’১১-র সেরা ১১
মহম্মদ বুয়াজিজি
বছরখানেক আগে এমনই এক পৌষের সকালে (১৭ ডিসেম্বর, ২০১০) উত্তর আফ্রিকার টিউনিসিয়ার অনামা জনপদ সিদ্দি বুজিদ-এ ২৬ বছরের এক তরুণ ফলবিক্রেতা তাঁর বাজেয়াপ্ত হওয়া পসরা ফেরত না পাওয়ার ক্ষোভে গায়ে তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। আঠারো দিন পর মহম্মদ বুয়াজিজি-র মৃত্যু হয়। জেগে ওঠেন টিউনিসিয়ার জনগণ, স্বৈরাচারী শাসক জিনে আল-আবেদিন বেন আলির অপশাসনের বিরুদ্ধে। শুরু হয় ‘আরব বসন্ত’। বুয়াজিজির মৃত্যুর পক্ষকালের মধ্যে প্রেসিডেন্ট বেন আলিকে টিউনিসিয়া ছেড়ে সপরিবারে সৌদি আরবে পালাতে হয়। টিউনিসিয়া থেকে মিশর। তাহরির স্কোয়ারে সমবেত গণতন্ত্রকামী জনতার নাছোড় দাবি ও আন্দোলনকে সান্ত্রি-সেপাই দিয়ে দমন করতে না পেরে জানুয়ারির শেষে গদি ছাড়তে বাধ্য হন মিশরের একনায়ক হোসনি মুবারক। ক্রমে রক্তপাতহীন এই ‘জুঁই বিপ্লব’-এর সৌরভ ছড়িয়ে পড়তে থাকে জর্ডনে, ইয়েমেনে, বাহরিনে, মরক্কোয়, সিরিয়ায় ও লিবিয়ায়। জর্ডন, মরক্কো ও বাহরিনের শাসকরা গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি মেনে নিয়ে জায়মান গণবিক্ষোভ শুরুতেই সামলে নেন। কিন্তু ইয়েমেন, লিবিয়া ও সিরিয়ার একনায়করা বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্রপরিমাণ জমিও ছাড়তে নারাজ। তাই সেখানে সরকার ও বিরোধী পক্ষে সংঘর্ষ শুরু হয়। ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে বোমা পড়ার পর কয়েক মাসের জন্য সৌদি আরবে পালিয়ে যান। পরে ফিরে এলেও বিদ্রোহী বাহিনীকে শায়েস্তা করতে পারেননি। তাঁকেও সরে দাঁড়াতে হয়। ফেব্রুয়ারির শেষে লিবিয়ায় যে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ শুরু হয়, মুয়াম্মার গদ্দাফির সামরিক দমননীতি তাকে সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপান্তরিত করে। অবশেষে ন্যাটো-র বিমানহানায় গদ্দাফির প্রতিরোধ চূর্ণ হলে বিদ্রোহী মিলিশিয়া ৪২ বছর ধরে একনায়কত্ব চালানো গদ্দাফিকে তাড়া করে, ঘিরে ফেলে এবং হত্যা করে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ এখনও জনতার উপর ট্যাংক ও সাঁজোয়া বাহিনী দিয়ে দমন নামাচ্ছেন। তবে মুসলিম বিশ্বে তিনি ক্রমেই একঘরে। সেনাবাহিনীতে ভাঙন, পাঁচ হাজার মানুষের মৃত্যুর পরেও জনতার প্রতিবাদ অব্যাহত। মুবারক-হীন মিশরেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে নতুন করে নাগরিক সমাজের দ্বন্দ্ব তীব্র হচ্ছে।

ওসামা বিন লাদেন
২ মে, ২০১১। অ্যাবটাবাদ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাকিস্তান। বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা বোধহয় ঘটেছিল এখানেই। আফগানিস্তানের আকাশ-পথে মার্কিন নৌবাহিনীর একটি স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (SEAL) পরিচালিত বিমানের ঝাঁক পাকিস্তানি আকাশে প্রবেশ করে, অ্যাবটাবাদে একটি বিশেষ বাড়ির (ছবি) ছাদে ল্যান্ড করে, এবং দ্রুত হানায় নিধন করে সেই গোপন আস্তানার বাসিন্দা ওসামা বিন লাদেনকে। ২০০১ সালের নাইন-ইলেভন-এর পর যে অক্লান্ত সন্ধান শুরু হয়েছিল আল কায়দার এই কিংবদন্তি নেতার জন্য, এক দশক পরে তা শেষ হল। প্রেসিডেন্ট ওবামা হোয়াইট হাউস থেকে আমেরিকার এক নম্বর শত্রুর ধ্বংস-সংবাদ জানালেন। ৫ মে, আল কায়দার পক্ষ থেকে বিন লাদেন-এর মৃত্যুসংবাদ ঘোষিত হল। নতুন নেতা আল-জাওয়াহিরি ইতিমধ্যেই দলের হাল ধরেছেন, এবং এ ঘটনার প্রতিফল ফলবেই, এ-ও বলা হল। ইসলামি দুনিয়ার আরও কিছু জঙ্গি গোষ্ঠী প্রতিহিংসার প্রতিশ্রুতি জানাল, যেমন প্যালেস্তাইনের হামাস। আফগানিস্তানে বিন-লাদেনের দেহ নিয়ে আসা হয়েছিল শনাক্তকরণের জন্য, সেখান থেকে বিমানবাহিত হয়ে সেই দেহ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আরব সাগরে নিক্ষেপ করা হয় বলে মার্কিন পক্ষের দাবি। এই ঘটনার পর থেকেই আফগানিস্তান যুদ্ধ শেষ করার জন্য প্রেসিডেন্ট ওবামার উপর চাপ বহুলাংশে বাড়তে থাকে, যদিও ২০১১ সালে শেষ পর্যন্ত ইরাক থেকে মার্কিন সেনা সরতে দেখা গেলেও আফগানিস্তান পরিস্থিতিতে এখনও কোনও পরিবর্তনের চিহ্ন নেই।

অণ্ণা
কিসেন বাবুরাও হজারে। এই নামে না চিনলেও ‘অণ্ণা’কে চেনেন না, এমন ভারতীয় এ বার খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এপ্রিল মাসে দিল্লিতে অনশনে বসেছিলেন অণ্ণা দাবি, জন লোকপাল তৈরি করতে হবে। লোকপাল বা অম্বুডসমান-এর ধারণাটি পুরনো। সরকার এবং প্রশাসন ঠিক ভাবে কাজ করছে কি না, দুর্নীতি হচ্ছে কি না এই বিষয়গুলির ওপর নজরদারি করাই এই প্রতিষ্ঠানটির কাজ। অণ্ণার সমর্থনে মানুষের ঢল নামল। ছাত্র থেকে ফিল্ম স্টার, তাঁর তিন দফা অনশনে হাজির হলেন অনেকেই। সরকার বিব্রত। লোকপালের প্রশ্নে অণ্ণার প্রায় সব দাবিই কার্যত মেনে নেওয়া হচ্ছে।
অবশ্য, এই বছরটি কেন্দ্রের ইউ পি এ সরকারের পক্ষে অতি বিড়ম্বনার ছিল। আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে আন্দিমুথু রাজা, সুরেশ কলমডীর মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা তিহার জেলে বন্দি। পালানিয়াপ্পন চিদম্বরমের বিরুদ্ধেও বার বার অভিযোগ উঠছে। দেশের আর্থিক পরিস্থিতি ক্রমে খারাপ হচ্ছে, বছরভর মূল্যস্ফীতির হার চড়াই থেকেছে। টাকার দাম সর্বকালের নিম্নতম স্তরে পৌঁছেছে। বছরের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে রিটেল ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদনের প্রস্তাব সংসদে পেশ করেও পিছিয়ে আসতে হয়েছে সরকারকে। ২০১২ সালে অন্তর্বর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা একেবারেই নেই, এমনটা বলে দেওয়া কঠিন।

আই ওয়াইওয়াই
আই ওয়াইওয়াই চিনের প্রথম সারির শিল্পীদের এক জন। কিন্তু, এই বছর তিনি তাঁর শিল্পের জন্য খবরের শিরোনামে নন তিনি এই বছর চিনের কমিউনিস্ট সরকারের কোপে পড়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ায় যখন গোটা আরব দুনিয়া স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতায় উত্তাল, সেই ঢেউয়ের ছোঁওয়া লেগেছিল চিনেও। ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ করে রাজধানী বেজিংয়ের রাস্তায় নামেন বেশ কিছু মানুষ। চিনের এই বিক্ষোভের নাম হয় ‘জেসমিন রেভোলিউশন’। কর্তৃপক্ষ কোনও ঝুঁকিই নেয়নি। ইন্টারনেটে প্রবল নিয়ন্ত্রণ জারি হয়। বিপ্লবপন্থীদের সটান জেলবন্দি করা হয়, বিদেশি সংবাদমাধ্যমের ওপর প্রভূত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
ওয়াইওয়াই এমনিতেই সরকার-বিরোধী হিসেবে পরিচিত। তিনি এই বিপ্লবকে সমর্থন জানান। পুলিশ তাঁকে আটক করে। পরে তাঁকে জেল থেকে ছাড়লেও আয়কর ফাঁকির ‘মিথ্যা’ মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়। চিনে এমন ঘটনা আখছারই ঘটে। দৃষ্টিহীন নাগরিক অধিকারকর্মী চেন গুয়াংচেং যেমন। পুলিশ তাঁকে গৃহবন্দি করে রেখেছে। তাঁর সাত বছরের মেয়ের স্কুলে যাওয়াও বন্ধ। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুখ খোলার শাস্তি। চিনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক স্তরে বেশ কয়েক বার উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু, চিন অটল। এই বাজারে তার যা আর্থিক শক্তি, তাতে কাউকে পাত্তা না দিলেও চিনের চলবে।

স্টিভ জোবস
মাঝেমধ্যেই টিভির পর্দায় কিংবা সংবাদপত্রে দেখা যেত তাঁর কালো গোলগলা টি-শার্ট ও নীল জিনস পরা চেহারাটি। স্টিভেন পল জোবস। বিশ্বের অন্যতম নামকরা প্রযুক্তিসংস্থা ‘অ্যাপল’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন সিইও, এবং প্রাণপুরুষ। প্রতি বারই যাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে যুক্ত থাকত নতুন কিছুর সূচনা। যা প্রযুক্তির দুনিয়ায় নিয়ে আসত নতুন আলোড়ন। তা সে উন্নত প্রযুক্তির ম্যাক কম্পিউটার হোক বা হোক আইপড, যা বদলে দেয় আমাদের গান শোনার ধারণাকে। অ্যাপল-এর আই-ফোন তো ফোনে কথা বলার সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছে। টাচস্ক্রিনে আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় ই-মেল করা, গান শোনা, ছবি তোলা তো যায়ই, ফোনও করা যায়। ২০১০ সালে সংস্থার নতুন সংযোজন ছিল আই প্যাড। ট্যাবলেট কম্পিউটার। মেল করা, গান শোনা, সিনেমা দেখা থেকে শুরু করে পাতা উল্টে ‘অ্যানিমেটেড’ বই পড়ার ক্ষেত্রেও যার কোনও তুলনা হয় না।
কোনও নতুন পণ্য বাজারে আনার আগেই সেটা নিয়ে চূড়ান্ত রহস্যের সৃষ্টি করা, বাজার ধরার নিত্যনতুন পরিকল্পনা এগুলিই ছিল সংস্থার ট্রেড মার্ক, যা অনেকাংশেই ছিল জোবসের মস্তিষ্কপ্রসূত। আর তাই যখনই অ্যাপল-এর কোনও পণ্য বাজারে এসেছে তা যেমন শিহরিত ও বিস্মিত করেছে সকলকে, তেমনই এক ধাক্কায় কয়েকশো ধাপ এগিয়ে গিয়েছে তার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায়।
একাধিক বার খাদের কিনারায় পৌঁছে গিয়েও মাইক্রোসফট, ডেল কিংবা আইবিএম-এর মতো প্রথম সারির সংস্থাকে পেছনে ফেলার ক্ষমতা দেখিয়েছে অ্যাপল। গত ৫ অক্টোবর অ্যাপল-এর প্রাণপুরুষ জোবস-এর মৃত্যুর সঙ্গেই সঙ্গেই সংস্থার শীর্ষস্থান ধরে রাখার বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন অনেকেই। অ্যাপল-এর আস্তিনে আপাতত লুকোনো রয়েছে আগামী দু’বছরে বাজারে আনার উপযুক্ত এক গুচ্ছ নতুন পণ্য, কিন্তু বাজারে প্রতিযোগীদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ‘অ্যান্ড্রয়েড’ প্রযুক্তি নিয়ে অ্যাপল-এর ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে গুগ্ল। বাজারে একের পর এক ‘টাচ স্ক্রিন’ কিংবা আই প্যাড-এক সমতুল প্রযুক্তিযন্ত্র এনে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে স্যামসাং। শীর্ষস্থান ফিরে পেতে ময়দানে নেমেছে মাইক্রোসফটও। সংস্থার নতুন কর্ণধার টিম কুক ও তাঁর সঙ্গীরা টিকিয়ে রাখতে পারবেন জোবস-এর সেই জাদু? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

সু চি
২০১১ শুরু হওয়ার ঠিক আগের লগ্নেই বোঝা গিয়েছিল, আসছে বছরটা মায়ানমার তথা বার্মা একটা বড় খবর হতে চলেছে। কুড়ি বছরের অন্তরিন দশার পর গত বছরের নভেম্বরে মুক্তি পেয়েছিলেন সে দেশের বিরোধী নেত্রী অং সান সু চি। সেই নভেম্বরেই ছিল মায়ানমারের দুই দশক পরের প্রথম জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচন মোটেই ‘গণতান্ত্রিক’ হয়ে উঠতে পারেনি, প্রভূত সমালোচিতও হয়েছে। তবু এই দুই নতুন পদক্ষেপে ভর দিয়ে যে মায়ানমারকে দেখা গেল ২০১১-র পথ চলচে, আগের থেকে তার চেহারা অনেকটাই আলাদা। জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট থেন শিয়েন-ই পুনরধিষ্ঠিত হন, তবে তাঁর এই সরকার এখনও পর্যন্ত আগের থেকে অনেক আত্মপ্রত্যয়ী, এবং খোলামেলা। সু চি-র দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এন এল ডি) ২০১১-র নভেম্বরে আবার নতুন করে রেজিস্ট্রেশন লাভ করল, যার অর্থ পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে তারা লড়তে পারবে। ১ ডিসেম্বরে ইয়াঙ্গন সফররত মার্কিন বিদেশমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে বৈঠকও করতে পারলেন সু চি। (ছবি) পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এই প্রথম মার্কিন সরকারি সফর সে দেশে। তা হলে কি মায়ানমারের উপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাও উঠতে চলেছে? দেখা যাক। মার্কিন পক্ষের মায়ানমার-নীতি পরিবর্তনের কারণটা স্পষ্ট: চিনের ভয়। কিন্তু মায়ানমার সরকারের এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির কারণটা এখনও সম্পূর্ণ পরিষ্কার নয়। কারণ যা-ই হোক, সু চি-র পুনঃসক্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যুক্ত হয়েছে, সন্দেহ নেই।

জর্জ পাপান্দ্রিউ
জর্জ পাপান্দ্রিউ কি ২০১১ সালের সুখীতম মানুষ? তিনি এই বছর গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর সোশালিস্ট পার্টির সরকারের পরিবর্তে দেশে সর্বদলীয় সরকার এসেছে, প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন লুকাস পাপাদেমাস। তা হলে পাপান্দ্রিউকে সুখীতম বলার কারণ কি? কারণ, গ্রিসের এখন যেমন পরিস্থিতি, সে দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব করা দুঃস্বপ্নের মতো। দেনার দায়ে দেশটা বেশ কয়েক বছর ধরেই ধুঁকছিল। ২০১০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার গ্রিসকে সহজ চুক্তিতে ঋণ দিতেও রাজি হয়। শর্ত ছিল, গ্রিসকে কঠোর আর্থিক নীতি অবলম্বন করতে হবে। কিন্তু, প্রথম দফা ঋণ পাওয়ার পরেও গ্রিস সেই শর্ত মানেনি। ফলে, এই বছর দু’টি সংস্থাই জানিয়ে দিয়েছিল, শর্ত না মানলে আর ঋণ নয়। বাধ্য হয়ে পাপান্দ্রিউকে পার্লামেন্টে কঠোর আর্থিক নীতির প্রস্তাব পেশ করতে হয়। পার্লামেন্টে প্রস্তাবটি পাশ হয় বটে, কিন্তু দেশের মানুষ এই নীতির প্রবল বিরোধী। চাকরি যাবে, মাইনে কমবে, কষ্টে দিন কাটাতে হবে এই সম্ভাবনাগুলি প্রকট হতেই মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নামে।
ইউরোপের অন্য দেশগুলিতেও অবস্থা সুবিধার নয়। ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিয়ো বের্লুস্কোনিরও চাকরি গেল। বছরের গোড়ায় স্পেন আর পর্তুগালে মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন দেশের আর্থিক দুরবস্থার প্রতিবাদে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘সিক্স প্যাক’ নামে একটি নতুন চুক্তি চালু করার চেষ্টা করছে। ইউরো অঞ্চলের দেশগুলি যাতে নিজেদের সামর্থ্যের বাইরে ঋণ না করতে পারে, যেন একটি নির্দিষ্ট আর্থিক নীতি মেনে চলে তা নিশ্চিত করতেই এই নতুন চুক্তির প্রস্তাব। তবে, তাল কেটে দিয়েছে ব্রিটেন। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এই চুক্তিতে সই করতে অস্বীকার করেছেন।

সার্ন
‘ঈশ্বর-কণা’র সন্ধানে
কথা রাখলেন সার্ন ল্যাবরেটরির (CERN) ডিরেক্টর জেনারেল রল্ফ হিউয়ার (Rol Heuer)। ‘দি ইকনমিস্ট’ পত্রিকার বর্ষশেষ সংখ্যায় এক প্রবন্ধ লিখে তিনি বলেছেন, ২০১২ সালে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আমাদের ধারণা আমূল বদলে যাবে। কেন? কারণ, সার্ন-এর লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার যন্ত্রে দু’দিক থেকে ছুটে আসা প্রোটন কণাদের সংঘর্ষে কী কী পাওয়া গেল, তা জানা যাবে। হিউয়ার-এর প্রবন্ধ পড়ে অনেকের মনে হয়েছিল, ২০১২ নয়, হয়তো এ বছরই জানা যাবে পরীক্ষার ফলাফল। এই ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখে সার্ন-এ আয়োজিত একটি সেমিনার উপলক্ষে ওই ধারণা আরও জোরদার হয়েছিল। মনে হয়েছিল, হয়তো ওই দিনই জানা যেতে পারে মস্ত এক ফলাফল। কৌতূহলী ছিলেন অনেকে। কিন্তু সে আশা পূর্ণ হল না। যা ঘোষিত হল তার ফলে প্রতীক্ষার সময় আরও কিছুটা বাড়ল। ২০১২ সালের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে বিজ্ঞানীদের। হিউয়ার-এর কথা সত্যি প্রমাণিত হল বলা যায়।
পরীক্ষা অনেক বিষয়ে, তাই ফলাফল-এর প্রতীক্ষাও অনেক। কিন্তু যে ফলের আশায় ছিলেন বিশেষজ্ঞরা, তার কথায় আসা যাক। একটি বিশেষ কণা বৈজ্ঞানিক নাম ‘হিগস-বোসন’ হলেও প্রচারমাধ্যমে যার পরিচয় ‘ঈশ্বর কণা’ তা প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষ থেকে মিলেছে কি না, সেটা জানতে চান বিজ্ঞানীরা। সংঘর্ষের ফলাফল খুঁজেছেন যে দু’দল বিশেষজ্ঞ, তাঁরা ১৩ তারিখে সার্ন-এর সেমিনারে জানালেন, কণাটিকে শনাক্ত করে ফেলা গিয়েছে, এমন দাবি করা যায় না।
তা সত্ত্বেও ওই দিনের সেমিনারে দু’দল বিজ্ঞানীর বক্তব্য থেকে বেরিয়ে এল একটা স্পষ্ট খবর। কী? খোঁজা হচ্ছিল যে কণা, তাকে চূড়ান্ত শনাক্ত করা না গেলেও, তা কী রকম ভরের হবে, তার ধারণা পাওয়া গিয়েছে। পরীক্ষা থেকে এক দল বিজ্ঞানীর হিসেব, ওই ভর এক বিশেষ এককে ১১৬ থেকে ১৩০-এর মধ্যে থাকবে। আর এক দলের হিসেব, ওটা থাকবে ১১৫ থেকে ১২৭-এর মধ্যে। অর্থাৎ, যা মাপ পেলেন দু’দল গবেষক, তা খুব কাছাকাছি। আর এর থেকে সিদ্ধান্ত একটাই। ‘ঈশ্বর কণা’ শনাক্ত না হলেও, তা নেই এ কথা বলা যাবে না। এ বার চলবে আরও পরীক্ষা, যাতে তা চূড়ান্ত ভাবে শনাক্ত হয়।
কেন ‘হিগস বোসন’ শনাক্ত করার জন্য এত উদ্গ্রীব বিজ্ঞানীরা? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে কণাটিরগুরুত্বে। এ ব্রহ্মাণ্ড কণাময়। এর সব কিছু কণা দিয়ে গড়া। কণা অনেক এবং সংখ্যায় অগুন্তি হলে কী হবে, তাদের প্রায় সবার একটা লক্ষণ আছে। তারা সবাই কিছু না কিছু ভারী। কণারা ভারযুক্ত না হলে ব্রহ্মাণ্ড এ রকম চেহারা নিয়ে গড়ে উঠত না। প্রাণ বলে কিছু থাকত না। কিন্তু কণারা ভারী কেন? তাদের ভর আছে বলে। ভর আসে কোথা থেকে? ‘হিগস-বোসন’ ব্রহ্মাণ্ডের কণাদের ভর জোগান দেয়। যে কণা এত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করে, তাকে শনাক্ত করার জন্য বিজ্ঞানীরা তো উদ্গ্রীব হবেনই।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালের ‘ফেস অব দ্য ইয়ার’ কে? উত্তর দেওয়ার জন্য তিলমাত্র ভাবতে হবে না। গোটা বছর এই রাজ্যের সংবাদের শিরোনামে লাগাতার এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান যাঁর, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নেতৃত্বে বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয়ে তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেস জোট সরকার ২০ মে পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন করে, অবসান হয় এই রাজ্যে ৩৪ বছরের নিরবচ্ছিন্ন বামফ্রন্ট শাসনের। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম মহিলা। প্রথম ছ’মাসে তাঁর সরকার কাজে গতি আনার কিছু চেষ্টা করেছে। দার্জিলিঙে রাজনৈতিক সমস্যার মোকাবিলায় উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি, বরং পুলিশি অভিযানে কিষেনজির মৃত্যুতে মাওবাদীরা বড় ধাক্কা খেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি, শিক্ষা ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তনের উদ্যোগ হয়েছে, যেমন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ব্যবস্থা রদ করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় শিক্ষকদের বাড়তি অধিকার দেওয়া, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা। কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল ফেরানোর কাজ বিশেষ এগোয়নি। শিল্প বা পরিকাঠামোর জন্য জমি কী ভাবে জোগাড় করা যাবে, সেই সমস্যারও সুরাহা হয়নি। এবং, সরকারি আয়ব্যয়ের বিপুল ঘাটতি ও বিপুল সরকারি ঋণের বোঝা নিয়ে উদ্বেগ প্রবল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কতটা সাফল্য পাবেন, তা এখনও বলার সময় আসেনি। কিন্তু আগামী বেশ কিছু কাল তিনিই শিরোনামে থাকবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

ডেভিড গ্রেবার
ডেভিড গ্রেবার বলতে ভালবাসেন যে ২০১১ সালে তাঁর তিনটে করণীয় কাজ: নিজের বইটা প্রচার করা, গাড়ি চালাতে শেখা আর দুনিয়া জোড়া একটা বিপ্লব শুরু করা। কে এই গ্রেবার? ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে বেশ কিছু মানুষ নিউ ইয়র্ক শহরের জুকোটি পার্কে একটি আন্দোলন শুরু করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল: আমরা এই দুনিয়ার ৯৯ শতাংশ অধিবাসী, ১ শতাংশ লোভী লোকেরা আমাদের শোষণ করছে, লোভী কর্পোরেট দুনিয়া সরকারের ওপর প্রভাব খাটাচ্ছে; এই শোষণ বন্ধ করতে হবে। এই আন্দোলনের নাম হয় ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’। কারণ ওয়াল স্ট্রিট হল আমেরিকার অর্থনৈতিক কেন্দ্র। কিছু দিনের মধ্যেই এই আন্দোলন কেবল আমেরিকানয়, গোটা দুনিয়া জুড়েই ঢেউ তৈরি করে।
এর কয়েকটা বিশেষত্ব হল:
এই আন্দোলনপুরোপুরি অহিংস,
এই আন্দোলনের এমন কোনও দাবি নেই যা এক্ষুণি আদায় করতে হবে এই আন্দোলন লোভের বিরুদ্ধে সর্বজনীন মানবিক আদর্শের কথা বলে।
এই আন্দোলনের কোনও নেতা নেই। ১৫ নভেম্বর পুলিশ জুকোটি পার্ক থেকে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিলেও আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়নি। মানুষ সংগঠিত হচ্ছেই। সংগঠনের দিক থেকেও এই ভাবে নেতাহীন, পার্টিহীন একটি আন্দোলনকে অনেকে মিলে সমবায়ের ভিত্তিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে নতুন অভিজ্ঞতা। তাই গ্রেবারের মতো এই আন্দোলনের সামনের দিকে থাকা মানুষেরা আমাদের সমাজে নতুন পথের দিশারি, নতুন আদর্শ নিয়ে চিন্তার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।

মাহমুদ আহমদিনেজাদ
১২ সেপ্টেম্বর, ২০১১। ইরান ঘোষণা করল, বুশের-এ সে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়েছে। পশ্চিম দুনিয়া তীব্র প্রতিবাদ জানাল। তাদের অভিযোগ: ইরান আসলে পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রস্তুতি চালাচ্ছে, বিদ্যুৎ চুল্লি তার উপায় এবং ছল। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আই এ ই এ) নভেম্বরে নতুন রিপোর্ট দাখিল করে জানাল, এই অভিযোগের পক্ষে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। ইরানের জবাব: এ সব মিথ্যা অপপ্রচার। কিন্তু পশ্চিম দুনিয়া ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য জোরদার প্রচার শুরু করল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইজরায়েল ইরান আক্রমণ করতে পারে বলেও জল্পনা শোনা গেল। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমদিনেজাদ সারা বছর ধরেই ইজরায়েল এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে কটুক্তি এবং হুমকি দিয়ে চলেছেন। দেশের মধ্যেও তাঁর বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ছে, বিশেষ করে তাঁর বেয়াই এবং প্রধান উপদেষ্টা রহিম মাশাইয়ের অস্বাভাবিক ক্ষমতাবৃদ্ধিতে অনেক সরকারি কর্তাব্যক্তিও ক্ষুব্ধ। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আল খামেনেইয়ের সঙ্গেও প্রেসিডেন্টের সম্পর্ক খুব ভাল নয়। সব মিলিয়ে, ইরানের পরিস্থিতি রীতিমত উদ্বেগজনক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.