|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় গল্প |
ফিরে আসা |
দীপঙ্কর পাঠক |
গণেশ বলল, তোমাদের সেক্রেটারি কে? লোকটি বলল, সে যে-ই হোক, বৃষ্টি পড়লে পাঁচ টাকা এক্সট্রা লাগবে। রাগ করবে না হাসবে বুঝতে গিয়ে গণেশের খানিকটা সময় লাগল। রিকশাওয়ালাটিকে ও চেনে, লোকটার নাম সুশীল দাশ। নতুন আবাসনের গা ঘেঁষে যে জায়গাটা এখনও বস্তি মতোই থেকে গেছে, সেখানেই থাকে। গণেশকে ও চিনতে পারেনি। মোড়ের আলোটা আবছায়া হয়ে ঝুলে আছে, সেখান থেকে নতুন শাসকদের ফ্ল্যাগ ঝুলছে। ফ্ল্যাগের ফিলটারে আলো আরও মলিন। রিকশাটার হ্যান্ডেলেও সেই পতাকা। তাই গণেশকে চিনলেও সুশীল এ কথাই হয়তো বলত। কারণ, এখন তো আর গণেশকে সমঝে চলার কোনও কারণ নেই। পরিস্থিতি পরিবর্তিত।
ভাবতে গিয়ে কী রকম হাসি পেল গণেশের। ওর পার্টিই কত দিন এ কথা বলে গিয়েছিল, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’। এক দিন যারা পরিবর্তনের কথা বলত, পরিবর্তনের হাওয়ায় তারাই কী রকম উড়ে গেল। এ রকমই বোধ হয়। ভাবতে ভাবতেই এক দু’ফোঁটা বৃষ্টি এসে গায়ে পড়ল। আবার হাসি পেল গণেশের। কী ভাবে দেখবে ও ব্যাপারটা, ওর দিক থেকে দেখলে তো বলতে হবে, ‘কপাল যদি মন্দ হয়, মেঘ না হলেও বৃষ্টি হয়’, আবার সুশীলের দিক থেকে দেখলে, ‘কপাল যদি ভাল হয়, মেঘ না হলেও বৃষ্টি হয়’। সুশীল একটু অধৈর্য হয়ে উঠছিল বোধ হয়। বলল, কী হল যাবেন, না যাবেন না? ওর হাতে কিন্তু আর কোনও প্যাসেঞ্জার এই মুহূর্তে নেই। এই অধীরতাটা আসলে আহত অহং প্রসূত। একটা কিছু চেয়ে না পেলে যে চায় তার যে ভারী অপমান। আবার হাসি পেল গণেশের, এই বাংলায় কেউ ভাবে, ‘আহত অহং প্রসূত’? সেই কোন কালে বাংলা নিয়ে পাশ করেছিল, শঙ্খ ঘোষের কবিতা ভালবাসত, সেই পাপ আজও ছাড়েনি। বলল, ‘দাঁড়ান ভাই, একটা সিগারেট ধরিয়ে নিই। বৃষ্টি যখন নেমে গেছে, ভাড়া তো বেশি পাবেনই। এক মিনিট’। সুশীল এখন শান্ত। কারণ, পাঞ্জার লড়াইয়ে আপাতত ওই জয়ী। গণেশের আশ্চর্য লাগল যে সুশীল এখনও ওকে চিনতে পারছে না। অথচ ও যখন এল সি এস ছিল, রিকশা বের করতে সুশীল ওর হাতে পায়ে ধরেছিল। কাঠগোলার ভবেন দত্তকে ধরে গণেশই একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সুশীল একটা বিড়ি বের করল। লাইটার দিয়ে গণেশ সিগারেট ধরাতে সেও মুখটা বাড়াল। লাইটারের আলোয় সুশীলের মুখের শিরা আর দাগগুলো কী রকম স্পষ্ট হয়ে উঠল। গণেশের মনে পড়ল, এক সময় নিজের মধ্যবিত্ত দাগহীন ফর্সা মুখটা নিয়ে কী লজ্জাই ছিল ওর। প্রথম যখন ছাত্র আন্দোলন থেকে ইউনিয়নের কাজে আসে, রোলিং মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের লোকগুলোর মুখ দেখে কী রকম রোমাঞ্চ হত। মনে হত জীবন কত দাগ কেটে যায় ওই মুখে, আর নিজের জীবনটা কী রকম নিরামিষ। বড্ড বোকা বোকা ভাবনাই হয়তো ছিল। কিন্তু পেকে যাওয়াটাও তো বড় কষ্টের। পাকা বুদ্ধির মানেই তো হল সব কিছুর পেছনের নোংরা দিকটা দেখতে শেখা। সেটাও কি খুব সুখের?
বৃষ্টিটা জোরে নেমেছে। এখনকার বেশ কিছু রিকশার মতো এটাতেও হুড রিকশাওয়ালার মাথা অবধি টানা। গণেশের মনে হল, এক অর্থে এই সম্মানটা কি ওর পার্টির দান নয়? আগে তো রিকশাওলা ভিজছে কিনা তাই নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। রিকশাওলাও না। পর্দা দিয়ে প্যাসেঞ্জারদের ঢেকে নিজে ভিজতে ভিজতে চালিয়ে যেত ওরা। শুধু গরিব বলে মানুষের থেকে কী রকম অশ্লীল আদর আদায় করে বড়লোক আর মধ্যবিত্তরা। একটা লোক রিকশা চালায়, সে কেন আমাকে ও রকম ব্যক্তিগত যত্নে ঢেকে দেবে? হঠাৎ অধীরদার কথা মনে পড়ল গণেশের। অধীরদা বলতেন, আমাদের পার্টি হয়তো বেশি কিছু করতে পারেনি বুঝলে, কিন্তু ওই ছোটলোকগুলোর আস্পর্ধা বাড়িয়েছে। সাতাত্তর সালের আগে গরিব মানুষরা আমাদের দেখলে কুঁকড়ে যেত, এখন আর যায় না। এটা কিন্তু পঞ্চায়েত আর বর্গার দান, সেটা কেউ স্বীকার করুক আর না করুক। ভেবে মজা লাগল গণেশের। এই আস্পর্ধায় আমার মুক্তি আলোয় আলোয়? সেই আস্পর্ধা আবার কী সহজে দল পাল্টে অন্য দিকে চলে গেল। পরিবর্তন মানে কি শুধু ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান?
রিকশা চলছে। মেয়েদের ইস্কুলটা পেরিয়ে গেল, মাঠটা আসবে এ বার। রাত বোধ হয় এগারোটা হবে। মিতুন আবার রাগ করবে। মাসে এক বার আসো বাবা, তাও এত রাত করে? রুমা কিছু বলবে না। গত কুড়ি বছরই আর কিছু বলেনি। বলা প্রয়োজন মনে করে না আর। আসলে ওর রাজনীতি আর ওকে এক সঙ্গেই অবান্তর বলে বাতিল করে দিয়েছে জীবন থেকে। শুধু সেই একটা দিন! কিন্তু একটা দিন কি আবার সত্যিই কিছু পাল্টায়? গণেশ ভাবে তাই কি ও পালিয়ে গিয়েছে? দল থেকে, রুমার থেকে, মিতুনের থেকেও? সবচেয়ে কঠিন আর কষ্টের কি এই মিতুনের কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়া? এক জন বাবা যদি সন্তানকে কিছুই দিতে না পারে, দামি খেলনা না হোক একটা অমূল্য আদর্শ, তা হলে সে কী করে সেই সন্তানের সামনে দাঁড়ায় কেউ জানে কি? |
|
তাই কি তমালকাকু যখন বললেন, তোর দলে তো সবাই গুছিয়ে নিল, তুই তো কিছুই পারলি না। এখন এই পঞ্চাশ বছর বয়সে তোর কোনও চাকরিও হবে না। মালদায় চলে আয়। আমার ব্যবসাগুলো দেখ, আম বাগান আছে, গাড়ি ভাড়ার ব্যবসাটা আছে, একটা কমপিউটার সেন্টারও খুলেছি। তোতে আমাতে দেখব, থাকা খাওয়া ফ্রি, মাস গেলে হাজার দশেক টাকা জমিয়ে ফেলবি, মেয়ের জন্যে। যখন খুশি বউ মেয়েকে দেখে আসবি। আর কী চাস? প্রমোটার যখন হতে পারলি না তখন ওই পার্টি করে কী হবে? সবচেয়ে বেশি কানে লেগেছিল ওই পঞ্চাশ বছর কথাটা।
সিগারেটটা ফুরিয়ে এসেছিল। শেষ টানটা দিতে গিয়ে ঠোঁটটা কী রকম জ্বালা করে উঠল। পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল ওর। পঞ্চাশ! শালা, সত্যিই তো। ১৯৬০ থেকে ২০১১। পঞ্চাশই তো। এখন তো আরও এক বেশি একান্ন। এতগুলো বছর এ ভাবে কেটে যায়? কিছুই না হয়ে? এই তো চোখের সামনে ওর জীবনটা ফুটে উঠছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৭। কলেজে ভর্তি হওয়ার বছর। সে তো এক পরিবর্তনের বছরই ছিল। মনে আছে অনিমেষদার সেই উজ্জ্বল চোখ দুটো। ছাত্র সংগঠনের সদস্য করতে গিয়ে রুমার সঙ্গে আলাপ। রুমা বলেছিল, আপনার কি মনে হয় দিন বদলাবে? বদলাল তো। ১৯৭৭ থেকে ২০১১ কত বার কত রকম বদলাল। বদলে গেল সে, বদলে গেল রুমা। বদলে গেল ওদের দু’জনকে জড়িয়ে থাকা সব কিছু। কিন্তু সত্যি কিছু বদলাল কি? পোস্টার মারতে গিয়ে মার খেয়েছিল গণেশ। রুমা ওকে ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়েছিল। সেই প্রথম হাত ধরেছিল ওরা। তার পর এল বিধানসভা নির্বাচন। সে কী উন্মাদনা। মোড়ের সব আলোগুলো লাল হয়ে গেল।
এক জন মানুষ কিন্তু শাপ দিয়েছিলেন। কিঙ্করকাকু। বলেছিলেন, যে দলের সঙ্গে যাচ্ছিস গণা, সেই দল বিশ্বাসঘাতকের দল। তেভাগা থেকে নকশালবাড়ি ওরা কেবল পিছিয়ে এসেছে। ওরা চায় মন্ত্রী হতে, গাড়ি চড়তে, তোদের মতো ইম্প্রেশনেবল বাচ্চাদের আজেবাজে বুঝিয়ে গদিতে চাপতে। ইতিহাস পড়, ইতিহাস পড়। অনেক সময় আছে, দলে ঢুকিস না। কিন্তু তখন কিঙ্করকাকুর কথা শোনার সময় ছিল না গণেশের। ও তখন কলেজের ভোটে দাঁড়িয়েছে। পোস্টার লেখার সময় রুমা কী রকম নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে লেখে। চোখ ফেরানো যায় না। ময়দানে লাল পতাকা। অনিমেষদা বলছেন, এই আমাদের সময়। এই বার সরকারকে যেতে দিলে পশ্চিমবঙ্গ শেষ হয়ে যাবে। এই সরকারকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। বর্গা আন্দোলন আসবে, বন্ধ কলকারখানা খুলবে, শ্রমিক কৃষকের সঙ্গে থাকাই আমাদের কাজ।
রুমার সঙ্গে বিয়েটা কিন্তু ঘটা করেই হয়েছিল। রুমার বাবা বলেছিলেন, আমার একটা মাত্র মেয়ে। ছেলে বেকার বলে তো আমি ভিখিরির মতো বিয়ে দিতে পারি না। আগুন জ্বেলে খই ছড়িয়ে বিয়ে। এমনকী শয্যা তুলুনির টাকাও পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল রুমা। রুমার কলেজের চাকরিটা হয়ে গিয়েছিল নিজের জোরেই। কিঙ্করকাকু বলেছিলেন, ব্যক্তিজীবনেও তোরা সব মেনে নিতে শুরু করলি, আমাদের সময় কমিউনিস্টদের বিয়েটা অন্তত অন্য রকম হত। তোরা যা বিশ্বাস করিস, পালন না করলে বিপ্লবটা করবি কী করে?
এসে রিকশাটা এসে থামল স্ট্যান্ডে। গণেশদের বাড়িটা উল্টো দিকের গলিতে একটু ঢুকে। সাধারণত গলিটায় নিয়ে যায় গণেশ। কিন্তু যে স্টাইলে সুশীল ব্রেক মেরে একটু ত্যারচা করে রিকশোটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করাল তাতে গণেশ বুঝল, অশান্তি বাড়িয়ে লাভ নেই। ১২ টাকা আর ৫ টাকা এক্সট্রা, মোট ১৭ টাকা হয়। খুচরো নেই তাই কুড়িটা টাকা বের করল গণেশ। সুশীল লুঙ্গি পাশ থেকে তুলে ভেতরে হাত ঢোকাল। গণেশ জানে ভেতরে একটা হাফ প্যান্ট আছে। তার পকেট থেকে একটা খুচরোর ব্যাগ বের করল সুশীল। হঠাৎ গণেশের কী রকম মায়া লাগল লোকটার ওপরে। এই যে লুঙ্গির ভেতরে হাফ প্যান্ট এটা কী রকম একটা রিকশাওয়ালাদের পোশাক, ভদ্র লোকেরা ঠিক এটা পরে না। তা হলে সুশীলের জীবনেই বা কী হল। কত দূর এগোল ও? ভদ্রলোক হতে পারল কি? নাকি একটু আধটু মেজাজ দেখানোর রংবাজিতেই ওর জীবনের এগোনোটাও ফুরিয়ে গেল। টাকা দিতে গিয়ে গণেশের চোখে চোখ পড়ল সুশীলের। চোখটা সরিয়ে নেওয়ার আগে বলল, ‘ও আপনি?’ বলে খুচরোটা ফেরত দিয়ে রিকশাটা ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে রইল গণেশ। সুশীল কি অস্বস্তিতে পড়ল? এক জন লোক, যার হাতে পায়ে ধরে ও রিকশাটা পেয়েছিল, আজকে তার থেকে অন্যায্য ভাবে ভাড়া আদায় করাটা কি অস্বস্তির? সুশীলের কি মনে হল ওর দারিদ্র, ওর এই দিন বদলের মাস্তানির ভেতর লুকিয়ে থাকা গরিবিটা গণেশ জানে, তাই ও পালিয়ে গেল? আসলে এই বদলটা বড্ড ফাঁপা আর গরিব? আর গণেশেরই বা খুশি হওয়ার কী আছে এই অস্বস্তিতে? ৩৪ বছর তো সুশীল ওর কাছেই ছিল, ওর আশ্রয়ে। কী দিতে পেরেছে ও? ভাড়া বেড়ে ৮০ পয়সা থেকে ১২ টাকা হয়েছে এই সময়টুকুতে। সারা দিন ক’টা ট্রিপে কত হয়? ক’টা ছেলে মেয়ে ওর এখন? বউয়ের অসুখ হলে সিটি স্ক্যান করাবে কে?
স্ট্যান্ডে ভাড়ার বোর্ডটা এখনও লাল রঙেরই আছে। নতুন দল এলেও পুরোটা মোছেনি। শুধু নীচে নতুন সেক্রেটারির নামের পাশে ফুলপাতা আঁকা। নামটা দেখল গণেশ শ্যামল কর্মকার, সাধারণ সম্পাদক। কার নাম মুছে গেল? কে ছিল ওদের পার্টির পক্ষ থেকে রিকশা ইউনিয়নের শেষ সেক্রেটারি? নতুন সেক্রেটারির নামটা আর এক বার দেখল গণেশ শ্যামল? শ্যামল তবে এখন বিরোধী দলের রিকশা ইউনিয়নের সেক্রেটারি হয়েছে? সেই শ্যামল, যার জন্যে গণেশেরও দল ছাড়া। রামবাগানের দিকের ছেলে শ্যামল। বিধবা মা ঠোঙা বানাতেন। কলেজে বিরোধী রাজনীতিতে চলে যায়। গণেশদের চেয়ে অনেকটাই ছোট। এখন বছর ৩৫ বয়স হবে। রাস্তায় দেখা হলে কথা বলত। ভাল ছেলে। বলত, গণেশদা, কী করছেন আপনারা বলুন তো। কলেজে নমিনেশন দিতে দিচ্ছেন না। প্রিন্সিপাল সব কথায় এল সি দেখাচ্ছেন। এ সব কী। আপনাকে আর রুমাদিকে দেখে তো আমরা ভাবিনি আপনাদের দল এ রকম হবে। ওর কথা শুনে দলে সেই নিয়ে কথাও বলেছিল গণেশ। এই ভাবে কি দখল রাখা যাবে? অনিমেষদা কী সব বলেছিলেন বিড়বিড় করে লাল সন্ত্রাস আর শ্বেত সন্ত্রাস না কী সব। তত দিনে এই সব শুনে হাসি পেতে শুরু করেছে গণেশের। তবু অভ্যাসে রোজ এল সি গিয়ে বসা। তত দিনে অবশ্য অনিমেষদার দলে বিশেষ কিছু বলারও ছিল না। এলাকার এম এল এ মন্ত্রী প্রশান্ত সেনগুপ্তের ছেলে বুটাই-এর নিজের লোক দুলাল বিশ্বাস এল সির ঠিকা নিয়ে নিয়েছিল। তার পর এক দিন মার খেল শ্যামল। বুটাই লোক দিয়ে মারাল। আদর্শের জন্য মারার ছেলেপুলে দলে আর ছিল না। স্টোন চিপের ব্যবসার একটা দলের ছেলেরা গিয়ে মারল শ্যামলকে।
সেই রাতটা মনে আছে গণেশের। কলেজ ছাড়ার পর থেকেই রুমা সরে গিয়েছিল দল থেকে। অনিমেষদা কিছু দিন চেষ্টা করেছিলেন যোগাযোগ রাখতে, রুমা রাখেনি। কিন্তু আবার গণেশের হোল টাইমার হওয়া নিয়ে কোনও দিন কিছু বলেনি। কত টাকাই বা পেত গণেশ। হাত পাততে হত রুমার কাছেই, তা নিয়ে রুমা কখনও কথাও শোনায়নি। কিন্তু গণেশ বুঝতে পারত পার্টি থেকে দূরে সরে যাওয়ার সঙ্গে ওর আর রুমার মধ্যেও কী রকম একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। শ্যামল যে দিন মার খেল সে দিন সন্ধে বেলা রুমা বাড়ি ফিরে এল। মনে আছে গণেশের, খুব উত্তেজিত ছিল রুমা সে দিন। ‘কী শুরু করেছ তোমরা? শ্যামলকে মেরেছ কেন? কংগ্রেসি গুন্ডাদের সঙ্গে কোনও তফাত রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না তোমাদের? কেন তবে সবাইকে ঠকালে? কেন আমাকে ঠকালে, কেন বলেছিলে, কেন ভাবিয়েছিলে যে অন্য রকম কিছু হবে?’ গণেশ জানত রুমার মায়ের বন্ধু ছিলেন শ্যামলের মা। ছোট বেলায় রুমা আর শ্যামল এক সঙ্গে মানুষ হয়েছিল। রাজনৈতিক দূরত্ব সত্ত্বেও সেই সম্পর্কটা ছিল। হিসেব মতো হয়তো আবার একটা তর্ক শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তর্ক হয়নি। কী রকম একটা গোঙানির মতো কান্না কেঁদেছিল রুমা। সেই কান্নায় কেমন একটা হিমবাহ বয়ে গিয়েছিল গণেশের শরীরের মধ্যে দিয়ে। সেই কান্নাটা যেন একটা অজাত মানুষের কান্না, কী রকম একটা ক্ষয়ের কান্না। আসলে যেন দুটো সতেরো আঠারো বছরের জীবন বহু দূর বয়ে গিয়ে নোংরা কোনও পাঁকে আটকে যাওয়ার কান্না। যে কান্না জানে আর কিছু হবে না। কোনও দিন না। হাজার কাঁদলেও না। বুকের মধ্যে অনেক দিন বাদে রুমাকে টেনে নিতে গিয়ে গণেশ বুঝেছিল তার বুক থেকেও ওই রকমের একটা আর্তনাদ উঠে এসেছে। অনেক দিন বাদে তারা দু’জনে দু’জনকে খুঁজেছিল। সেই রাতেই মিতুনের সঞ্চার হয়। সাবধানতা ছিল না। কারণ, অনেক দিন অসাবধানতাও ছিল না।
পর দিন সকালে উঠে গণেশ দলে গিয়ে বলেছিল, শ্যামলকে মারাটা ঠিক হয়নি। বুটাইরা অপমান করেছিল বিচ্ছিরি করে। অনিমেষদার মুখ দেখে গণেশ বুঝেছিল ওঁর আর বিশেষ কিছু করার নেই।
দরজায় বেল বাজাল গণেশ। রুমা এসে দরজাটা খুলল। কথা বলল না। টিপটিপ বৃষ্টিতে একটু ভিজে গেছে গণেশ। ছাতা নিয়ে কোনও দিন বেরোয় না ও, কারণ সে ছাতা আর ফেরত আসে না। মিতুন ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা তোয়ালে নিয়ে এসেছে রুমা। হাত বাড়িয়ে নিয়ে মাথা মুছে নেওয়ার কথা গণেশের। কিন্তু ও মাথাটা বাড়িয়ে দিল। রুমা কি একটু অপ্রস্তুত?
চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গণেশ টের পেল, দুটো হাত ওর মাথার ওপর ঘুরছে, ঘুরছে। আর কি রকম একটা নির্ভরতায় চোখ দুটো বুজে আসছে ওর। মিতুনের মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল। মেয়েটা স্বপ্ন দেখছে নাকি? পরিবর্তনের?
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|