রাজ্যের আকাশে উদ্বেগের মেঘ ঘনাইয়া আসিয়াছে। উন্নয়নের প্রকল্পগুলি যে আশানুরূপ অগ্রসর হয় নাই, নূতন সরকারের ছয় মাস না-কাটিতেই তাহা স্পষ্ট হইয়া আসিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় পশ্চিমবঙ্গ তাহার লক্ষ্যের ধারেকাছেও পৌঁছাইতে পারে নাই, কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ খরচ করিতে শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ হইয়াছে। একশো দিনের কাজ দিবার প্রকল্পের কার্যকারিতাও তথৈবচ। গত বৎসর গড়ে মাত্র ২৬ দিন পশ্চিমবঙ্গ ছিল ভারতে সর্বশেষে, এ বৎসর অক্টোবর পর্যন্ত ১৯ দিন কাজের ব্যবস্থা করা গিয়াছে, বাকি সময়ে খুব বেশি উন্নতির সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে না। মুখ্যমন্ত্রীর দফতর কাজের যে মূল্যায়ন করিয়াছে তাহাতে প্রকাশ, রাজ্যের পরিকল্পনা বাজেটের টাকা খরচ করিবার কাজে অধিকাংশ দফতরই নিতান্ত ব্যর্থ হইয়াছে আর্থিক বৎসরের মাত্র তিন মাস বাকি রহিয়াছে, অথচ বরাদ্দের ২০ শতাংশও খরচ হয় নাই বহু দফতরে। সেচ, পানীয় জল, কৃষি কিংবা স্কুল শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, কোনও দফতরই বরাদ্দের ব্যবহার করিতে পারে নাই।
কেহ বলিতেই পারেন, মাত্র ছয় মাসে একটি নূতন সরকারকে বিচার করা চলে না। কোনও সরকারের কাজের মূল্যায়নের নানা রাজনৈতিক উপায় রহিয়াছে, যথাসময়ে সে সকল পরীক্ষার সম্মুখীন হইতে হইবে তৃণমূল সরকারকে। কিন্তু উদ্বেগ আরও গভীর, তাহা মানব উন্নয়নের সংকট লইয়া। একশো দিনের প্রকল্পে কাজ না পাইয়া একটি পরিবারের গ্রাম ছাড়িবার অর্থ একটি শিশু স্কুলছাত্র হইতে শিশু শ্রমিক হইয়া ওঠা। অন্ত্যোদয় কিংবা অন্নপূর্ণা যোজনায় চালের সরবরাহ অনিয়মিত হইলে দরিদ্র মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতা আরও বাড়িয়া যাইবে। অঙ্গনওয়াড়িতে খিচুড়ি না মিলিবার ফল বহু সহস্র শিশুর মাঝারি অপুষ্টি হইতে অতি অপুষ্টিতে নামিয়া যাওয়া। এইরূপ চলিতে থাকিলে শিশুমৃত্যু, প্রসূতিমৃত্যুর হার বাড়িবে, মানব উন্নয়নের মাপকাঠিতে রাজ্যের অবনতি ক্রমশ স্পষ্ট হইয়া উঠিবে। অন্য দিকে, অপুষ্ট, স্বল্পশিক্ষিত শিশুরা যখন বড় হইয়া কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিবে, তখন উন্নয়ন ব্যাহত হইবে। সুতরাং এক বা দুই বৎসর উন্নয়নের কাজ করিতে না পারিবার ফল হইবে দীর্ঘপ্রসারী। নানা কৌশলে জনসমর্থন বজায় রাখা অসম্ভব নহে, কিন্তু রাজ্যের মানব উন্নয়ন ব্যাহত হইলে তাহা অধিক দুশ্চিন্তার বিষয় নহে কি? ভোটের বিচারে যাহা নেতাদের ‘সামান্য ক্ষতি’, দরিদ্রের জীবনে তাহাই সম্পূর্ণ বিপর্যয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং কর্মতৎপর। তিনি নিজের সততা এবং কর্মক্ষমতার নিদর্শন সৃষ্টি করিয়া তাঁহার দলের মন্ত্রী এবং প্রশাসনিক কর্মীদের সক্রিয় এবং দায়বদ্ধ করিতে চাহেন। ইহা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য, কিন্তু ইহাই যথেষ্ট নহে। যে জাড্য এই রাজ্যের প্রশাসন ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করিয়াছে, তাহার কারণ অনুসন্ধান করিতে হইবে। নানা দফতরের সমন্বয়ের অভাব তাহার কারণ, না কি প্রশাসনিক কাজে রাজনৈতিক নেতাদের অকারণ আধিপত্যই তাহার কারণ? দুর্নীতির ভয়ে কি সরকারি কর্মীরা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছেন? নাকি নেতা-আমলাদের মধ্যে সরকারি প্রকল্পের টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা কী রূপে হইবে, তাহার নকশা এখনও ঠিক হয় নাই বলিয়া টাকা খরচই বন্ধ হইয়া রহিয়াছে? প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার কোথায় গলদ হইতেছে, তাহা নির্ণয় করিয়া তাহার সমাধান না করিলে প্রকল্পে গতি আসিবে না। দৃঢ়তার সহিত বিচক্ষণতারও প্রয়োজন। |