সিনেমা সমালোচনা ২...
শাহরুখ ডন বৈঠক জমল না
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ...
ভবানীপুরে একটা হলে ঢুকে দেখি একটা হারমোনিকা বাজছে, কিন্তু শিল্পীকে দেখা যাচ্ছে না। সুইৎজারল্যান্ডের সবুজ, আর নায়িকার নরম মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন পেরিয়ে যখন শেষমেশ তাকে দেখলাম, বুঝলাম হিন্দি ছবি একটা নতুন সংজ্ঞা পেয়েছেঅ্যান্টি হিরো বা প্রতিনায়ক। এমন কেউ যে রেগুলার রক্তে চিঠি লেখে, নায়িকাকে ভয় দেখায়, প্রেমের নামে খুন-খারাপি করতে পিছু-পা হয় না। দক্ষিণ কলকাতার চলতি ভাষায় বলতে গেলে‘উড়ে গেছিলাম’। এবং এই উড়াল কিছু দিন আগে থেকেই শুরু হয়েছিলএই একই লোক যখন অবলীলাক্রমে আর এক নায়িকাকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল। খারাপকে ভালবেসে ফেলেছিলাম...শাহরুখ খানকেও।
তার পর কেটে গেছে ১৮ বছর। ইতিমধ্যে তাঁর হিন্দি সিনেমার বৈকুন্ঠধামে ঐশ্বরিক জায়গা পাকাপাকি হয়ে গেছে, হয়ে গেছে রাজ্যাভিষেক। তিনি ‘কিং খান’ নামে এখন পরিচিত। নানাবিধ সোয়েটার পরে, নানা ঠান্ডা দেশে গান গেয়ে উষ্ণতা জাগিয়েছেন আমাদের মনে। মোটামুটি একটাই সুবিশাল প্রেম করে গেছেন নানা ছবিতে, নানা নায়িকার সঙ্গে কখনও রাজ-অবতার ধারণ করে, কখনও রাহুল। মাঝে মধ্যে ছিটেফোঁটা ‘আম আদমি’, ভাঁড়রূপী ডিটেক্টিভ, মুখরোচক ক্যাবলা কার্তিক এমনকী যান্ত্রিক অতিমানবও। কিন্তু আমার মধ্যে যে হিন্দি সিনেমার পোকা, যে শাহরুখ খান নামক অ্যান্টিহিরোর আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল সে করছিল ছটফট। ভাবছিল আর কি কখনও তবে শাহরুখ খারাপ হবে?
এক হাতে বরাভয়, অন্য হাতে চন্দা বারোটের প্রথম ছবির ব্লু-প্রিন্ট নিয়ে এই সময় উদয় হলেন ফারহান আখতার। অমিতাভ বচ্চনের কালজয়ী ছবির একটি পরশুজয়ী রিমেক করলেন। ঝাঁ চকচকে শট নেওয়ার প্রযুক্তি, টানটান মোচড়ময় মুচমুচে গল্প, সাবলীল অভিনয় এবং শঙ্কর-এহ্সান-লয়-এর মেদহীন মিউজিক। এমন একটা চরিত্র পেলাম (আহা, না হয় একটা ছ’ফুট দু’ইঞ্চি লম্বা মহীরুহের ছায়ায় গড়েই উঠেছে) যে অকারণে চঞ্চল মানে তার মা’র সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার করেনি, তার বোনকে কারও হরমোন তাড়া করেনি, তার হাতে কেউ তার বাবার তস্করবৃত্তির ট্যাটু করে দেয়নি...সে জন্ম ‘দুষ্টু’।
ডন ২
শাহরুখ, প্রিয়াঙ্কা, বোমান
তাই যখন আবার এই চরিত্রের কাণ্ডকারখানা দেখার সুযোগ হল, এবং তাও একটা মৌলিক সিক্যোয়েলে লাফাতে লাফাতে গিয়েছিলাম ডন-বৈঠকে শামিল হতে। গিয়ে দেখলাম, আরও অনেক কিছু পাল্টেছে। শ্রদ্ধেয় ইথান হান্ট কিংবা মাননীয় ড্যানি ওশান-এর কথা মাথায় রেখেই বলছি প্রোডাকশন ভ্যালু বা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে, ‘ডন ২’ প্রায় হলিউড ছুঁইছুঁই। প্রিয়াঙ্কা-শাহরুখের গাড়িতে চোর-পুলিশ খেলা, শাহরুখের বহুতল ঝাঁপ, বোমান ইরানি এবং কোং-এর সঙ্গে কুমিরডাঙাপ্রতি সিকোয়েন্সে আভিজাত্যের ছাপ, সূক্ষ্ম সিনেমাকর্মীর হাতের নজির, এবং বুদ্ধিমান বিনিয়োগের গন্ধ।
কিন্তু গল্প কী বলছে, গল্প?
নাহ্, ব্যক্তিগতভাবে সে রকম কিছু বলল না। অসংখ্য বিদেশি ব্যাঙ্ক ডাকাতি, একগুচ্ছ অসম্ভব মিশনের মিশেলআর রান্নায় একটু নুন কম ছিল। আসল ভিডিও ফুটেজ ছাপিয়ে রেকর্ডেড ফুটেজ দেখানো থেকে শুরু এমন অনেক কিছুই দেখলাম যা আদম হওয়ার সময় থেকেই নিপুণ ব্যাঙ্ক ডাকাতরা আমাদের দেখিয়ে আসছেন। গল্পের প্রতি বাঁকে একটা দেজ্য ভু-তে গিয়ে নস্টাল হয়ে পড়ছিলামচেনা আলো, অচেনা অন্ধকার।
সেটা কি ভাল, না খারাপ?
মানে, সেটা নির্ভর করছে। একটা আদ্যোপান্ত অ্যাডভেঞ্চার ছবিতে যদি আপনি গল্পের অভিনব মোচড় না খোঁজেন, যদি নাগরদোলার চিরাচরিত চক্রাকারেই আপনি রস খুঁজে পান, তা হলে ‘ডন ২’এর চলন আপনার ভাল লাগবে। একটা আশ্বাস আছে, আপনি ঠিক যেমনটি চাইছিলেন তেমনটিই হচ্ছে। কিন্তু আমার মতে সংলাপের ক্ষেত্রে বোধহয় সেটাও প্রযোজ্য নয়। কারণ ফারহান আখতারের কাছ থেকে আমার অন্তত আরও অনেক প্রত্যাশা ছিল। আদি ‘ডন’-এ “মুঝে উসকে জুতে পসন্দ নহি থে”র যে মারকাটারি হিউমার সেটা ছেড়েই দিলাম, শাহরুখ খানের ‘ডন’-এর সংলাপের ধারও খুঁজে পেলাম না। যেটুকু পেলাম তা বড়ই ক্ষণস্থায়ী, বড়ই সিচুয়েশনাল, এবং হয়তো অভিনেতার ইম্প্রোভাইজেশনের ফল। শঙ্কর-এহ্সান-লয়-এর সঙ্গীতও আহামরি কিছু নয়, বরং আবহ অনেক বেশি জোরালো। আর আমার শেষ নালিশ, বা বলা ভাল, ১৭ বছর বয়সী সেই অ্যান্টিহিরোর গুণগ্রাহী সৃজিতের নালিশ ডনের চরিত্রায়ণের শেষে ওই সাদা ছোপছোপ, ডন বলে কি মানুষ নয় গোছের মানবিক উত্তরণটা হয়তো পরিহার্য ছিল। জানি, ধূসর রঙের জবাব নেই, কেউ সম্পূর্ণ সাদা বা কালো হয় না, কিন্তু যেহেতু সব চরিত্র কাল্পনিক, মন্দ কী, যদি আমরা মাঝে মাঝে কুচকুচে হয়ে যাই? সেটাকে সেলিব্রেট করি? বিশ্ব ক্রিকেটে প্রকৃত ফাস্ট বোলারের মতো বিশ্ব সিনেমায় প্রকৃত কালো চরিত্রের সংখ্যাও এখন বিরল। এই বাজারে, যখন এমন একটা দুর্ধর্ষ অন্ধকার মনের হদিশ পাওয়া গেছে তাকে একটু কাল্টিভেট করলে হত না মশাই? মানে, ‘জোকার’রূপী হিথ লেজারের চোখ কারওর জন্য ছলছল করে উঠুক, এটা কি আমরা সত্যিই চাই? কিংবা, মগনলাল মেঘরাজ, লালমোহনবাবুকে অর্জুনের খেলা না দেখিয়ে সস্নেহে ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছে দিক?
তা হলে ‘ডন ২’ কি দেখবেন না আপনারা? নিশ্চয়ই দেখবেন। এবং তার তিনটে কারণ। এক, শীতকালে সার্কাস এবং চিড়িয়াখানার মতো সিনেমা দেখতে যাওয়াটাও একটা সুস্থ অভ্যেস। মন চনমনে থাকে, সেকেন্ড জানুয়ারির অসহ্য আপিসের অবসাদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়ে, বন্ধুত্বের ডগায় ঝুলতে থাকা কিছু প্রেমও নেমে যেতে পারে। দুই, এই রিভিউটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত, যেটা ফুচকায় ঠিক কতটা লঙ্কা পড়লে সেটা ঝাল উপাধিতে ভূষিত হওয়ার মতোই আপেক্ষিক। তিন, শাহরুখ খান।
কারণ তিনি স্বয়ং অ্যাটলাসের মতো ছবিটিকে স্বমহিমায় বহন করেন। বহু দিন পর তাঁর চোখে দেখি সেই ’৯০-এর ঝিলিক। তাঁর ঠোঁটে সেই হাড়কাঁপানো, চোখধাঁধানো বাঁকা হাসি। চিত্রনাট্য ও সংলাপের যেটুকু রসদ ছিল, সব নিংড়ে নিয়ে শাহরুখ খুব অনায়াসেই সৃষ্টি করেন এমন এক চারিত্রিক অবয়ব, যা এই মুহূর্তে মুম্বইয়ের অন্য কোনও অভিনেতার পক্ষে করা বোধহয় সম্ভব নয়।
মানে অবশ্যই শুধু সেই লোকটাকে বাদ দিয়ে।
কোন লোক? ওই যে, যার ক্যারিশ্মাকে ধরা, ‘মুশকিলই নেহি, না মুমকিন হ্যায়’।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.