আরম্ভের আগেও আরম্ভ থাকে।
জয়রাম রমেশের একটি চিঠি থেকে সেই আরম্ভের সূচনা।
চন্দ্রনাথ সিংহের কাজে ‘সন্তুষ্ট’ না হওয়ায় গত কালই তাঁকে পঞ্চায়েতমন্ত্রী দায়িত্ব থেকে সরিয়ে জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে ওই দফতরের বাড়তি দায়িত্ব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আর এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী শুধু চন্দ্রনাথকে নয়, রাজ্য মন্ত্রিসভার কাছেই একটি কঠোর বার্তা দিতে চেয়েছেন। সেটা হল, ‘ঠিক করে কাজ করুন, তা না হলে কিন্তু বিদায় নিতে হবে।’
বেশ কিছু দিন ধরেই রাজ্যের পঞ্চায়েত এবং গ্রামোন্নয়ন দফতরের কাজকর্ম নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, আগামী জানুয়ারি মাসে যখন মন্ত্রিসভা রদবদল করবেন, তখনই চন্দ্রনাথ সিংহকে অন্য দফতরে সরিয়ে দেওয়া হবে। স্টার আনন্দকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মমতা জানিয়েছিলেন যে, বর্ষশেষের আগে তাঁর মন্ত্রিসভায় কোনও রদবদল হচ্ছে না। কিন্তু চন্দ্রনাথের ব্যাপারে কেন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি? এর পিছনে ভূমিকা রয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী জয়রাম রমেশের পাঠানো একটি চিঠির। ২৪ ডিসেম্বর ওই চিঠি পাওয়ার পরে মমতাকে খানিকটা বাধ্য হয়েই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বস্তুত, জয়রামের চিঠিই চন্দ্রনাথকে সরানোর কাজকে আরও ত্বরান্বিত করেছে বলা চলে। |
কী সেই চিঠি? এবং সেই চিঠি পড়ে মমতা কেনই বা চন্দ্রনাথ সিংহের উপরে এতটা ক্ষুব্ধ হলেন?
চিঠিটির শুরুতে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘মাই ডিয়ার মমতা দিদি’ সম্বোধন করে জয়রাম লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামোন্নয়নের জন্য কেন্দ্র সব রকম ভাবে সাহায্য করতে চাইছে। কিন্তু রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন দফতর কেন্দ্রের টাকা পেয়েও ঠিকমতো খরচ করছে না। এমনকী, এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের (এডিবি) ন্যূনতম শর্তও পূরণ করতে পারেনি রাজ্য। ওই শর্ত অনুযায়ী, প্রকল্প রূপায়ণের জন্য রাজ্যকে এক জন পরামর্শদাতা নিয়োগ করতে হয়। জয়রাম জানিয়েছেন, সেই কাজটি দীর্ঘ দিন রাজ্য সরকার ফেলে রাখায় এডিবি-র ঋণ পেতেও দেরি হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী, এই ঋণ দেওয়ার আগে কেন্দ্রের সঙ্গে এডিবি একটি চুক্তি স্বাক্ষর করবে। পশ্চিমবঙ্গ পরামর্শদাতা নিয়োগ করতে পারেনি বলে ব্যাঙ্ক চুক্তি সই করতে রাজি হচ্ছে না।
জয়রাম আরও লিখেছেন, “কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর গ্রাম সড়ক যোজনার কাজ পর্যালোচনা করতে গিয়ে আমি প্রচণ্ড আশাহত হয়েছি। তার কারণ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন সংস্থা এখনও পর্যন্ত মাত্র ৭২ কিলোমিটার রাস্তা তৈরির জন্য সবিস্তার প্রকল্প রিপোর্ট (ডিপিআর) জমা দিয়েছে। যেখানে কেন্দ্র হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরির জন্য বরাদ্দ মঞ্জুর করেছে রাজ্যকে।”
জয়রাম চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রীকে লিখছেন, “আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, গত ১৬ অগস্ট আমি একটা চিঠি দিয়ে এডিবি-র অর্থ সাহায্যে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে ২০০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরির জন্য অনুমোদন দিয়েছিলাম। কিন্তু তার পরে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে ২০০-র পরিবর্তে ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরির করার কথা ভাবি। আর ওই সিদ্ধান্ত ১১ অক্টোবর আপনাকে জানিয়েছি।” জয়রামের ওই সিদ্ধান্তের পরে জঙ্গলমহল এলাকার উন্নয়নে এডিবি-র আরও টাকা আসা উচিত দাবি করে তাঁর এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের উপরে চাপ সৃষ্টি করেন মমতা। সেই প্রসঙ্গের উল্লেখ করে জয়রাম চিঠিতে লিখেছেন, “আমি সেই দাবি মেনে পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ার কথা ভেবে এডিবি-র টাকায় ৫০০ কিলোমিটারের বদলে ১০০০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরির সিদ্ধান্ত নিই। এবং সেটাও ৫ নভেম্বর আমি আপনাকে জানিয়েছি।”
তার পর কী হল?
জয়রামের চিঠি থেকেই মমতা জানতে পারেন, যেখানে হাজার কিলোমিটার রাস্তার কেন্দ্রীয় বরাদ্দ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে ৭২ কিলোমিটারের বেশি রাস্তার জন্য প্রকল্প রিপোর্ট দিতেই পারেনি রাজ্য। জয়রাম মমতাকে লিখেছেন, “এডিবি-র অর্থ সাহায্যে প্রধানমন্ত্রীর গ্রামীণ সড়ক যোজনা প্রকল্পের তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ের জন্য দ্বিতীয় কিস্তির ২৫৮ কোটি ৪৭ লক্ষ টাকা আমার মন্ত্রক মঞ্জুর করে দিয়েছে।” ঘটনা হল, পরামর্শদাতা নিয়োগ হয়নি বলে পশ্চিমবঙ্গকে টাকা দিতেই রাজি হচ্ছিল না এডিবি। তখন জটিলতা দূর করতে উদ্যোগী হন জয়রাম। তিনি মমতাকে বলেন, “আপনি রাজ্য সরকারকে পরামর্শদাতা নিয়োগ করতে বলুন। আমি টাকাটা মঞ্জুর করে দিচ্ছি।’’ কিন্তু কেন্দ্র টাকা মঞ্জুর করে দিলেও পরামর্শদাতা আজও নিয়োগ হয়নি।
এর পাশাপাশি সড়ক তৈরির প্রকল্পও জমা দেয়নি রাজ্য। জয়রাম তাঁর চিঠিতে মমতাকে জানিয়েছেন, “২০১১ সালের মধ্যে এই প্রকল্পের তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে মোট ১১৪০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরির কথা থাকলেও মাত্র ৭২ কিলোমিটার রাস্তার জন্য প্রকল্প রিপোর্ট জমা পড়েছে।” তা ছাড়া, ২০১১-১২ সালে গ্রামীণ সড়কের রক্ষণাবেক্ষণে কেন্দ্রের বরাদ্দ করা ৪৫ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকার মধ্যে মাত্র ২৩ কোটি টাকা রাজ্য সরকার খরচ করতে পেরেছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। জয়রাম চিঠিতে মমতাকে স্পষ্ট বলেছেন, “এই বিষয়ে আপনার জরুরি ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। এডিবি-র ঋণ যাতে আটকে না যায় এবং রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণের টাকাও যাতে ঠিকমতো পাওয়া যায়, সে ব্যাপারটা আপনি দেখুন।”
জয়রাম অবশ্য বরাবরই পশ্চিমবঙ্গের (বিশেষত জঙ্গলমহল) উন্নয়নে মমতাকে সাহায্য করেছেন। কেন্দ্রের সঙ্গে খুচরো-বিতর্ক বা তিস্তা-প্রসঙ্গ নিয়ে মমতার যতই মতপার্থক্য হোক না কেন, জয়রাম কিন্তু বরাবরই তাঁকে সমর্থন করে এসেছেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকেও খুচরো-বিতর্কে মমতার সুরেই সুর মিলিয়েছেন জয়রাম। তাই সব দিক ভেবেই জয়রামের চিঠির পরে মমতা চন্দ্রনাথকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য।
বিষয়টি নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন সুব্রতবাবুর সঙ্গেও, যাঁর কাজের নিষ্ঠা মুখ্যমন্ত্রীর নজর এড়িয়ে যায়নি। সুব্রতবাবুর মতো ‘অভিজ্ঞ’ মন্ত্রী মমতার মন্ত্রিসভায় নেই। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন সুব্রতবাবু। তার পর থেকে তিনি বহু বার বিধায়ক হয়েছেন। পাশাপাশি, ২০০০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত কলকাতার মেয়র হিসেবে দক্ষতার সঙ্গেই কাজ করেছেন। তা সত্ত্বেও তিনি জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের মতো তুলনামূলক ভাবে গুরুত্বহীন দফতরের দায়িত্ব পাওয়ায় অনেকেই ঠাট্টা করে তাঁকে ‘টিউবওয়েল মন্ত্রী’ আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু এই বিষয়ে মমতার কাছে কখনওই আপত্তি জানাননি সুব্রতবাবু। বরং নিজের দফতরের প্রাসঙ্গিকতা বাড়াতে কাজ করেছেন গ্রামে গ্রামে। তাই সুব্রতবাবুকেই ভরসা করে এ বার বাড়তি দায়িত্বভার সঁপেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
মমতার এই সিদ্ধান্তে আশঙ্কিত অন্য মন্ত্রীরাও। কারণ কিছু দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী টাউন হলে বিভাগীয় সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সব দফতরের কাজের রিপোর্ট তাঁর কাছেই রয়েছে। যার ভিত্তিতে রদবদল হওয়ার কথা জানুয়ারিতে।
তাই নতুন বছরে কার কী দফতর থাকবে, তা ভেবে আপাতত কপালে ভাঁজ রাজ্যের মন্ত্রীদের। |