|
|
|
|
|
|
সংবাদপত্রের বাইলাইনে যখন তোমার নাম |
ভাষার ওপর দক্ষতা, চার পাশের ঘটনাক্রম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা
মাস কমিউনিকেশন এবং জার্নালিজম-এর প্রধান শর্ত। এই দুটি বিষয়ের ওপর
ভিত্তি করে এখন নানা ক্ষেত্রে গড়া যায় কেরিয়ার। জানাচ্ছেন শুভ্রা চক্রবর্তী |
মাস কমিউনিকেশন’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন’। আমাদের দেশে বর্তমানে ইউ জি সি বিষয়টিকে যে আঙ্গিকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তার বিস্তৃতি অনেকটাই। এই মুহূর্তে জার্নালিজম-এর প্রতিটি ক্ষেত্র অর্থাৎ টি ভি, রেডিয়ো এবং প্রিন্ট মিডিয়া, অ্যাডভার্টাইজিং, পাবলিক রিলেশনস, ফিল্ম স্টাডিজ, স্পোর্টস অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন ম্যানেজমেন্ট সব ক’টি এই বিষয়ের আওতায় পড়ে।
এ বারে আসা যাক এই বিষয়ে বিভিন্ন কোর্সের কথায়। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস কমিউনিকেশনে মাস্টার্স ডিগ্রির সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্স। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা কোর্সের পাশাপাশি রয়েছে ছোট ছোট সার্টিফিকেট কোর্স করার সুবিধা।
ভারতে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি এই বিষয়ে অগ্রণী, তার মধ্যে রয়েছে দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব মাস কমিউনিকেশন বা আই আই এম সি (http//www.iimc.nic.in)। এখানে জার্নালিজম ছাড়াও অ্যাডভার্টাইজিং এবং পাবলিক রিলেশনস-এর ১ বছরের ডিপ্লোমা কোর্স রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি মিডিয়ায় কর্মরতদের জন্য বিশেষ স্বল্পমেয়াদি কোর্স ছাড়াও রয়েছে ৪ মাসের ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম-এর ডিপ্লোমা কোর্স। ভর্তির অ্যাডমিশন টেস্টে বসার ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক। এ ছাড়া নতুন দিল্লিরই ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মাস মিডিয়া (www.iimmdelhi.com), পুণের সিমবায়োসিস ইনস্টিটিউট অব মাস কমিউনিকেশন (http:/www.simc.edu), আহমদাবাদের মুদ্রা ইনস্টিটিউট অব কমিউনিকেশন (http://www.mica.ac.in/mode/home), নতুন দিল্লির ভারতীয় বিদ্যা ভবনের সর্দার প্যাটেল কলেজ অব কমিউনিকেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, (http://www.bvbdelhi.org/sardar_patelcollege/sardar.html) চেন্নাই-এর এশিয়ান কলেজ অব জার্নালিজম (www.asianmedia.org), বেঙ্গালুরুর কনভারজেন্স ইনস্টিটিউট অব মিডিয়া, ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনলজি স্টাডিজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানও বিষয়টি পড়ানোর ক্ষেত্রে পরিচিত নাম।
আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে এই বিষয়ে মূলত তিন ধরনের কোর্স করানো হয়
১) কলেজগুলিতে অনার্স বা পাস কোর্স,
২) বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ২ বছরের এম এ কোস
এবং
৩) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্স ।
১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আংশিক সময়ের জন্য জার্নালিজম কোর্সটি পড়ানো শুরু হয় ১ বছরের ডিপ্লোমা কোর্স হিসেবে। এখন এখানে ২ বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি পড়ার সুযোগ রয়েছে। অনার্স-সহ স্নাতক স্তরের পর এই কোর্সে ভর্তি হওয়া যায় প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে। এ ছাড়া রয়েছে সেলফ ফিনান্সড দু’টি ডিপ্লোমা কোর্স একটি মাস কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজমে (আসন সংখ্যা ৬০, খরচ ১২০০০ টাকা)-এ এবং অন্যটি ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশনে (আসন সংখ্যা ৫০, খরচ ৭৫০০ টাকা)-এ। দু’টিই ১ বছরের কোর্স।
এ ছাড়া, মাস কমিউনিকেশনে এম এ-এর সুযোগ রয়েছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২ বছরের কোর্সটি পড়ার ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক। এখানে লিখিত পরীক্ষা এবং ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করা হয়। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (এম এ মাস কমিউনিকেশন), উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় (এম এ মাস কমিউনিকেশন) ছাড়া কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে ইনস্টিটিউট অব মাস কমিউনিকেশন, ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন স্টাডিজ-এ ৩ বছরের ডিগ্রি কোর্স রয়েছে মিডিয়া স্টাডিজ-এ। এ ছাড়াও রয়েছে এম এ ইন মাস কমিউনিকেশন অ্যান্ড কমিউনিটি জার্নালিজম এবং মাস কমিউনিকেশনে ডিপ্লোমা কোর্স। |
|
উচ্চ মাধ্যমিকের পর ৩ বছরের ডিগ্রি কোর্সে জার্নালিজম পড়ানো হয় আশুতোষ, সাউথ ক্যালকাটা গার্লস, মুরলীধর গার্লস, নেতাজিনগর, শ্রী শিক্ষায়তন প্রভৃতি কলেজে। এ ছাড়া, ভবনস কলেজ অব কমিউনিকেশনস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, ভবানীপুর (২৪৭৪-৮৫১৮) এবং সল্টলেক (২৩৩৫-০১৫২), অক্সফোর্ড কলেজ অব এডুকেশন-এ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা পড়া যায়।
মাস কমিউনিকেশনের বিভিন্ন বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান প্রিন্ট মিডিয়া। আর এখনও পর্যন্ত অডিয়ো-ভিসুয়ালের দুরন্ত দাপটের যুগে খবরের কাগজগুলো নিত্য-নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েও স্বমহিমায় টিকে রয়েছে। প্রায় নতুন একটি দৈনিকের সহ-সম্পাদক ভবেশ দাশ, যিনি বহু কাল রেডিয়ো এবং দূরদর্শনের বার্তা-সম্পাদকের দায়িত্ব সামলেছেন, জানালেন: ‘এখনকার ছেলেমেয়েরা তাৎক্ষণিক নাম এবং পরিচিতির মোহে অডিয়ো-ভিসুয়াল মাধ্যমের দিকে ঝুঁকলেও, এখনও সত্যিকারের সাংবাদিকতা শিখতে চাওয়া ছাত্রছাত্রীরা প্রিন্ট মিডিয়াতেই কাজ খোঁজে।’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজমের প্রথম ব্যাচের ছাত্র এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান সুনীত কুমার মুখোপাধ্যায় বললেন: ‘১৯৫০ সালে প্রথম আংশিক সময়ের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপ্লোমা কোর্স চালু হয়। সে সময়ের দিক্পাল শিক্ষকেরা বিষয়টি পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রের মাধ্যমে কী ভাবে দেশের সেবার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করা যায়, তার শিক্ষাও দিতেন। পরে, আস্তে আস্তে সময়ের সঙ্গে সংবাদপত্রের ভূমিকা পাল্টেছে। নিরপেক্ষতার সম্পূর্ণ ভারসাম্য সব সময় রাখতে না পারলেও, জনমানসে নিরপেক্ষ মতবাদের ক্ষেত্রে
অডিয়ো-ভিসুয়ালের তুলনায় বোধ হয় প্রিন্ট মিডিয়া-ই এখনও এগিয়ে।’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরই জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন বিভাগের অধ্যাপক সৌমেন্দ্রনাথ বেরার কথায়: ‘চাকরির বাজারে অডিয়ো-ভিসুয়াল মিডিয়ার চাহিদা সবচেয়ে বেশি হলেও প্রিন্ট মিডিয়াতে কিন্তু ভাল ছাত্রছাত্রীর চাহিদা রয়েছে। এক জনের হাতেখড়ি যদি প্রিন্ট মিডিয়ায় হয়, তা হলে পরে চ্যানেলগুলোতে ডেস্কের কাজে ক্ষেত্রে গুরুত্ব সে-ই বেশি পায়। নিউজ সেন্স তৈরি করা, কতটা নেব, কতটা ফেলব এ সবই সংবাদপত্রে কাজ করতে গেলে হাতনাতে শেখা যায়।’
উপস্থাপনার বৈচিত্রের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভবেশবাবু জানালেন, ‘এখন প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রতি দিনই একটি কাগজের সঙ্গে আর একটা কাগজের প্রতিযোগিতা চলে। কী ভাবে প্রথম পাতার খবরের রকমফের ঘটানো যায় অথবা কোনও ‘হার্ড নিউজ’কে শুধু মাত্র লেখায় সীমাবদ্ধ না রেখে গ্রাফিক্স, স্ট্যাটিসটিক্স বা ছবির মাধ্যমে পাঠকদের পড়ার ও বোঝার সুবিধা বাড়ানো যায়।’ একটি পাতা সাজাতে গেলে এখন শুধু এটা ভাবলে চলে না যে, এটা শুধু মাত্র পাঠক পড়বে। এটাও ভাবতে হয় যে, পাঠক পড়ার সময় না পেলে শুধু দেখবে। ওই দেখার মধ্যেই যাতে সে খবরের সারটুকু পায়, সেটা দেখাও সংবাদ পরিবেশনকারীর কাজ। ফলে, ইনফরমেশন অ্যান্ড এন্টারটেনমেন্ট এখন অডিয়ো-ভিসুয়াল নয়, প্রিন্ট মিডিয়ারও মূল কথা।’
কিন্তু এ কালের ছাত্রছাত্রীদের অডিয়ো-ভিসুয়ালমুখী হওয়ার প্রধান কারণটা কী? ভবেশবাবুর মতে: ‘এখনকার ছেলেমেয়েরা নিজেদের সঠিক ক্ষমতা কোথায়, সেটার মূল্যায়ন করতে পারছে না। যার হয়তো তাৎক্ষণিক বলা, এক টানা বলা বা খবর পড়ার প্রাথমিক যোগ্যতায় খামতি রয়েছে, সেও দৌড়োচ্ছে চ্যানেলের দিকে। হয়তো লেখার ক্ষেত্রে তার সাবলীলতা অনেক বেশি। ফলে, এরা মিডিয়াজগতে খুব বেশি দূর যেতে পারছে না।’
একই অভিমত বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজেশ দাসের। তাঁর মতে, ‘ইংরেজি এবং বাংলা ভাষার ওপর দখল জার্নালিজম এবং মাস কমিউনিকেশন বিষয়ের মূল কথা। সেটা থাকলে, এই বিষয় পড়ে শুধুমাত্র অডিয়ো-ভিসুয়ালই একমাত্র গন্তব্য নয়, বিভিন্ন নিউজ এজেন্সি, সরকারি এবং বেসরকারি তথ্য-সম্প্রচার দফতরের চাকরির পরীক্ষা, নেট, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চ্যানেলগুলোর ডেস্কের কাজ পাওয়ার পথও খুলে যায়। তবে, ভাষার ওপর দখল এবং পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে জ্ঞানটা থাকা আবশ্যিক।’ একই সঙ্গে, দিনে দিনে বেড়ে চলেছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে খবরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চাহিদা। এ ক্ষেত্রেও কিন্তু ভাষার ওপর দখল এবং নিউজ সেন্স আছে এমন কনটেন্ট রাইটারই প্রয়োজন।
সুতরাং, সব দিক থেকে দেখতে গেলে টেলিভিশনের এই রমরমার যুগেও প্রিন্ট মিডিয়া তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই বিরাজমান। আর, এখনও যাঁরা সকালের কাগজে ‘বাইলাইনে’ নিজের নাম দেখার শিহরণ পেতে উৎসাহী, তারা প্রিন্ট মিডিয়াতেই নিজেদের ঘষেমেজে নিতে চায়। |
|
|
|
|
|