কেউ লোকপাল চায়নি। কেউ লোকপাল চায় না।
সংসদের সেন্ট্রাল হলে দাঁড়িয়ে বর্ষীয়ান সাংসদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে মনের গোপন কথাটি।
লোকপাল বিল নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে যে নানা ঘটনার ঘনঘটা, বহু স্বরের ওঠাপড়া, তার মধ্যে উঁকি মারছে অবভাসের এই জটিল নকশা। মনের কথা আর মুখের কথার ব্যবধান সেখানে দুস্তর। অণ্ণা শিবির থেকে শুরু করে কংগ্রেস, বিজেপি-সহ সব ক’টি দল লোকপাল নিয়ে গলা ফাটিয়ে চলেছে। কংগ্রেস বলছে, বিজেপির জন্যই লোকপাল হচ্ছে না। বিজেপি বলছে, কংগ্রেসেরই সদিচ্ছার অভাব। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বিবৃতির বাইরে, ‘অফ দ্য রেকডর্’ প্রায় সব দলের শীর্ষ নেতা এক সুরে বলছেন, লোকপাল না হলে ভারতের মাথায় মোটেই আকাশ ভেঙে পড়বে না।
সনিয়া গাঁধী বলছেন, “সবচেয়ে শক্তিশালী লোকপাল বিল কংগ্রেসই চায়। কারণ আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চাই।” রাহুল আগেই বলে দিয়েছেন, লোকপালের সাংবিধানিক মর্যাদা প্রয়োজন। খোদ সনিয়া-রাহুল মুখে এ কথা বললেও কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা ঘরোয়া আলোচনায় কী বলছেন? ‘‘ভারতে সংসদীয় কাঠামোর সার্বভৌমত্ব সর্বোচ্চ। সে কারণেই হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও এ দেশে গণতন্ত্র কায়েম রয়েছে।’’ তাঁদের বক্তব্য, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিতে কখনও রাজার সঙ্গে, কখনও সেনার সঙ্গে প্রশাসনের সংঘাতে গণতন্ত্রের ভিত্তি নড়ে গিয়েছে। ভারত কিন্তু তার মজবুত সংসদীয় কাঠামোতে ভর দিয়েই একের পর এক বাধা অতিক্রম করতে পেরেছে। সে ক্ষেত্রে কংগ্রেস নেতৃত্বেরই প্রশ্ন লোকপালের মতো একটা সমান্তরাল ক্ষমতার উৎস তৈরি হলে তাতে কার ভাল?
ঘটনা হল, লালকৃষ্ণ আডবাণী-অরুণ জেটলি-সুষমা স্বরাজরাও কিন্তু মনে মনে লোকপাল চান না। তাঁরা মনে করেন, আজ কংগ্রেস ক্ষমতায়। কাল যদি বিজেপি ক্ষমতায় আসে, তখন সমান্তরাল ক্ষমতাকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে লোকপাল। কর্নাটকের অভিজ্ঞতায় দেখাই গিয়েছে, কী ভাবে ইয়েদুরাপ্পাকে গ্রাস করলেন হেগড়ে। জাতীয় স্তরে বিজেপির প্রধানমন্ত্রীও যদি ভবিষ্যতে একই পরিস্থিতির শিকার হন, সেটা কাম্য নয়। সুতরাং সাবধানের মার নেই। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে, লোকপালের পক্ষে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতিতে পিছিয়ে থাকা চলে না। অতএব মনের ইচ্ছে লুকিয়ে রেখে লোকপাল-দরদী হয়ে প্রবল অশ্রু বিসর্জন ছাড়া উপায় কী?
বিজেপির এক শীর্ষ নেতা স্বীকার করছেন, “আডবাণীরা লোকপাল চাননি ঠিকই। তবে এটাও সত্য যে, অণ্ণা হজারে নামক একটি রাজনৈতিক ‘ফেনোমেনন’ই কিন্তু ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থাকে লোকপাল পাশ করাতে বাধ্য করেছে।” এই অণ্ণা-ঝড়ের জন্ম হল কেন? কারণ রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, দলনিরপেক্ষ ভাবে ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাই এক চূড়ান্ত অবক্ষয়ের শিকার। দুর্নীতি, প্রশাসনিকতার ঘাটতি, বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব সার্বিক ভাবে রাজনৈতিক কর্তৃত্বকেই দুর্বল করে দিয়েছে। আর সেখান থেকেই অসন্তুষ্ট নাগরিক সমাজকে মূলধন করে ‘টিম অণ্ণা’র তেড়েফুঁড়ে ওঠা। শাসক দল যখন কংগ্রেস, তখন বিরোধী দল হিসাবে এই পরিসরটা নেওয়ার কথা ছিল বিজেপি-র। কিন্তু ক্ষমতার অন্তর্কলহে লিপ্ত বিজেপি ব্যর্থ হয়েছে সে কাজে। ছ’বছর ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতির পচা শামুকে বারবার পা কেটেছে বিজেপিরও। ফলে বিকল্প হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে বিজেপি যখন ব্যর্থ, তখনই অণ্ণা অনশনে নেমেছেন।
এমতাবস্থায় বিজেপির কাছে আরএসএসের ফরমান ছিল মানতে হবে অণ্ণাকে। মানতে হবে লোকপাল। বিজেপির পক্ষে পরিস্থিতিটা মহা ফাঁপরের। গিলতেও না পারা, ওগরাতেও না পারা গোছের। বিজেপির শীর্ষ নেতারা কী চাইতেন? তাঁরা বড়জোর চাইতেন, কংগ্রেস-বিরোধিতার সুর চড়াতে জ্বালানি হিসাবে কাজে লাগুন অণ্ণা! কিন্তু সে সব ছাপিয়ে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মূল চরিত্রই যদি অণ্ণা হয়ে যান, তাহলে সেটা বিজেপির সমস্যাই। আর তাই কর্মসূচিহীন বিজেপি অণ্ণাকে সমর্থন জানানো সত্ত্বেও রথযাত্রা করে আডবাণী একটা পর্বে অণ্ণার জমি কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন। সুষমা স্বরাজ এখনও বলছেন, “নাগরিক সমাজ অসন্তোষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারে। কিন্তু সরকার বদলানোর জন্য প্রয়োজন বিজেপির মতো একটি রাজনৈতিক দল। সংসদীয় দলই একমাত্র রাজনৈতিক পালাবদল করতে সক্ষম। অণ্ণা নয়।”
তাই যদি হয়, তবে সংবিধান সংশোধনী আটকে যাওয়ায় অখুশি কে?
বিজেপি অখুশি নয়। বরং তারা মনে করছে, সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। এক দিকে আরএসএস এবং অণ্ণাকে সন্তুষ্ট করা হল। সাধারণ মানুষকেও বোঝানো হল, ‘আমরা চাইছি। ওরা চাইছে না।’ আবার সংবিধান সংশোধনী না হওয়ায় নিজেদের ভিতরে স্বস্তি। সত্যি সত্যি সবটা হয়ে গেলে সেটা গলার কাঁটাই হত।
শাসক দল কংগ্রেস অখুশি নয়। এখন কেউ অপবাদ দিতে পারবে না যে, কংগ্রেস লোকপাল চায়নি। কংগ্রেস নেতারা বলছেন, লোকপাল বিল সংসদে পেশ করেই অণ্ণার পালের হাওয়া অনেকটা কেড়ে নেওয়া গিয়েছে। লোকপাল বিল যদি রাজ্যসভায় পাশ না-ও করানো যায়, আত্মপক্ষ সমর্থনে কংগ্রেসের যুক্তি তৈরি। বলা হবে, “এর আগে আট বার লোকপাল বিল আসার কথা হয়েও আসেনি। কিন্তু সনিয়া-মনমোহনের জমানায় লোকসভায় তো পাশ হল। কার্যকর হোক বা না হোক।” মজার ব্যাপার, লোকপাল নিয়ে এই জটে টিম অণ্ণাও অখুশি নয়। লোকপাল বিল পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলে অণ্ণার তো আর কিছু করার থাকত না। অণ্ণা রামলীলা ময়দানে বলেছিলেন, “জয় অর্ধসমাপ্ত। পুরো জয় বাকি রয়েছে।” আর তাই ‘টিম অণ্ণা’ বলেছিল, যে চেহারায় লোকপাল সংসদে আনা হচ্ছে তা না পাশ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। অথচ কংগ্রেস-বিজেপি-অণ্ণা প্রত্যেকেই যে যার মতো করে বলে চলেছে, লোকপাল চাই-ই চাই। মনে-মুখে কোনও মিল নেই। অবভাসের এক জটিল নকশা। |