|
|
|
|
|
|
|
দৌড়, দৌড় |
ধাওয়া করেন দিগন্তকে। প্রিয় ছবি ‘থ্রি ইডিয়টস’। অতীব সফল, কিন্তু ব্যর্থতাকে ভয় পান না মোটেই।
চলেন নিজস্ব ব্যাকরণে। মুখোমুখি সাবির ভাটিয়া। আলাপে শোভন তরফদার
|
ফেরারি এফ ওয়ান, বিল গেটস, সিলিকন ভ্যালি, মুঠো মুঠো ডলার এই সব মিলেমিশে যখন খুব ঝকঝকে একটা বস্তু তৈরি হয়, যাকে আমরা ‘গ্ল্যামার’ বলে ডাকি, তখন সুবর্ণগোলকের মতো সেই জিনিসটা গড়াতে গড়াতে যে দিকে খুশি এগিয়ে চলে। আমরা খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। আর যখন সেই জিনিসটাই গড়াতে গড়াতে এসে তাঁর পায়ের কাছে থামে, আর তিনি, সাবির ভাটিয়া, যেন সেই ‘গ্ল্যামার’ বস্তুটাকে দেখতেই পাননি, এমন ভাবে হাতটা এগিয়ে হেসে বলেন, হাই, আই অ্যাম সাবির, তখন আমরা আরও অবাক।
আজ, পয়লা জানুয়ারি, জন্মদিন পেরিয়ে ঠিক দু’দিনের মাথায় সাবির আরও একটা নতুন বছর শুরু করবেন, আরও কিছু ‘আইডিয়া’-র জন্ম হবে, কিছু হারিয়ে যাবে, অথচ সেই চলা এবং থামার মাঝখানে তাঁর নিজস্ব গতিটি ঝাপসা হবে না।
‘বিলিয়নেয়ার’ মানে অভিধানে যা যা লেখে, আমরা জানি। যা যা লেখে না, কিন্তু যা যা হয় বা হতে পারে বলে আমরা ধরে নিই, সে সবও জানি। মুশকিল হল, সেই ধাঁচে এঁকে ফেলা শক্ত। কই, এঁর মাথার পিছনে সেই গোল মতো একটা আলো নেই তো! কালো চশমা-পরা ধূর্ত, ক্ষিপ্র এবং অসম্ভব সুন্দর (বা সুন্দরী) দেহরক্ষী নেই। হাতের কাছে লুকোনো সুইচ নেই যাতে আঙুলের সামান্য স্পর্শে আমার পায়ের নীচে স্বয়ংক্রিয় মেঝে সরে যাবে...
অথচ তিনি, সাবির ভাটিয়া, দিব্যি আছেন। ততটাই স্ফূর্তিতে আছেন, যতটা নিয়ে বছর ষোলো-সতেরো আগে তিনি ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের দোরে দোরে ঘুরেছিলেন, আর অনেকেই ভেবেছিল, নির্ঘাৎ পাগল, না হলে লোকজনকে বিনি পয়সায় ই-মেল পরিষেবা দেওয়ার জন্যে কেউ টাকা চায়!
বাকিটুকু না বললেও চলে। বা, খুব সংক্ষেপে সাবিরেরই প্রিয় একটি শব্দবন্ধ দিয়ে বলে দেওয়া যায়।
‘কিলার আইডিয়া’!
এই ‘কিলার আইডিয়া’ ভালবাসেন বলেই কি ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবি এবং সেখানে ‘র্যাঞ্চো’ নামের একটি চরিত্র তাঁর এত প্রিয়?
ওই ছবিটা আমার খুব প্রিয়, কারণ ওর মধ্যে আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থাটা নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলা হয়েছে, খুব সঙ্গত কিছু প্রশ্ন, যেগুলো তোলা দরকার...
ঠিক, ‘র্যাঞ্চো’ খুব প্রশ্ন করত।
মাঝে মাঝে দেখবেন, খুব সাদামাটা কিছু প্রশ্ন, হঠাৎ শুনলে মনে হবে কিছুই না, কিন্তু তারই উত্তর দিতে গিয়ে বোঝা যায়, যে জিনিসটা দারুণ রকম জানি বলে ভাবতাম, আসলে সেটা মোটেই ততটা জানি না, অনেক ধোঁয়াশা আছে... তাই প্রশ্নগুলো তোলা খুব জরুরি।
শুধু এই জন্যেই জরুরি? নিজের ধোঁয়াশাটুকু সরিয়ে ফেলার জন্য?
পলকের জন্য সাবির ভাটিয়ার সহাস্য মুখ কঠিন হল, জরুরি, কারণ এই গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটার আর কিছু নেই, ইটস ব্রোকন, বস্তাপচা কিছু ধারণা জোড়াতালি দিয়ে চলছে... আমি সেটা বুঝেছিলাম বহু দিন আগে। ক্যালটেক-এ গিয়ে। প্রায় কালচার শক-এর মতো ব্যাপার!
কী রকম?
‘পরীক্ষা’ বলতে আমরা কী বুঝি? গাদা গাদা মুখস্থ করো, তার পর পরীক্ষার হল-এ গিয়ে যতটা পারো উগরে দিয়ে এসো। ক্যালটেক-এ গিয়ে দেখলাম, পরীক্ষার সময় যত ইচ্ছে বই আর নোটস-টোটস নিয়ে এসো। কেউ কিচ্ছু বলবে না! মনে হল, এ কী রে বাবা! বই খুলে পরীক্ষা! তার পর দেখলাম, এমন সব প্রশ্ন করা হচ্ছে, হাজার বই আর নোটস খুলে রেখেও যার উত্তর দেওয়া যাবে না। কথাটা হচ্ছে, বিষয়টা আপনার মধ্যে ঢুকেছে কি না, আপনি সেই জিনিসটাকে নিজের মতো করে প্রয়োগ করতে পারছেন কি না! মাথার মধ্যে গাদাগুচ্ছের প্রশ্ন-উত্তর জমিয়ে রেখে কী হবে? যে কোনও দিন, যে কোনও সময় আমার-আপনার থেকে একটা কম্পিউটার অজস্র গুণ বেশি মনে রাখতে পারে। ইন্টারনেট খুললে তো সব কিছুই জানা যায়। তাতে কী?
তাতে যে কিছু না, তা ‘র্যাঞ্চো’ জানত। সাবির ভাটিয়াও জানেন। ‘র্যাঞ্চো’, আসলে চিন্তার স্বাধীনতা দাবি করেছিল। সাবিরও তাই। ‘স্বাধীনতা’ তাঁর খুব প্রিয় শব্দ। এতটাই, ‘হটমেল’ আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল ৪ জুলাই, ১৯৯৬; (‘বর্ন অন দ্য ফোর্থ অব জুলাই’ নামে অলিভার স্টোনের সেই সুখ্যাত ছবিটি তিনি দেখেছিলেন কি না, সেই প্রশ্ন আর করা হয়নি, কারণ সাবির তার আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, সিনেমা যে খুব দেখেন তা নয়, তবে হলিউডের একটি ছবি তাঁর ভাল লেগেছিল। সেই ছবিটি, ‘মাই কাজিন বিনি’, ১৯৯২-এর ছবি, তার পর প্রায় দু’দশক ধরে আর কোনও হলিউড সাবিরকে স্পর্শ করেনি)।
‘হটমেল’ যদিও স্বাধীনতাই নিয়ে এল নেট-বুভুক্ষু জনতার কাছে, পরিণামে সাবির ঈষৎ পরাধীন হয়ে পড়লেন। এমনিতে ব্যাপারটা বিশেষ খারাপ নয়। অন্তত অর্থনৈতিক দিকে তো নয়ই। আত্মপ্রকাশের দু’বছরের মধ্যে বিল গেটস নামে এক ভদ্রলোক ‘হটমেল’ পরিষেবাটি কিনে নিলেন। ‘মাইক্রোসফট’-এ এলেন সাবির, এবং তাঁর সেই পরাধীনতা শুরু হল। ‘চাকুরি’ সম্বন্ধে তিনি বরাবরই নিস্পৃহ। বছর সাতাশ বয়েসে ঝুলিতে ক্যালটেক আর স্ট্যানফোর্ডের ডিগ্রি ভরে যখন অশ্লীল রকম বেশি একটা মাইনে পাচ্ছেন (‘অবসিন মানি’, সাবির উবাচ), তখনই ঠিক করলেন, ঢের হয়েছে, আর নয়। দুই বন্ধু, সাবির এবং জ্যাক স্মিথ মিলে ঠিক করলেন, নতুন কিছু করা চাই। ধরা যাক, এমন একটা ই-মেল বানাতে হবে যা যে কোনও লোক দুনিয়ার যে কোনও জায়গা থেকে ব্যবহার করতে পারে। নিখরচায়। ফলস্বরূপ ‘হটমেল’ নামের সেই যুগান্তকারী পরিষেবা! তার পরেও ফের সেই চাকরি!
অস্থির সাবির মাইক্রোসফট ছেড়ে দিলেন অচিরেই। কেন ছেড়ে দিলেন, সেই গল্প অনেকে জানেন। অনেকেই জানেন না, সাবির ভাটিয়া সটান বলেছিলেন, বিল গেটস কোনও এক কালে অঁত্রেপ্রেনর ছিলেন বটে, কিন্তু আজকাল তিনি মূলত ‘স্টেটসম্যান’, উদ্যোগ-টুদ্যোগ নিয়ে উনি আর ভাবেন না। ও সব এখন স্টিভ বামার-এর দায়িত্ব!
সিলিকন ভ্যালিতে বসে ‘দেব’-নিন্দা! সাবির ভাটিয়া ঈষৎ তাচ্ছিল্য জড়িয়ে বললেন, হুঁ, বলেছিলাম। সত্যি কথা বলেছি। কী হয়েছে?
বললাম, আপনি এও বলেছেন যে, মাইক্রোসফট চালান যিনি, সেই স্টিভ বামার কাজ জানেন ভাল, কিন্তু ওইটুকুই, তার বেশি কিছু নয়!
ঠিকই তো। স্টিভ বামার খুব কর্মঠ, মাইক্রোসফট-এ আছেন বহুকাল, কিন্তু উনি ‘ভিশনারি’ নন। আবার এই ‘ভিশন’ জিনিসটা ছাড়া প্রডাক্ট টেকনলজিতে আপনি দাঁড়াতে পারবেন না।
‘ভিশন’টা তা হলে কী? দেখতে পাওয়া যায় বুঝি?
একদম, সাবিরের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বললেন, দেখতে পাওয়া যায়। সবাই পায় না। কেউ কেউ পায়।
স্টিভ জবস পেতেন?
সাবির ভাটিয়া হাসলেন। তাঁর মুণ্ডিতমস্তক উপস্থিতি আরও একটু দ্যুতিমান হল, উল্লেখমাত্রে কথাটা ধরে নিয়ে সাবির বললেন, হি ওয়জ আ ‘ভিশনারি’। না হলে খাদের ধারে চলে যাওয়া একটা সংস্থাকে কেউ ওই ভাবে দাঁড় করাতে পারে। আর দাঁড় করানো মানে কী? একেবারে ‘ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ভ্যালুড কোম্পানি’!
কিন্তু, সেই বৃত্তান্ত তো অনেকেই জানে! আলাপের গতিমুখটা একটু ঘুরিয়ে বললাম, ওই যে বিল গেটসের কথা হচ্ছিল। আপনি মাইক্রোসফট-এ এলেন, বছরখানেকের মধ্যে ছেড়েও দিলেন, বললেন, পোষাচ্ছে না...এও তো মারাত্মক!
না পোষালে কী করব? বলতে তো হবে, এক সময় না এক সময়! তাই বললাম।
তাই বলে মুখের ওপর বলে দেবেন যে, মাইক্রোসফট-এর শম্বুক-গতির কাজকর্ম পছন্দ নয়। চললাম!
আরে, মাইক্রোসফট-এ গিয়ে দেখলাম, সকাল ন’টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত একটাই কাজ। অজস্র মিটিং। আরে, সারাক্ষণ এত মিটিং-ই যদি করব, তা হলে কাজটা করব কখন?
কাজ-ই তো করছেন।
উঁহু, করছি না। দেখুন, একটা সোজা কথা সোজা ভাবে বলা দরকার। কয়েকটা বেতনভোগী ম্যানেজার দাঁড় করিয়ে পুরনো ধাঁচের ব্যবসাপত্র চলতে পারে, তারা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবে, যা বলবেন ঠিকঠাক করে দেবে, কিন্তু প্রডাক্ট টেকনলজিতে এটা চলে না। আপনি দশটা ম্যানেজারকে ছোট একটা ঘরে ডেকে বলতে পারেন না, মশাইরা, নতুন কিছু একটা বানিয়ে ফেলুন দেখি...! মিটিং-ই হবে, কাজের কাজ কিছু হবে না।
কিন্তু, বড় বড় কোম্পানি মিটিং-টিটিং ছাড়া চলবেই বা কী করে?
চলে না বলেই তো বড় কোম্পানি থেকে সাধারণত খুব বড় কোনও আইডিয়া বেরোয় না!
তা অবশ্য ঠিক, গ্যারাজ থেকে ‘অ্যাপল’, ডর্ম থেকে ফেসবুক...
রাইট! ছোট সংস্থার হাতে গোনা কয়েকজন, বা কেউ হয়তো একাই নতুন কিছু একটা বের করে। তার পর বড় কোম্পানি সেটা নিয়ে নেয়, তার পর সেটাকে অনেক বড় করে...কিন্তু শুরুটা ওই ছোট থেকেই হয়...
কিন্তু, ‘কিলার আইডিয়া’টা কী?
সাবির ভাটিয়া নতুন করে আর হাসলেন না, মুখটা আগের মতোই সামান্য হাসি-হাসিই রইল, বললেন, অন্যেরা কোনও একটা সমস্যা পাকিয়ে ফেলবে। আপনাকে সেটার সমাধান করতে হবে। পারলেন তো থাকলেন, নয়তো... । হটমেল সেটা পেরেছিল। বিল গেটস এখনও বলেন, ওঁর জীবনে সবথেকে সফল অধিগ্রহণ একটাই। ‘হটমেল’!
বিল গেটসের প্রসঙ্গ উঠতেই আড্ডার ছেঁড়া একটা সুতো ফের হাতে এসে গেল, বললাম, ওই যে মাইক্রোসফট ছেড়ে দিলেন...
দিলাম, কারণ দেখলাম যে ওখানে নতুন করে কিছু ভাবা খুব কঠিন। ছোট জায়গায় কী হয়? কয়েকজন মিলে কিছু একটা ভাবা হল, তার পর সেটা করে ফেলা হল। আপনাকে দু’একটা জিনিস নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। গট টু লিভ উইথ ইট। কাজটা করতে গিয়ে হয়তো দেখা গেল, বাজারের পরিস্থিতিটা তত দিনে বদলে গিয়েছে, তৎক্ষণাৎ গোটা জিনিসটা ফের খতিয়ে দেখা, প্রয়োজনে কিছু পরিবর্তন...
সে তো সবাই করে। নিশ্চয়ই মাইক্রোসফটও করত।
করত। কিন্তু, ওখানে সে এক লম্বা প্রক্রিয়া। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হতে হতেই সময় কাবার। ওটা আবার আমার আসে না। আমি একটু ছটফটে টাইপের। কাজ করছি। দেখতে চাই, কাজটা হচ্ছে, বা হচ্ছে না! হলে কেন হচ্ছে, না হলে কেন হচ্ছে না। একটা কোনও ফলাফল দেখাটা আমার কাছে খুব জরুরি। তাই, মাইক্রোসফট-এ বসে বসে মিটিং করা আমার কাছে সুবিধের ঠেকল না।
অর্থাৎ, গতি ভালবাসেন। সেই জন্যেই কি একটা ফেরারি এফ ওয়ান থ্রি ফাইভ ফাইভ আপনার গ্যারাজে?
সাবির ভাটিয়া খুব হাসলেন। বললেন, না, ফেরারি আছে বটে, কিন্তু সেটা ওই ‘র স্পিড’-এর জন্য নয়। যে কোনও খুব যত্ন করে ফিনিশ করা জিনিসই আমার ভাল লাগে। ফেরারি গাড়িটা সে রকমই।
আর ‘স্কি’ করেন যে! তার সঙ্গেও কি গতির সম্পর্ক নেই কোনও?
উঁহু, সত্যিই নেই। ‘স্কি’ করি বরফের অনভূতিটা নেওয়ার জন্যে। ভারতে জন্ম, চোখের সামনে ওই রকম বরফ দেখব কী করে? অথচ, সান ফ্রান্সিসকো থেকে ঘণ্টা আড়াই-এর ড্রাইভ। চোখের সামনে অনন্ত বরফ। এক বিন্দু দূষণ নেই কোথাও। পৃথিবীর বিশুদ্ধতম বাতাস আপনার ফুসফুসের আনাচকানাচ পরিষ্কার করে দেবে! তা ছাড়া, উঁচুতে উঠলে দিগন্তের ছবিটা স্পষ্ট!
তার পর ‘স্কি’ করে তিরবেগে ধেয়ে যাচ্ছেন দিগন্তের দিকে?
সাবির বললেন, দিগন্ত জিনিসটা অদ্ভুত, তাই না?
বললাম, দেখুন, আমাদের ‘ফেরারি মন’ আছে বটে, কিন্তু ওই ফেরারি গাড়িটাড়ি নেই। ওই ‘ফেরারি’ আমাদের কাছে, কী যেন বলে, ‘মিথ’! তাই যার কাছে সেটা আছে, তার দিকে আমরা আড়চোখে তাকাই। বলিউডি সিনেমার নাম রাখি, ‘ফেরারি কি সওয়ারি’। শুমাখারের দেওয়া ফেরারিটা সচিন বিক্রি করে দিলে আমাদেরই কষ্ট হয়। আচ্ছা, শুমাখার বলতে মনে পড়ল, ভারত তো এফ ওয়ান রেসিং-এ ঢুকে পড়ল। আপনার প্রতিক্রিয়া?
ভালই তো! ভাল ভাবে কাজটা মিটেছে। অভিনন্দন। আরও একটা ভাল জিনিস যে এতে সরকারি পয়সা যায়নি। আমজনতার টাকায় এফ ওয়ান রেস ভারতের পক্ষে বিলাসিতা। তবে, বেসরকারি উদ্যোগ করতেই পারে। তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা দরকার। তারা ভাল কিছু করতে পারে, আবার গলায় দড়িও দিতে পারে। কী করবে, তাদের ব্যাপার। ভাল কিছু করলে প্রাণ খুলে হাততালি দাও। গলায় দড়ি দিতে চাইলে দ্যাখো, যাতে দড়িটা কম না পড়ে!
সাবির ভাটিয়া আবার ‘স্বাধীনতা’-তেই ফিরে আসছেন। প্রসঙ্গটা একটু পাল্টানোর জন্য বললাম, রিচার্ড ব্র্যানসনের কথা সবাই জানে। ভার্জিন গ্রুপ-এর মাথা, গ্ল্যামারাস অঁত্রেপ্রেনর, বিচিত্র কাজকর্ম করেন। কিন্তু, ক’জনই বা জানে যে সাবির ভাটিয়া দু’দুটো গোটা ম্যারাথন দৌড় শেষ করেছেন!
একটুখানি লজ্জা পেলেন কি সাবির? একটু রক্ত জমল মুখে! বললেন, না, না, কারওকে জানানোর জন্যে তো নয়, আমি চেয়েছিলাম আমার রেজ্যুমে-তে এটা থাক যে, দুটো ম্যারাথন দৌড়েছিলাম, শেষও করেছিলাম।
ম্যারাথনের মতো দৌড় তো কবেই শুরু করেছেন।
তা ঠিক, কিন্তু ওই আর কি...ম্যারাথন ইজ ম্যারাথন...
বললাম, ক্ষমা করবেন, কিন্তু একটা কথা না বলে পারছি না। সাবির ভাটিয়া-র কোনটা দরকার, রেজ্যুমে, না বায়োগ্রাফি? দু’তিন পাতা নয়, ছাপার অক্ষরে আস্ত জীবনী!
অতঃপর আরও খানিকটা হাসি। সাবির ভাটিয়া বললেন, দৌড় জিনিসটা অঁত্রেপ্রেনরদের ডি এন এ-তেই থাকে। আর এই ডি এন এ-টাও অদ্ভুত। কী ভাবে দৌড়ব, কার দিকে দৌড়ব, সেটা অঁত্রেপ্রেনর নিজেই ঠিক করে নেয়, বাজার বলে দেয় না।
অর্থাৎ, স্টিভ জবস যেমন বলেছিলেন, কনজিউমার কি জানে যে সে কী চায়? মোটেই না। আমি জানি।
ঠিক। একটা কথা বলি আপনাকে। আজ স্টিভ জবস নিয়ে এত মাতামাতি। অথচ, অ্যাপল-এ আসার পরে ওঁর প্রথম যে বড় প্রডাক্ট, আইপ্যাড, তা নিয়ে অনেকেই ভুরু কুঁচকেছিল। আমিও। গোড়ায় ভেবেছিলাম, এ কী রে বাবা, একটা কম্পিউটার সংস্থা মিউজিক নিয়ে কী করবে? অবাক হওয়ার কারণও ছিল। তখন একগাদা কোম্পানি পোর্টেবল মিউজিক প্লেয়ার নিয়ে রীতিমতো ব্যবসা করছে। তার মধ্যে আরও একটা! কেন? পরে বুঝলাম, কেন। ওর মধ্যে একটি ছোট্ট জিনিস আছে। ও এস। ‘অপারেটিং সিস্টেম’। কিলার আইডিয়া!
স্টিভ জবসের কথা এলেই সাবির উচ্ছ্বসিত, বলে চললেন, কনজিউমারকে জিজ্ঞেস করুন, বড়জোর সে বলবে, এই যে জিনিসটা, এর মধ্যে এই জিনিসটা চাই, ওই জিনিসটা চাই, এটা থাকলে ভাল, ওটা না থাকলে ভাল, ব্যস... কিন্তু যে জিনিসটা চোখের সামনেই নেই! যে জিনিসটা হতে পারে বলেই কেউ ভাবেনি! তখন? দ্যাট নিডস আ ভিশন! অ্যান্ড আ ভিশনারি!
অর্থাৎ, বাজার জানে না, কিন্তু স্টিভ জবস জানেন যে কোন দিকে দৌড়তে হবে!
ঠিক। সেই দৌড়ের শর্ত স্টিভ নিজেই ঠিক করে নিয়েছিলেন। অন্যেরা তাকে অনুসরণ করল মাত্র।
একই কথা কি আমরা ‘হটমেল’ সম্পর্কেও বলতে পারি না? আপনারা নিয়ে এলেন, অন্যেরা সেই পথ ধরে এগোল।
সাবির ভাটিয়া নিজের সাফল্য সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন, তাই অকারণ বিনয়ে পীড়িত না হয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, হ্যাঁ, ‘হটমেল’ নিঃসন্দেহে ‘ট্রেন্ডসেটার’।
পাশাপাশি, উল্লেখ থাক, সাবির ভাটিয়া নিজের ব্যর্থতা সম্পর্কেও উদাসীন বা স্পর্শকাতর নন। যখন জিজ্ঞাসা করলাম, নির্ধারিত সময়ের প্রান্তে এসে, রেজ্যুমে-র কথা বলছিলেন একটু আগে! আপনার খুব প্রিয় একটা ব্যর্থতার কথা বলবেন?
এক লহমাও সময় নেননি। সাবির বললেন, আমি তো জীবনে অনেক বার ব্যর্থ হয়েছি! কোনটা বলব?
যেটা আপনার ইচ্ছে।
মাইস্মার্টড্রাইভ ডট কম নামে একটা জিনিস শুরু করেছিলাম। অনলাইন ফাইল ম্যানেজমেন্ট-এর জন্যে। পি সি বা ল্যাপটপ-এর ‘ড্রাইভ’ খালিই থাকবে। যা ফাইল দরকার, অনলাইন রেখে দিন। ডাউনলোড করে নিলেই হল। এখন হয়তো জিনিসটা দারুণ সফল হত, তখন কিচ্ছু হল না।
অর্থাৎ, সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকাটাই সমস্যা হল?
ঠিক, কিন্তু এটাও ঠিক যে আমাদেরও দোষ ছিল। উই ডিডন্ট হ্যাভ দ্য রাইট ফিচার্স সেট। সো..., কাঁধ ঝাঁকালেন সাবির।
বিল গেটস, সিলিকন ভ্যালি, ফেরারি, ডলার-বর্ষণ এই সব মিলেমিশে যে ঝকঝকে সুবর্ণগোলক, সেটা পড়েই আছে। সে দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সাবির ভাটিয়া বললেন, দুঃখ নেই, বরং আমার গর্ব হয়, জানেন, জিনিসটা তো তখন ভাবতে পেরেছিলাম, খেটেছিলাম, দৌড়েছিলাম, ওই দৌড়টাই আসল...
আজ, বছরের পয়লা তারিখ, সেই দৌড়ের গল্পটা দিয়েই শুরু করা ভাল।
সাবির ভাটিয়ার মুখে একটা আলো এসে পড়েছে ।
তাঁকে আর কী-ই বা বলা যায়, র্যাঞ্চোর সেই ত্রিপদীটি ছাড়া? আল ইজ ওয়েল, আল ইজ ওয়েল...
|
|
|
 |
|
|