বেলা ১১টা থেকে শুরু হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত বিতর্কের শেষে পাশ হয়ে গেল বহু বিতর্কিত লোকপাল বিল। কিন্তু রাহুল গাঁধী চাইলেও, লোকপালকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হল মনমোহন সিংহের সরকার। এ জন্য যে সংবিধান সংশোধনী বিল আনা হয়েছিল, তাতে বিজেপি-বাম-সহ বিরোধীদের একটা বড় অংশ আপত্তি তোলে। অভিযোগ ছিল, লোকপালের আদলে রাজ্য সরকারকে লোকায়ুক্ত তৈরি করতে বাধ্য করে রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে কেন্দ্র। ভোটাভুটিতে হেরে গিয়ে সরকার শেষ পর্যন্ত এই বিল পাশ করাতে পারেনি।
সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ না হওয়ার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্ব এখন বিজেপি-র ঘাড়েই যাবতীয় দায় চাপাচ্ছেন। পাশাপাশি নিজেদের ‘জয়’-কেই বড় করে তুলে ধরতে চাইছেন। সংবিধান সংশোধনী বিল পরাস্ত হওয়ার পরেই প্রণব মুখোপাধ্যায় বিজেপি-কে ‘সতর্ক’ করে দিয়ে বলেছেন, বিল আটকানোর জন্য তাদের নির্বাচনে খেসারত দিতে হবে। এ ভাবে নির্বাচনী প্রচারের সুর বেঁধে দেওয়ার জন্য তাঁকে বাহবা জানিয়েছেন সনিয়া গাঁধী। অন্য দিকে বিজেপি নেতারা মনে করছেন, তাঁরা খুব একটা ভুল করেননি। কারণ অণ্ণা হজারেও সরকারের এই বিলকে সমর্থন করছিলেন না। সংবিধান সংশোধনের দাবিও তিনি তোলেননি। বিজেপি নেতৃত্ব বলছেন, কংগ্রেস যা-ই প্রচার করুক, পাল্টা প্রচারে তা বুঝে নেওয়া হবে। এই পরিস্থিতিতে আগামিকাল রাজ্যসভায় মূল লোকপাল বিলের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
অণ্ণার আন্দোলনকে অপ্রাসঙ্গিক করার লক্ষ্যে বিরোধী থেকে শুরু করে শরিকদের নানাবিধ আপত্তির জট কাটিয়ে আজই লোকসভায় লোকপাল বিল পাশ করাতে মরিয়া ছিলেন মনমোহন। তারা যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সেই বার্তা দিতে আজ কেন্দ্র একই সঙ্গে লোকপাল বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং যাঁরা দুর্নীতি প্রকাশ্যে এনেছেন, তাঁদের সুরক্ষায় ‘হুইসল ব্লোয়ার বিল’ নিয়ে এসেছিল। সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ না হলেও লোকপাল-সহ দু’টি বিল পাশ হয়ে গিয়েছে। লোকপাল বিলে বিরোধী তথা শরিকদের দাবি মেনে সরকার কিছু সংশোধনও করেছে। কিন্তু অণ্ণা শিবিরের যে সব দাবি ছিল, তাতে বিজেপির সমর্থন থাকলেও সরকার তা মেনে নেয়নি। |
তবে লোকসভায় লোকপাল বিল পাশ হলেও রাজ্যসভায় তার ভাগ্য কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ আজ লোকসভায় বিল পাশের সময় মুলায়ম সিংহ যাদব ও মায়াবতীর দল ‘ওয়াক-আউট’ করে সরকারকে অনেকটাই সুবিধা করে দিয়েছে। কিন্তু রাজ্যসভায় বিল পাশ করাতে হলে এদের ভোট প্রয়োজন। ফলে শেষ পর্যন্ত সংসদে লোকপাল বিল পাশ হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিজেপি-র কৌশল কী হবে, তা নিয়েও দলের নেতারা ভাবনাচিন্তা করছেন। সংবিধান সংশোধনী বিলের মতো রাজ্যসভায় যদি মূল বিল আটকে যায়, তার গোটা দায় বিজেপি-র ঘাড়েই ঠেলতে চাইবে কংগ্রেস। প্রণববাবু আজই যুক্তি দিয়েছেন, সরকার লোকপাল মজবুত করার জন্যই তাকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিতে চেয়েছিল। এ জন্য বিজেপি-কে দায়ী করে প্রচারে যেতে চাইছে কংগ্রেস। তবে নিজের পক্ষের সব সাংসদকে যে সরকার লোকসভায় হাজির করতে পারেনি সেটাও স্পষ্ট। রাহুল নিজে উত্তরপ্রদেশ থেকে ভোট দিতে এলেও হুইপ সত্ত্বেও অনুপস্থিত ছিলেন ১২ কংগ্রেস সাংসদ। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
লোকপাল বিল পাশ হলেও তার মূল ভিত নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ কেন্দ্র সংবিধানের ২৫৩ নম্বর অনুচ্ছেদের আওতায় লোকপালের ধাঁচে রাজ্যে লোকায়ুক্ত গঠন বাধ্যতামূলক করতে চেয়েছিল। বিজেপি-বামেদের দাবি ছিল, ২৫২ নম্বর অনুচ্ছেদের আওতায় লোকপাল গঠন করে তা রাজ্যের সামনে শুধু মডেল হিসেবে তুলে ধরা হোক। শরিক দল তৃণমূল-ডিএমকে এই যুক্তির সমর্থক হলেও সরকারের পাশেই ছিল। চাপের মুখে সরকার মেনে নেয়, কেন্দ্রে লোকপাল বিল পাশ হয়ে গেলেও, রাজ্য সরকারের অনুমতি নিয়ে তবেই লোকায়ুক্ত গঠনের বিজ্ঞপ্তি জারি হবে। কিন্তু তার পরেও সংবিধান সংশোধনী বিলে সুষমা স্বরাজ এ নিয়ে আপত্তি তোলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরই জয় হয়। তবে আপত্তি তুলেও সরকারের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য বিজেপি তৃণমূল নেতাদের কটাক্ষ করেছে। রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী আবার বিজেপি-র সঙ্গে বামেদের হাত মেলানো নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি।
তবে শেষ পর্যন্ত যে ভাবেই হোক লোকপাল বিল পাশ হওয়ায় সরকারের দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব তুলে ধরা যাবে বলে মনে করছে কংগ্রেস। অন্য দিকে, বিরোধীদের অভিযোগ, যেমন-তেমন ভাবে লোকপাল বিল পাশ করিয়ে অণ্ণা হজারে ও জনমানসে নিজেদের দুর্নীতি বিরোধী ভাবমূর্তি তৈরি করাটাই সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল।
যদিও প্রধানমন্ত্রী নিজে আজ বিতর্কে অংশ নিয়ে বিজেপি-কে রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতার উপরে উঠে লোকপাল বিল সমর্থনের আর্জি জানান। তিনি যুক্তি দেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমানসে ক্ষোভের কথা মাথায় রেখে লোকপাল গঠন করা প্রয়োজন। মুম্বইতে যখন অণ্ণার অনশনে এমনিতেই ভিড় কম হচ্ছে, তখন লোকপাল বিল পাশ করিয়ে অণ্ণার অনশন, জেল ভরো বা সনিয়া-রাহুলের বাড়ির সামনে ধর্নার কর্মসূচিকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ করে দিতে চেয়েছিল চেয়েছে মনমোহন-সরকার। কিন্তু কেন্দ্রের এই তাড়াহুড়ো করে লোকপাল বিল পাশের মরিয়া চেষ্টাকেই আক্রমণ করেছেন বিরোধীরা। বিজেপি বলছে, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সরকার দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ বিল পাশ করাতে চাইছে। লালুপ্রসাদ, শরদ যাদবের মতো অনেক নেতার আবার মত, তাড়াহুড়ো করে আসলে অণ্ণার সামনে মাথা নত করছে কেন্দ্র। যার ফলে সংসদের গরিমাও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
তাই শুধু বিরোধী শিবির নয়,আজ লোকসভার কক্ষে তাই মনমোহন-সরকারকে অণ্ণা শিবিরের সঙ্গেও ছায়া-যুদ্ধ করতে হয়েছে। অণ্ণা লোকপাল বিলের যে সব বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন, তার জবাব দিতে হয়েছে সরকারকে। লোকপাল বিল পাশ হয়ে যাওয়ায় এর পরে অণ্ণার অনশন চালিয়ে যাওয়া বা জেল ভরো ও ধর্না আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কংগ্রেস নেতারা। যদিও অণ্ণা-শিবিরের বক্তব্য, সরকার আসলে এক দুর্বল ও ত্রুটির্পূণ লোকপাল বিল তৈরি করেছে। অণ্ণার দাবি ছিল, লোকপাল ও লোকায়ুক্তের নিজস্ব তদন্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। লোকপালকে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে তদন্ত করার অধিকার দিতে হবে। লোকপাল নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নিরপেক্ষ প্যানেলের হাতে দিতে হবে। নিচু তলার সরকারি কর্মীদেরও লোকপালের আওতায় আনতে হবে। এ সব ক্ষেত্রে বিজেপি তথা অন্য বিরোধী দলগুলিরও সমর্থন ছিল। কোনওটিই মেনে নেয়নি মনমোহন-সরকার। তবে বিরোধী ও শরিকদের দাবি মেনে লোকপাল বিলে বেশ কিছু সংশোধন করেছে সরকার। যেমন, প্রধানমন্ত্রীর রক্ষাকবচের ক্ষেত্রে বিলে প্রথমে বলা ছিল, লোকপালের তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের মত থাকলে তবেই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে লোকপাল তদন্ত শুরু করা যাবে। তবে বিজেপি-র দাবি মেনে সরকার বিলে সংশোধন করেছে। লোকপালের সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন থাকলেই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করতে পারবে লোকপাল। একই ভাবে সাংসদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে লোকপালের কাছে স্পিকারের জবাবদিহি ও মামলা শেষ হওয়ার আগেই সাংসদদের সরানোর প্রশ্নেও বিরোধী ও শরিকরা এককাট্টা ছিল। সেই দাবিও মেনেছে কেন্দ্র। লালুর আপত্তিতে মেনে নিয়েছে সামরিক বাহিনীকে লোকপালের আওতার বাইরে রাখার বিষয়টিও। তবে লোকপালে সংখ্যালঘু সংরক্ষণ নিয়ে বিরোধী শিবির ছত্রভঙ্গ ছিল। বিজেপি ছাড়া আর কেউ সংখ্যালঘু সংরক্ষণের বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি। |