|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
ঘুষ না নিলেই যখন লাভ হবে বেশি |
দুর্নীতি কমবে তখনই। তাই দরকার প্রশাসনের রীতিতে সংস্কার,
লোকপালের চোখ-রাঙানি নয়। মতামত জানালেন অর্থনীতিবিদ
প্রণব বর্ধন |
দুর্নীতিদমনে অন্না হজারের নানা বায়না নিয়ে সবাই ব্যতিব্যস্ত। ওঁর প্রস্তাবিত জনলোকপাল দুর্নীতি কমাবে, নাকি তার ফল হতে পারে উলটো, তা নিয়ে চিন্তা করা দরকার। দুর্নীতি জিনিসটা জটিল, বহুমাত্রিক। যত সহজে তা নিয়ে আমরা কথা বলি, মতামত জানাই, বিষয়টা ততখানি সহজ-সরল নয়। কোনও একটি সহজ উপায়ে সব রকম দুর্নীতি রুখে দেওয়া যাবে, এই প্রত্যাশা তাই ঠিক নয়।
‘দুর্নীতি’ কথাটার মধ্যেই অনেক ধোঁয়াটে ব্যাপার আছে। যেমন, কখন বলা চলে দুর্নীতি বেড়েছে? যদি অনেক বেশি লোক ঘুষ নেয়, নাকি যদি অনেক বেশি টাকা ঘুষ দিতে হয়? যদি কাজ উদ্ধার করতে পঞ্চায়েতের ছোট মাপের নানা কর্তাকে কয়েকশো কি কয়েক হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়, তা হলে মনে হয়, দুর্নীতি তো আরও বেড়ে গেল! কিন্তু বড় বড় মন্ত্রী-আমলাদের দফতরে বন্ধ দরজার পিছনে যে সব রফা হয়, সেখানে বহু কোটি টাকার অপচয় কেউ টেরও পায় না। দুর্নীতি বেশি চোখে পড়া মানেই দুর্নীতি বেড়ে যাওয়া, এমনটা বলা তাই সহজ নয়। এ দেশে মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে, পশ্চিমের দেশগুলোতে যা ভাবা যায় না। তাই মনে হয় ভারতে দুর্নীতি বেশি। কিন্তু ওই সব দেশে সরকারের উপরমহলে টাকার পরিমাণের দিক দিয়ে ঘুষ সব সময়ে কম নয়।
আরও একটা বিষয় লক্ষ করার মতো। যে সমস্ত ধনী ব্যক্তি ও সংস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস সদস্যদের নির্বাচনী প্রচারের জন্য অনেক টাকা দেয়, সদস্যরা পরে তাদের পছন্দের আইন প্রস্তাব করে, বা সমর্থন করে। এ ব্যাপারে বিশেষ লুকোছাপা নেই, এটা বেআইনিও নয়। আমাদের দেশে লোকে ঘুষ দেয় যাতে সুবিধেমতো আইন ভাঙতে পারে, আর ওদের দেশে লোকে টাকা দেয় যাতে তার সুবিধেমতো আইন তৈরি করতে পারে। দুটোই কি দুর্নীতি নয়? যা দুর্নীতি, তা-ই সব দেশে বেআইনি, এমন ধরে নেওয়া চলে না। |
|
মোড়ে মোড়ে হাত পাতা। পশ্চিমের দেশগুলিতে এই দৃশ্য ভাবা যায় না। |
তেমনই, ঘুষ দেওয়া অনৈতিক বলে আমরা ধরেই নিই। কিন্তু যদি কোনও ব্যক্তি পুলিশকে ঘুষ দেয় যাতে সে রাজনৈতিক বন্দিদের উপর অত্যাচার না করে? অন্যের যন্ত্রণা কমানোর এই চেষ্টাকে নির্দ্বিধায় অনৈতিক বলা চলে না।
দুর্নীতি বলতে বুঝি টাকা নয়ছয়। কিন্তু সময়ের অপচয়ও একটা পরিমাপ। সরকারি কর্মীরা যদি গরহাজির থাকেন, যদি অকারণে কাউকে বহু দিন ঘোরান, তা নীতি-বিরুদ্ধ নয় কি? দুর্নীতি নানা বিচিত্র উপায়ে কাজ করে।
অনেকেই আশা করেছিলেন, ভারতে মুক্ত অর্থনীতি এলে ‘লাইসেন্স-পারমিট রাজ’-এর শেষ হবে। সরকারি কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ কমবে, তাই দুর্নীতিও কমবে। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন উলটোটাই ঘটেছে। বাজার খুলে যাওয়ার পর দুর্নীতি যেন আরও বেড়ে গিয়েছে।
কেন এমন হচ্ছে? কিছু সম্ভাব্য কারণ দেখা যাচ্ছে।
|
বাজার খুলেও রেহাই নেই |
এক, কেন্দ্রীয় সরকারের স্তরে নিয়ম-কানুনের লাল ফিতে আলগা হয়ে এলেও, রাজ্য সরকারের স্তরে কিন্তু লাইসেন্স-পারমিটের অনেক শর্ত খুব একটা সরে যায়নি। একটা কারখানা খুলতে এখনও রাজ্য সরকারের নানা দফতর (যেমন, জমি, জল, বিদ্যুৎ, পরিবেশ বা শ্রম বিভাগ) থেকে নানা অনুমোদনের প্রয়োজন হয়, তাই ঘুষ খাওয়ার নানা রাস্তা আজও খোলা রয়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক ‘ডুয়িং বিজনেস’ বলে যে সমীক্ষাটি বের করে, তাতেও দেখা যাচ্ছে যে ব্যবসায়ীদের কাছে ভারতের রাজ্য স্তরে বাধা এখনও প্রচুর।
দুই, অর্থনীতির বৃদ্ধি যত ঘটছে, ততই দাম বাড়ছে জমি, খনিজ, মোবাইল ফোনের স্পেকট্রামের মতো সম্পদের, যেগুলোর মালিকানা জনগণের। যাঁরা সেই সব সম্পদ ন্যস্ত করার বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন, সেই নেতা-আমলাদের সামনে প্রলোভনও তাই আজ অনেক বেশি। নিজের দফতরকে ব্যবহার করে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার দুর্নীতি বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তেমনই, দারিদ্র দূরীকরণের নানা প্রকল্পে আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা আসছে। দুর্নীতির ইন্ধন ও আয়তন, দুই-ই আজ ভারতে অনেক গুণ বেড়ে উঠেছে।
রাজনৈতিক নির্বাচনের খরচ বহুগুণ বেড়ে যাওয়াও দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। নির্বাচন কমিশন খরচের যে সীমা বেঁধে দিয়েছে, তা খুবই কম। প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপন, গাড়ির তেলের খরচ, তরুণদের প্রচারের কাজে নামাতে নগদ টাকা এবং অন্যান্য প্রলোভন, কোনও কিছুই বৈধ উপায়ে জোগাড় করার উপায় নেই। তাই রাজনীতিতে দুর্নীতি এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ছে। বিচারব্যবস্থার দশাও তথৈবচ--- মামলার পাহাড় জমে যাওয়ায় যে কোনও চুক্তিভঙ্গের অভিযোগের ফয়সালা সহজে হয় না। ফলে বিচার বিভাগের কর্মচারীদের এবং বিচারকদের দু’পয়সা গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
আর একটা প্রশ্নও বারবার উঠেছে। মানুষ যদি ঘুষখোর নেতাদের পছন্দ না করে, তা হলে তাদের ভোটে হারায় না কেন? ভারতে যে গোষ্ঠীগত ‘মর্যাদার রাজনীতি’ আমরা দেখেছি, তা-ও এর একটা কারণ। ‘উনি যেমনই হোন না কেন, আমার জাতের লোক, আমার ধর্মের লোক’ এই চিন্তা থেকে লোকে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষদেরও ভোট দিতে পারে। তবে এই ঝোঁক সম্ভবত কমে আসছে দক্ষিণ ভারতে ভোটারদের মধ্যে ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, জাতের অঙ্কের চেয়েও সুশাসনের উপর ঝোঁক পড়ছে। হয়তো উত্তর ভারতেও কিছুদিনের মধ্যে এই ধারা দেখা যাবে।
|
ঘুষ দিয়ে যায় চেনা |
নানা দেশে নানা সময়ে দেখা যায় যে দুর্নীতি নিয়ে দু’রকম বিপরীত অবস্থা তৈরি হতে পারে। এক, যেখানে সকলে মনে করছে, ‘সবাই ঘুষ খায়, তা হলে আমি খাব না কেন?’ সে ক্ষেত্রে ঘুষ খাওয়ার ঝুঁকিটা কম, লোকের কাছে নাম খারাপ হওয়ার ক্ষতিটাও কম। আর দুই, যেখানে অধিকাংশ মানুষ ভাবে, ‘কেউ ঘুষ খায় না, আমি খাই কী করে?’ দুর্নীতি কমাতে হলে প্রথম অবস্থা থেকে দ্বিতীয় অবস্থায় দেশকে নিয়ে যেতে হবে। তা কী করে সম্ভব?
যাঁরা অন্না হজারের মতো মনে করেন, কড়া নজরদারি এবং কঠিন শাস্তি দেওয়াই দুর্নীতিমুক্তির পথ, তাঁরা এই জিনিসটাকে অতি সরলীকৃত করে ফেলছেন। চিন দেশে দুর্নীতির শাস্তিতে অনেক সময়েই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রচুর দুর্নীতি চলছে। কেবল ঘুষখোরের শাস্তি বাড়ালে একটা আশঙ্কা যে ঘুষের অঙ্কটাই বেড়ে যেতে পারে, কেন না ঘুষখোরকে ঝুঁকি এখন বেশি নিতে হবে, তাই তার চাহিদা হবে ঘুষ বেশি নেওয়ার।
অর্থনীতির দৃষ্টিতে মনে হয়, শাস্তি ছাড়াও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে ঘুষ খাওয়ার সুযোগ কমে যায়, এবং যাতে ঘুষ না-খাওয়াকেই ভাল বলে মনে হতে থাকে। কেবল নৈতিক বোধের কারণে নয়, নিজের স্বার্থরক্ষার বা সুবিধার জন্য। সিঙ্গাপুর ষাটের দশকে অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ছিল। প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সংস্কার আনার ফলে তা এখন সবচেয়ে স্বচ্ছ দেশগুলির অন্যতম। কেমন ছিল সেই সংস্কার? সিঙ্গাপুরের শুল্ক বিভাগ খুব ঘুষখোর ছিল বলে কয়েক বছরের জন্য গোটা দফতরের কাজটাই ‘আউটসোর্স’ (কাজ চালান) করে দেওয়া হয় সুইজারল্যান্ডের একটি সংস্থাকে। পরে যখন সেই দায়িত্ব আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়, তখন নানা দফতরে শুল্কবিভাগের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও মাদক সমস্যা কমাতে নিউ ইয়র্ক শহরের পুলিশ বিভাগের একক ক্ষমতা রদ করা হয়, যোগ করা হয় কেন্দ্রীয় (এফ বি আই) ও প্রাদেশিক গোয়েন্দা নানা সংস্থাকে। ভারতেও যে কোনও পরিষেবায় কোনও একটি সংস্থার একক আধিপত্য বন্ধ করা দরকার, তাতে দুর্নীতির সুযোগ কমবে।
কোনও কোনও দুর্নীতির ক্ষেত্রে ঘুষখোর আর ঘুষদাতা দু’জনেই একই ষড়যন্ত্রের অংশ (যেমন, সম্পত্তির ধার্যমূল্য কমিয়ে কর কমানো, অথবা কর বা শুল্ক ফাঁকি)। দু’পক্ষই চায়, কেউ যেন না জানে, বা কারও শাস্তি হয়। তাই শাস্তি ঘোষণার চেয়েও প্রশাসনিক নিয়মের পরিবর্তন বেশি প্রয়োজন। সিঙ্গাপুর সরকারি কর্মীদের মাইনেও অনেক বাড়িয়ে দেয়, যাতে ঘুষ খাওয়ার প্রয়োজন কমে। সেই সঙ্গে কর্মীদের উপর কঠিন নজরদারি, এবং শাস্তির ব্যবস্থাও চালু হয়। আজ সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী মার্কিন প্রেসিডেন্ট-এর চাইতে অনেক বেশি বেতন পান, অন্য মন্ত্রীরাও ভালই পান। সরকারে দুর্নীতিও কমে গিয়েছে। ভারতে ষষ্ঠ বেতন কমিশন মাইনে বাড়াল, কিন্তু কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করল না বলে দুর্নীতি কমানোর একটি সুযোগ কাজে লাগানো যায়নি।
|
আটকাতে পারি, এগোতে নয় |
প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোও দুর্নীতি কমানোর একটা উপায়। ছত্তিশগঢ়ে ইতিমধ্যেই নানা সরকারি সার্টিফিকেট বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে কমপিউটার প্রযুক্তির সাহায্যে দেওয়া হচ্ছে। ফলে সরকারি কর্মীদের ঘুষ খাওয়ার সুযোগ কমে গিয়েছে। এ ভাবে জমির দলিল, পাসপোর্ট-এর মতো নানা নথি পাওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
সরকারি কর্মীদের বদলি এবং পদোন্নতির নীতিতেও পরিবর্তন আনা দরকার। চিন তা করেছে সেখানে সরকারি আমলাদের কাজের মূল্যায়নের সময়ে তাঁদের এলাকার কী কী উন্নতি হয়েছে তা-ও খতিয়ে দেখা হয়। তার ভিত্তিতে বদলি, পদোন্নতি হয়। তার মানে এই নয় যে সে দেশে আমলারা ঘুষ খান না, কিন্তু এলাকার উন্নতি আটকে পুকুর চুরি করা তাঁদেরই স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াবে বলে ভারতীয়দের মতো অবাধে ঘুষ খেতে পারবেন না চিনারা।
এক ভদ্রলোকের ফাইল দিল্লির কোনও এক সরকারি দফতরে কিছুতেই এগোচ্ছিল না বলে সেই দফতরে তাঁর বন্ধুকে তিনি বিষয়টি দেখতে অনুরোধ করেন। বন্ধুটি উত্তর দেয়, ‘তোমার ফাইল দ্রুত এগিয়ে দিতে পারব না, তবে যদি কোনও ফাইল আটকাতে বল, তা এক্ষুনি পারব।’ ভারতে প্রশাসনের পদ্ধতি এমনই যে, বহু লোকের কোনও একটি কাজ আটকানোর ক্ষমতা রয়েছে। টাকা দিয়েও কাজ উদ্ধার হয় না, এমনই বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য আমাদের ব্যবস্থায়। ব্যবস্থার পরিবর্তন না এনে যদি কোমর বেঁধে ঘুষখোর খুঁজতে নামা হয়, তার ফল হবে উলটো--- যে সব সৎ ও সাহসী সরকারি অফিসাররা কাজে গতি আনতে ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, নতুন ধরনের কাজে উদ্যোগী হন, তাঁদের বিপন্ন করা হবে। যখনই কোনও উদ্যোগ ব্যর্থ হবে, তখনই খোঁজ শুরু হবে--- কে লাভ করল? সে নিশ্চয়ই ঘুষ দিয়েছিল। তখন কিছু না করাই নিরাপদ বলে মনে হবে। তাতে সরকারের কিছু পয়সা বাঁচতে পারে, কিন্তু দেশের ক্ষতি হবে অনেক বেশি।
অপরিমিত ক্ষমতাশালী লোকপাল তৈরি করে নজরদারির ব্যবস্থা করার চাইতে (লোকপালের উপর নজর রাখবে কে?) প্রশাসনিক সংস্কার আনা দরকার (যেমন, সরকারি কর্মচারী বদলির ব্যাপারে প্রশাসনিক কিছু নিয়ম পালটানো, অথবা কোনও বিভাগের একক ক্ষমতার পরিসর কমানো)। প্রধানমন্ত্রী লোকপালের আওতায় আসবেন কি না, ছোট আমলারা বাদ পড়বেন কি না, এগুলো পরের বিতর্ক। গোড়ার প্রশ্ন, লোকপাল দিয়ে দুর্নীতি কমানো যাবে, না কি হিতে বিপরীত হবে। দ্বিতীয়টি সত্য হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে।
|
সম্প্রতি ক্যালকাটা ক্লাবে প্রদত্ত ভাষণের ভিত্তিতে স্বাতী ভট্টাচার্যের প্রতিবেদন |
|
|
|
|
|