|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা ১... |
|
সন্দীপের সেরা ফেলু |
মগজাস্ত্রের ঝলকানি ফিরেছিল আগেই। এ বার যোগ হল মসৃণ চিত্রনাট্য।
ঝকঝকে টেকনিক। দুর্দান্ত লোকেশন। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য |
১৯৭৪ সালে সেবারের শারদপত্রাবলির লেখালিখি নিয়ে আনন্দবাজারে একটা উত্তরসম্পাদকীয় লিখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাতে, দু’টি উপন্যাস নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। রমাপদ চৌধুরীর ‘খারিজ’ আর সত্যজিৎ রায়ের ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’। দ্বিতীয়টি সম্বন্ধে বলেছিলেন যে, এর নিষ্পত্তি নিখুঁত, এবং এর আগের কিছু ফেলুদা কাহিনির শেষের চেয়ে অনেক বেশি জমাট। সুনীল সেদিন বাস্তবিকই আমার মতো অনেক উপন্যাসভক্তের মনের কথাটা উগরে দিয়েছিলেন।
সত্যজিৎ রায় একবার আমাকে রোয়াল্ড ডাল-এর গল্প প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আই এনজয় হিজ লাস্ট লাইন শক্স!’ সেই ‘শেষ বাক্যের চমক’ সত্যজিতের ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’-য় একটা প্রধান লক্ষণ। এমন এক পরিবেশ, মনস্তত্ত্ব ও কাহিনিরসের সমাবেশকে চিত্রনাট্যে বাঁধা, এবং অমন নিটোল ভাবে বাঁধাটাই সন্দীপ রায়ের ছবির প্রথম সাফল্য। সন্দীপ এরই মধ্যে পিতৃদেবের ঘরানাধারায় অরণ্য পর্যটনের অঙ্গটাও চমৎকার বিস্তার করেছেন। এত গতি অথচ এত মসৃণ লাবণ্যে ব্যবহার করানো হয়েছে ক্যামেরাকে যে চোখের তারা এবং মগজের স্ফূর্তিতে মাখামাখি হয়ে যায়। চিত্রনাট্যে লেখা এবং ক্যামেরায় বন্দি করার মধ্যে ভারসাম্য এতটাই যে একটিও সংলাপ কিংবা একটিও দৃশ্যকে বাড়তি মনে হয় না যা ছিল সত্যজিৎ রায়ের ছবির অমোঘ চরিত্র। ফলে থেকে থেকেই সন্দীপের ছবিকে ওঁর বাবার কাজের পাশাপাশি রেখে ভেবেছি: সত্যজিৎ এ ছবি করলে কী ভাবে করতেন? আর বারবার একটাই উত্তর এসেছে: আজকের দিন তো, ঠিক এভাবেই, ঠিক এটাই।
অরণ্যের পরিবেশ বলেই ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ ছবিতে একটা সময়হীন আবেশ আছে। এখনকার ট্রেন বা গাড়ি বাদ দিলে বিশেষ কিছুই বুঝতে দেয় না যে কাহিনি রচনাকাল থেকে আমরা প্রায় ৪০ বছর সরে এসেছি। সন্দীপ ছবিতে শুধু রহস্যমোচনের লক্ষ্যেই এগোননি, ফেলুদা ও তোপশের আলাপচারিতে বিভূতিভূষণ, জিম করবেট, কেনেথ অ্যান্ডারসন, বাঘের পদচ্ছাপ, খাবার ধরন, গুবরে পোকার গাত্রজোর, বাঘ আসার ইঙ্গিত, সবই একটু করে খোলসা করেছেন। এবং সংলাপ প্রয়োগগুণে ফেলুদা’র তথ্যের জোগানকে মাস্টারি মনে হতে দেননি। রহস্যের অনুসন্ধানে বেরোনো ফেলু, তোপশে ও জটায়ুর সঙ্গে দর্শককেও প্রায় সংলগ্ন করেছেন অরণ্য আবিষ্কারে। ফলে, একটা সময়, জঙ্গলও একটা চরিত্র হয়ে ওঠে। ঢেনকানল, মহানন্দা কী বল্লারপুরের বনের সবুজ অন্ধকারে ক্যামেরার কখনও গতিশীল, কখনও সন্তর্পণ চলন একটা অদ্ভুত আমেজ এনেছে। যেটা সিনেমার অবদান উপন্যাসকে। |
|
রয়েল বেঙ্গল রহস্য
সব্যসাচী, বিভু, পরান , সাহেব, ভাস্বর |
উপন্যাসটি দাঁড়িয়ে আছে বন, বাঘ আর একটা ধাঁধার ওপর। শিকারি জমিদারবাড়ির অতিথি ফেলুদা, তোপশে ও জটায়ু। জমিদার মহীতোষ সিংহরায় একটা ধাঁধা ধরালেন ফেলুকে, যে ধাঁধায় আড়াল আছে একটা গুপ্তধন। সেই গুপ্তধনের অনুসন্ধানে সিংহরায় পরিবারের অনেক গুপ্তকথা সামনে আসতে লাগল ফেলুদা’র। সামনে এসে পড়ল মহীতোষের অসুস্থ মস্তিষ্কের দাদা দেবতোষ। আর যারা সারাক্ষণ সামনেই আছে সেই মহীতোষ, তাঁর সচিব তড়িৎ সেনগুপ্ত আর বন্ধু শশাঙ্ক সান্যাল ক্রমশ আলো-আঁধারিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। কেন ক্রমশ রহস্য দানা বাঁধতে থাকল সিংহরায়দের ট্রফি-ঘরে? যেখানে শিকার করা বাঘ ও অন্য বন্যপ্রাণীর পাশাপাশি হন্তারক রাইফেলের গায়ে গায়ে সাজানো আছে খাপখোলা সাবেক তরোয়ালও। ফেলুদা’র চোখে আরও পড়ল মহীতোষের ডিক্টেশন নিয়ে বই লেখার সঙ্গে আরেকটি কাজও গুছিয়ে করেছেন তাঁর সচিব তড়িৎ: মহাভারত চর্চা। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সহসা একটা মৃত্যু দিয়েই গুপ্তধন আর বাঘরহস্য নতুন মোড় নিল।
‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’-য় ফেলুকাহিনি হিসেবে নতুনত্ব বেশ ক’টাই। প্রথমত ফেলু হিসেবে সব্যসাচী চক্রবর্তীর হাঁটাচলাতে একটা টানটান ভাব ফিরেছে বলে মনে হল, বিশেষত পোড়ো মন্দির থেকে যে ভাবে দু’-বার স্টাইলের সঙ্গে বেরোলেন। আর ফলাও করে না বলা হলেও এ ছবিতে ফেলুর মগজাস্ত্রের ব্যবহার খুব স্পষ্ট, কারণ সব্যসাচীর অভিনয়ে ওকে সারাক্ষণ অন্তর্মুখিনও ঠেকেছে; ভুরু কোঁচকানো ফেলু নয়, কিছুটা চিন্তিত, উদাস।
‘র-ব-র’র দ্বিতীয় নতুনত্ব এক অপূর্ব জটায়ু আবিষ্কার। প্রয়াণের আগে বিভুবাবু যেন লালমোহনবাবুকে এক অন্য মাত্রা দিয়ে গেলেন। তাঁর ভয়-ভীতি-বাগাড়ম্বর-মূর্ছা যাবার প্রবণতা সবই অটুট, কিন্তু তার মধ্যেও এক সজীব চতুরতা, চেষ্টা না-করেও হাসিয়ে যাবার ক্ষমতা। উন্মাদ দেবতোষের হাতে ওঁর চিরুনি তুলে দেওয়া কী ফিরিয়ে নেওয়া দু’টি নিখুঁত, নির্বাক কৌতুক দৃশ্য। বিভুবাবুর সংলাপ ধরা-ছাড়াতেও আজব প্রতিভা ভর করেছিল এ বার।
তুলনায় তোপশের কাজ এ বার কম। তবে সেই কিশোর তোপশে এখন লম্বা-চওড়া হয়ে ফেলুর কানের কাছে পৌঁছে গেছে। বেশ লাগল দেবেশ রায়চৌধুরীর শশাঙ্ককে, সারাক্ষণ ভাবিত, হতোদ্যম এক নিঃসঙ্গ মানুষ, যার অপরাধে জড়ানোটা খুবই স্বাভাবিক। আর বড় প্রশংসার অপেক্ষায় থাকবে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেবতোষ। নানা দিক দিয়েই এক প্রধান, যদিও উৎকেন্দ্রিক চরিত্র এই দেবতোষ। শুধু ওঁর চাহনিটা অত তীব্র, স্পষ্ট না হয়ে এলোমেলো হলে ভাল হত। বাসুদেব মুখোপাধ্যায়ের মহীতোষ, ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়ের তড়িৎ ভাল লাগে, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়ের পুলিশ অফিসার দিব্যি স্মার্ট।
‘র-ব-র’-র প্রয়োগ নৈপুণ্য এটাই যে একটা নিটোল গল্প, নানা অভিনয়, চোখ জুড়োনো পরিবেশ, সব কিছুকেই বাঁধা হয়েছে এক ছন্দোময়, নানা লয়কারির, চিত্তাকর্ষক ন্যারেটিভে। যা সম্ভব করেছে সন্দীপের অতি চমৎকার আবহ সুরারোপ এবং সুব্রত রায়ের মসৃণ সম্পাদনা। শশাঙ্ক পালিতের ক্যামেরা পরিচালনা একেক সময় বিলিতি ছবির ক্যামেরার কাজ মনে করিয়েছে। গোটা ছবি জুড়ে রঙের টোনের যে এলিগ্যান্স ও ব্যালেন্স তা মুগ্ধ করে।
এবং, অবশেষে, প্রথম কথাটা শেষে। ‘গোরস্থানে সাবধান’-এর টাইটেল কার্ডের সমালোচনা করেছিলাম। তার জবাব সন্দীপ দিয়েছেন ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’-য়। সবুজ বনের পাতার ফাঁক দিয়ে ঈষতোদ্ভাসিত বাঘের হলুদ বর্ণের খেলা ও মিলিয়ে যাওয়া দিয়ে যে টাইটেল প্রক্ষেপ করা হল এর তুল্য কোনও বাংলা শিরোনামলিপি হয়েছে কিনা মনে করতে পারছি না।
এ ছবি সন্দীপ রায়ের সবচেয়ে সুনির্মিত এবং অবশ্যই শ্রেষ্ঠ ছবি! |
|
|
|
|
|