সংশোধনী প্রত্যাহার না করায় জট
রাজ্যের অধিকারে অনড় মমতা, ক্ষুব্ধ কেন্দ্র
মতা বন্দ্যোপাধ্যায় লড়ছেন রাজ্যের অধিকার চেয়ে। কিন্তু তাতে সব থেকে বেশি দুঃখিত তাঁরই জোট শরিক কংগ্রেসের হাইকম্যান্ড।
লোকপাল বিল রাজ্যসভায় পাশ করাতে না পারায় যত না দুঃখ, তার থেকে অনেক বেশি দুঃখ কংগ্রেস হাইকম্যান্ড পেয়েছে গত কাল মমতা সংশোধনী প্রত্যাহার না করায়। এই ঘটনায় তারা এখন মমতার উপরে যারপরনাই ক্ষুব্ধও।
গত কাল গভীর রাত পর্যন্ত মমতাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সংশোধনীগুলি প্রত্যাহার করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে কংগ্রেস। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দৌত্য ব্যর্থ হলে বেশি রাতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং সনিয়া গাঁধীর নির্দেশে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম টেলিফোন করেন মমতাকে (যদিও তৃণমূলের পক্ষ থেকে চিদম্বরমের ফোনের কথা স্বীকার করা হয়নি)। চিদম্বরম একটা নতুন সমাধানসূত্র দেন তৃণমূল নেত্রীকে। সেটা হল, রাজ্যসভায় লোকপাল ও লোকায়ুক্ত বিলে কংগ্রেস একটি সংশোধনী গ্রহণ করে নেবে। তাতে বলা হবে, কোনও রাজ্য লোকায়ুক্ত গঠন করবে কি না, সেটা সেই রাজ্য সরকার ঠিক করবে। ঠিক যে ভাবে জমি বিলের ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থার জন্য জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি রাজ্যের অধিকারের উপরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মমতা কংগ্রেসের এই যুক্তির সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তিনি বলেন, কেন্দ্র রাজ্যের মুখ্যসচিবের মাধ্যমে চার-পাঁচ জনকে নিয়ে লোকায়ুক্ত গঠন করবে আর সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর কোনও ভূমিকা থাকবে না, সেটা হয় না। আমি সেটা মানব কী করে? বরং রাজ্যে লোকায়ুক্ত গঠনে কেন্দ্রেরই কোনও ভূমিকা থাকার কথা নয়। তাঁর বক্তব্য, কংগ্রেস লোকসভার ক্ষেত্রে কথা দিয়েছিল যে, তারা রাজ্যের দাবির দিকটা দেখবে। আর তৃণমূলও শরিক হিসেবে কোনও সংশোধনী আনব না। “আমরা আপনাদের বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি।”
এখানে মমতা যুক্তি দেন, লোকপাল বিলের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশ তৃণমূল সমর্থন করবে। কিন্তু তৃতীয় অংশ, যেখানে লোকায়ুক্তের প্রসঙ্গ রয়েছে, তার পুরোটাই এখন বাতিল করুক কেন্দ্র। পরে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে লোকায়ুক্ত অংশটি পাশ করানো যাবে। সেটা অনেক সহজও হবে। তৃণমূলও লোকসভা এবং রাজ্যসভায় সরকারকে সমর্থন করব। মমতা এমনকী চিদম্বরমকে এ কথাও বলেন, “এটা আপনার-আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। আমার যুক্তি মেনে চললে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত, তরুণ গগৈদেরও তো লাভ হবে। তাঁরাও এই ক্ষেত্রে স্বাধিকার ভোগ করবেন।”
মমতার এই পাল্টা প্রস্তাব আবার চিদম্বরম মানেননি। কংগ্রেস নেতৃত্ব মনে করছেন, এমন কিছু হলে আবার লোকায়ুক্তের অংশ বাদ দেওয়ার ফলে নতুন বিতর্কের মুখে পড়তে হবে।
এই পরিস্থিতির মধ্যে এ দিন চিদম্বরম আবার সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, মন্ত্রিসভার যে বৈঠকে লোকপাল নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, সেখানে তৃণমূলের মন্ত্রী ছিলেন। এ কথা শোনার পর তৃণমূলের একমাত্র পূর্ণমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী বলেন, মন্ত্রিসভার বৈঠকে যে দিন বিলটি আনা হয়, সে দিন সেটি আগে থেকে দেওয়া হয়নি। সভা চলাকালীন দেওয়া হয়। আমি তার মধ্যেই বিলটি পড়ি। এবং ওঁদের বলি, আপনারা তো নামটাই বদলে ফেলেছেন। তা হলে এখন এই নিয়ে আলোচনা করার বদলে কি বিলটিকে আর একবার স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠানো উচিত নয়? কিন্তু চিদম্বরম, প্রণববাবু এবং পবন বনশল মিলে আমরা বিরোধিতা করেন। বিলটি মন্ত্রিসভায় পাশ হয়ে যায়। দীনেশের খেদোক্তি, মন্ত্রিসভার কথা আমি বাইরে বলতাম না। কিন্তু চিদম্বরম আজ আগে বলেছেন। তাই আমাকেও বলতে হল।
প্রশ্ন উঠেছে, মমতা ও কংগ্রেসের সম্পর্ক এখন যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে তার ভবিষ্যৎ কী? পেনশন থেকে খুচরো ব্যবসা, তিস্তা চুক্তি থেকে জমি বিল, এবং সর্বোপরি এই লোকপাল বিল প্রতিটি ক্ষেত্রে মমতার সঙ্গে যে ভাবে কেন্দ্রের সংঘাত তৈরি হচ্ছে, তাতে এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী? কত দিনই বা এই সম্পর্ক টিকবে?
কংগ্রেসের রণকৌশল হল, আপাতত উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে নজর দেওয়া হোক। উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনের পরে যদি মুলায়ম সিংহ যাদবের সঙ্গে সমঝোতা হয় বা কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে মুলায়ম সেখানে সরকার গড়েন, তা হলে কেন্দ্রেও তিনি ইউপিএ-র শরিক হতে পারেন।
তৃণমূলের যেখানে ১৯ জন সাংসদ, সেখানে সমাজবাদী পার্টির ২২ জন সাংসদ। তখন মুলায়ম নিজে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হলে তাঁর ছেলে অখিলেশকে কেন্দ্রে মন্ত্রী করে নেওয়া যেতে পারে। কংগ্রেসের অনেক নেতা মনে করছেন, মমতার তুলনায় মুলায়ম অনেক বেশি নির্ভরশীল শরিক হবেন। একই সঙ্গে লোকপাল বিলের সময় ‘পাশে দাঁড়ানোর’ পুরস্কার দিয়ে জোটে নেওয়া হতে পারে লালু প্রসাদকেও। এই অনুযায়ী বিকল্প পরিকল্পনা করতে শুরু করেছে কংগ্রেস।
কংগ্রেস বিকল্প শরিকের জন্য প্রস্তুতি নিলেও সনিয়া গাঁধী-সহ কংগ্রেসের অনেক নেতাই কিন্তু এখনই মমতাকে চটাতে চান না। এখনও তাঁরা ‘মেরেছ কলসির কানা, তা হলে কি প্রেম দেব না’-র নীতিতেই বিশ্বাসী। তাঁদের বক্তব্য, মমতা যেমন আছেন থাকুন। তিনি নিজে থেকে জোট ভেঙে বেরিয়ে যেতে চাইলে যেতে পারেন। কিন্তু মমতা ও মুলায়ম একসঙ্গে থাকলে অনেক বেশি ভারসাম্য বজায় থাকবে। মমতা যেমন দেখবেন যে মুলায়ম থাকায় তিনি অপরিহার্য নন, তেমনই মুলায়মও সেটা বুঝে চলবেন। বস্তুত, লোকপাল বিল নিয়ে লোকসভায় ‘ওয়াকআউট’ করে সরকারের সুবিধা করে দিলেও রাজ্যসভায় কিন্তু তা করতে চাননি মুলায়মরা। বরং বিরোধিতার পথই নিয়েছেন। কংগ্রেসের অনেকে মনে করছেন, ইউপিএ শরিক হলে চাপ দিয়ে মুলায়মের সমর্থন আদায় করা যেত।
মমতা কী চাইছেন, সেটাও বোঝার চেষ্টা করছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। জয়রাম রমেশের মতো নেতারা মনে করছেন, মমতার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে কংগ্রেসের দিক থেকেও ত্রুটি হচ্ছে। সবটাই মমতাকে দোষারোপ করা অনুচিত। কংগ্রেসের যেমন যুক্তি আছে, মমতারও নিজস্ব যুক্তি রয়েছে। কংগ্রেস যেমন বলছে, লোকপাল বিল নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে দীনেশ ত্রিবেদী ছিলেন। মমতাকে লোকপাল বিলের খসড়া পাঠানো হয়েছিল। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে সুখেন্দুশেখর রায় ছিলেন। তিনিও কোনও ‘ডিসেন্ট নোট’ দেননি। মমতা আবার বলছেন, কংগ্রেস কথা দিয়েছিল, লোকায়ুক্ত নিয়ে আশঙ্কা দূর করবে। অথচ তা করেনি। আর সে জন্যই লোকসভায় বিলটিকে সমর্থন করার পরে রাজ্যসভায় তার বিরোধিতা করতে হল। যদিও রাজ্যের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নেওয়ায় মমতা অন্যান্য দলের মুখ্যমন্ত্রীদের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে গেলেন।
কংগ্রেসের নেতারা বলছেন, মমতা ‘পলিটিক্যাল ইনস্টিংক্ট’ থেকে সিদ্ধান্ত নেন। যে কারণেই হোক, তিনি কংগ্রেসের যুক্তি বুঝতে পারছেন না। জয়রাম রমেশ, আনন্দ শর্মা, এমনকী আহমেদ পটেলও মনে করছেন, প্রণব মুখোপাধ্যায় বর্ষীয়ান নেতা ঠিকই। কিন্তু তাঁর প্রচুর কাজের চাপ। তিনি তো আছেনই, এ ক্ষেত্রে অন্য কাউকে পুরো সময়ের জন্য মমতাকে সামলানোর দায়িত্ব দিলে ভাল ফল মিলবে। তামিলনাড়ুতে যেমন জয়ললিতাকে সামলানোর দায়িত্ব চিদম্বরমকে দেওয়া যায় না, মধ্যপ্রদেশে বিজেপি যেমন উমা ভারতীকে বোঝানোর দায়িত্ব শিবরাজ সিংহ চৌহানকে দিতে পারে না। সেখানে একই রাজ্যের নেতা হলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়ন দেখতে হয়। এই পরিস্থিতিতে মমতাকে সামলানোর নীতিও কংগ্রেসের পর্যালোচনা করা উচিত। কারণ দিনের শেষে কংগ্রেসই প্রধান শাসক দল। শরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা, কক্ষ সমন্বয়ের দায়িত্ব তারই। বিশেষ করে মমতা একেবারেই অচেনা চরিত্র নন। এই দায়িত্ব দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনায় উঠেছে জয়রামের নামও।
এনডিএ আমলে মমতার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার কাজটি করতেন প্রমোদ মহাজন। মমতা যে দিন তহেলকা কাণ্ডে এনডিএ ছেড়ে চলে যান, সে দিন সন্ধ্যায় কংগ্রেসের এক শীর্ষনেতাকে প্রমোদ লোদী গার্ডেনের এক পার্টিতে বলেছিলেন, ‘শ্যাম্পেনের বোতল খুলব। চলে আসুন।’ সেই কংগ্রেস নেতা তখন প্রশ্ন করেন, এই দুঃখের দিনে শ্যাম্পেনের বোতল খুলছেন! প্রমোদ বলেন, ‘হ্যাঁ, দুঃখ আছে ঠিকই। কিন্তু কাল থেকে আর মমতার সঙ্গে দর কষাকষি করতে হবে না।’ এই গল্পটি বলে কংগ্রেসের সেই নেতা বলেন, “দলের মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে যে মমতার থেকে মুলায়মকে এখন ভাল মনে হচ্ছে। কিন্তু কংগ্রেসের বড় অংশের মত হল, তিতিবিরক্ত হওয়াটা জোট রাজনীতি নয়। আসলে আমরা বরাবর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে এসেছি। তাই একটা জমিদার-সুলভ ভাব চলে এসেছে। অন্য দিকে, ’৮৪ সাল থেকে বিজেপি আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে সখ্য গড়ে তুলতে পেরেছে। কংগ্রেসের ব্যর্থতার জন্য পুরনো ‘একলা চলো রে’ মানসিকতাই দায়ী।”
সেই মানসিকতা সরিয়ে রেখে মমতার সঙ্গে সম্পর্ক কতটা টিকিয়ে রাখতে পারে কংগ্রেস, সেটাই এখন দেখার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.