আসন্ন নির্বাচনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার ডাক দিয়েই আপাতত ময়দান ‘ছাড়লেন’ অণ্ণা হজারে। নিজের রাজ্যেই ভিড় জমছিল না। গায়ে যথেষ্ট জ্বর। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, শরীরে বেড়ে গিয়েছে ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিনের মতো ক্ষতিকর পদার্থ। এই অবস্থায় এক দিন বাকি থাকতেই অনশন তুলে নিলেন অণ্ণা। অথচ কাল রাতে অসুস্থ হয়ে পড়ার পরেও বলেছিলেন, অনশন চালিয়ে যাবেনই। তার পর আজ অপ্রত্যাশিত ভাবে অনশন তোলাই নয়, প্রত্যাহার করে নিয়েছেন আগামী ৩০ ডিসেম্বরের জেল ভরো আন্দোলনও। আপাতত স্থগিত রেখেছেন সনিয়া গাঁধী বা রাহুলের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচিও। অণ্ণার অবশ্য ব্যাখ্যা, “সাময়িক বিরতি নিলাম। কিন্তু আগামী পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ও দু’বছর বাদে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা হবে। অনশন তুলে নিলেও আমার লড়াই জারি থাকবে।” |
তবে এই লড়াইয়ের লক্ষ্য প্রসঙ্গেই এক প্রশ্নের মুখে এ দিন হঠাৎ অনশন মঞ্চ ছেড়ে চলে যান অণ্ণা। তখন সবে অনশন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। ঘোষণা করেছেন পরবর্তী কর্মসূচি। অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা ঘোষণা করলেন, মঞ্চ থেকেই অণ্ণা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন। একের পর এক প্রশ্নের উত্তরে অণ্ণা যখন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলছেন, তখন প্রশ্ন আসে, বিজেপি তো কাল লোকপালকে সাংবিধানিক সংস্থা করার বিরোধিতা করেছে। তারাও তো বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তিনি কেন শুধু কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই লড়াইয়ের কথা বলছেন? প্রথমে অণ্ণ়া এই প্রশ্নের উত্তরই দিতে চাননি। পরে শুধু বলেন, “কংগ্রেসই সব থেকে বেশি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।” বলেই আচমকা উঠে পড়েন। সাংবাদিকরা বার বার ডাকলেও কর্ণপাত করেননি। মঞ্চের পিছনে চলে যান। অবস্থা বেগতিক দেখে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ঘোষণা করেন, অণ্ণার শরীর খারাপ লাগছে। উনি ভিতরে যেতে চাইছেন। তখন অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে একই প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রথমে থতমত খেয়ে যান। পরে নিজেকে সামলে নেন। এবং একের পর এক প্রশ্নের জবাবে শেষ পর্যন্ত বলেন, কংগ্রেসই কেন্দ্রে ক্ষমতায়। তারাই এই বিল পাশ করাতে পারবে। অন্য দলগুলো তা পারবে না। তাই কংগ্রেসই লক্ষ্য। ক্ষমতায় থেকে বিজেপি যদি বিল না আনত, তবে তাদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করতেন তাঁরা।
এই আন্দোলনের প্রথম থেকেই দিগ্বিজয় সিংহের মতো নেতারা অভিযোগ করছেন, অণ্ণা আরএসএস-ঘনিষ্ঠ। তাঁর আন্দোলনের পিছনে সঙ্ঘ পরিবারের মদত রয়েছে। এবং অণ্ণাদের একমাত্র রাজনৈতিক শত্রু কংগ্রেস। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ বলছে, আজ অণ্ণার বক্তব্য বা তাঁর আচরণের পরে সেই দাবিতে কার্যত সিলমোহর পড়ল। এ বার অনেকেই বলবেন, অণ্ণার অ-রাজনৈতিক চেহারাটা পুরোপুরি মুছে গেল। সংসদীয় ব্যবস্থার কাছে কার্যত পরাজয় হওয়ার পরে অণ্ণা ও তাঁর সঙ্গীদের কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আক্রমণ তীব্র করা ছাড়া কোনও রাস্তা খোলা নেই। অণ্ণা আজ নিজেও বারবার বলেন, “সরকার চালাচ্ছে কংগ্রেস। গত সাত-আট মাস ধরে এই কংগ্রেসই জন লোকপাল বিলের প্রশ্নে দ্বিচারিতা করে এসেছে। তাই আসন্ন নির্বাচনগুলোতে যেখানে কংগ্রেস প্রার্থী দেবে, সেখানে বিরুদ্ধ জনমত গড়ে তুলব।” |
এ দিন অনশন প্রত্যাহারের ঘোষণা অবশ্য অপ্রত্যাশিত ছিল ইন্ডিয়া এগেনস্ট করাপশন (আইএসি)-এর অধিকাংশ সদস্যের কাছেও। গত কালের নামমাত্র ভিড়ের পরে আজ মাঠের চেহারা দেখে কিছুটা আশাবাদী ছিলেন অনেকেই। বলছিলেন, “আজ যা ভিড় হয়েছে তা আগামিকাল থাকলেই মোটের উপর অনশন সফল।” ঠিক তখনই বোমাটা ফাটালেন অণ্ণা। আজ প্রথম বার বেলা চারটে নাগাদ বক্তৃতা তাঁর। আর তখনই বললেন, “শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে আমি আজই অনশন তুলে নিচ্ছি।” জানিয়ে দেন, জ্বর থাকায় কার্যত ২৫ ডিসেম্বর থেকেই কিছু খাচ্ছেন না। পাশে এলিয়ে বসে থাকা আইএসি সদস্য মুহূর্তে টানটান। মরাঠিতে ফোন চালাচালি। যার বাংলা মমার্থ, “এ বাবা, আজ তো ভালই ভিড়। অনশন কেন তুলে নিচ্ছেন অণ্ণা?” কথা শেষ হতেই জানালেন, আজ অণ্ণা এ ভাবে অনশন তুলে নেবেন সে বিষয়ে তাঁদের অনেকেরই ধারণা ছিল না।
তবে বিলক্ষণ জানতেন তাঁদের নেতারা। কাল রাত থেকেই অণ্ণাকে অনশন তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল, ময়াঙ্ক গাঁধীরা। একে সংসদে গতকাল লোকপাল বিল পাশ হয়ে গিয়েছে। উপরন্তু কী মুম্বই, কী রামলীলা ময়দান সর্বত্রই নামমাত্র ভিড়। এই পরিস্থিতিতে আজ অণ্ণা অন্তত যাতে মুখরক্ষা করে অনশন তুলতে পারেন সেজন্য তৎপর হয় আইএসি নেতৃত্ব। ঠিক হয়, একদিকে অণ্ণার শারীরিক অবস্থা কতটা খারাপ হচ্ছে, তা বারবার তুলে ধরা হবে। অন্য দিকে ভিড় টানতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এবং ভিড় ঠিকঠাক হলে অনশন প্রত্যাহারের ঘোষণা করবেন অণ্ণা।
পরিকল্পনামাফিক আজ দুপুর পর্যন্ত বারবার অণ্ণার শারীরিক অবস্থার কথা জানানো হতে থাকে। আবার ভিড় জোটাতে গতকাল গভীর রাত থেকেই ‘এসওএস’ যেতে শুরু করে বিভিন্ন বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির কাছে। শরদ পওয়ারের দল এনসিপি-এর অভিযোগ, ভিড় জোটাতে যোগাযোগ করা হয়, শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরের সঙ্গেও। চিকিৎসক, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, ছাত্র সংগঠন, অটো ও ট্যাক্সি ইউনিয়নগুলোকে আন্দোলনে সামিল হওয়ার ডাক দেওয়া হয়। নতুন করে শুরু হয় এসএমএস এবং ই-মেল চালাচালি। আজ দাদার এবং বান্দ্রা স্টেশন থেকে অনশন প্রাঙ্গণে আসার জন্য বিনা ভাড়ায় বাস-অটোর ব্যবস্থা রাখা হয়। সংলগ্ন স্টেশনগুলিতে দাঁড় করানো হয় স্বেচ্ছাসেবক। আম-জনতাকে ‘একটিবার’ মাঠে পাঠানোই ছিল যাদের কাজ। যদিও সংগঠিত এই ব্যবস্থাপনার বিষয়টি মানতে চাননি অরবিন্দ কেজরিওয়ালেরা। উল্টে তাঁদের অভিযোগ, সরকার মোবাইল নেটওয়ার্ক জ্যাম করে, লোককে ভুল রাস্তা দেখিয়ে মাঠে আসা ঠেকিয়েছে। আজ কেজরিওয়ালদের বারবার প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, ভিড় নেই বলেই কি অনশন বন্ধ করা হচ্ছে? প্রতিবারই তিনি বলেন, “এত লোক আজ এসেছে, তা কি চোখে পড়ছে না? কাল অল্প ভিড় ছিল ঠিকই। লোক জড়ো হতে সময় লাগে যে কোনও আন্দোলনেই।” আর জেল ভরো প্রত্যাহার কেন? তাঁরা তো দাবি করেছিলেন, লক্ষাধিক লোক ইতিমধ্যেই এই কর্মসূচিতে নাম লিখিয়েছেন। অণ্ণা শিবিরের দাবি, লোককে প্রস্তুত হতে সময় দিতে হবে।
|