবে শরিক তৃণমূলের ভূমিকা নিয়েও আজ অনিবার্য ভাবে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে কংগ্রেস তথা সরকারকে। রাজ্যসভা মুলতবি হওয়ার পর গত কাল যে ভাবে তৃণমূল সাংসদরা সরকারের সমালোচনায় অবতীর্ণ হন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু অন্দরে উষ্মা থাকলেও চিদম্বরম বা কংগ্রেস নেতারা তৃণমূলের বিরুদ্ধে চড়া সুরে কোনও মন্তব্য করেননি। বরং চিদম্বরম বলেন, তৃণমূলের সঙ্গে একটি বিষয়ে মতান্তর হয়েছে ঠিকই। তবে লোকপাল বিলটি সংসদে পেশ করার আগে ওদের সঙ্গে বহুবার আলোচনা হয়েছে। মন্ত্রিসভার যে বৈঠকে লোকপাল বিলটিতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সেখানেও তৃণমূলের এক মন্ত্রী ছিলেন। সর্বদল বৈঠকেও ওরা ছিল। তা ছাড়া লোকসভায় লোকপাল বিল পাশের সময় তৃণমূল যে সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছিল, তা-ও মেনে নেয় সরকার। এর পরেও ওদের যদি উদ্বেগ তৈরি হয়, সরকার আলোচনার মাধ্যমে তা নিরসনে সচেষ্ট হবে।
তবে কিছুটা হলেও তৃণমূলকে আজ কটাক্ষ করেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী গুলাম নবি আজাদ। তিনি বলেন, গত কাল বিজেপি-র নেতৃত্বে একটা দারুণ নাটক হয়েছে। সেই নাটকে কেউ ছিলেন প্রযোজক, তো কেউ নির্দেশক, কেউ সঙ্গীত পরিচালক। প্রশ্ন ওঠে, তাতে তৃণমূল কি ছিল? জবাবে গুলাম নবি বলেন, “এত বড় চিত্রনাট্যে নিশ্চয়ই কোনও একটা ভূমিকায় ছিল। কোন ভূমিকায় সেটা খুঁজে নিন।”
এখন প্রশ্ন হল, লোকপাল বিলের ভবিষ্যৎ কী?
তার জবাবে চিদম্বরম আজ বলেন, বিরোধীদের আনা সংশোধনী প্রস্তাব কোনও দিনও মানতে পারে না সরকার। সংসদীয় ইতিহাসে তা কখনও হয়নি। তা হলে সরকারের কর্তৃত্ব কোথায় রইল? বিরোধীরা কোনও সংশোধনী প্রস্তাব আনলে সরকার বিবেচনা করে পরে নিজে সেই প্রস্তাব নিয়ে আসে। কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারও বাজেট অধিবেশনে সে ভাবেই সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বিলটি ফের সংসদে আনবে। হতে পারে, তার মধ্যে রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে যাবে। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী পবন বনশলের বক্তব্য, গত কাল লোকপাল বিলটিতে সংশোধনী প্রস্তাব পাশ হলেও তা বাজেট অধিবেশনে ফের লোকসভায় আনতে হত। সুতরাং সরকার কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি। |