একে বছরের শেষ রবিবার, সঙ্গে বড়দিন। সকাল থেকেই কলকাতা লাগোয়া চার জেলায় আনন্দ আর হই-হুল্লোড়ে মেতে উঠলেন সাধারণ মানুষ। গির্জায় গির্জায় চলল যিশুকে স্মরণ করে বিশেষ প্রার্থনা।
শীতের ঝলমলে রোদ, হিমেল হাওয়ায় ভোর থেকেই হাওড়া, হুগলি ও দুই ২৪ পরগনার রাজপথগুলিতে দেখা গিয়েছে পিকনিক করতে যাওয়া অসংখ্য গাড়ি। সেই সব গাড়ির কোনওটা গিয়ে থেমেছে ব্যান্ডেল চার্চে, কোনওটা ক্যানিংয়ে, কোনওটা বা হাওড়ার ফুলেশ্বর বাংলোয়।
গির্জায় গির্জায় শনিবার রাত ১২টা থেকেই শুরু হয়ে যায় উৎসব। বড়দিনে বন্ধ থাকে ব্যান্ডেল চার্চ। কিন্তু ছুটি উপভোগ করতে প্রতিবারই এখানে ভিড় জমান সাধারণ মানুষ। গির্জা সংলগ্ন মাঠে এবং পাশে গঙ্গাতীরে দর্শনার্থীরা মেতে ওঠেন চড়ুইভাতিতে। গঙ্গার পাড় ধরে বসেছিল রকমারি দোকানের মেলা। গঙ্গাবক্ষে নৌকাভ্রমণ ছিল বিশেষ আকর্ষণ। যাঁরা প্রথম বার এখানে এসেছেন, তাঁদের অবশ্য গির্জার ভিতরে ঢুকতে না-পারার আক্ষেপ নিয়ে ফিরতে হল। অস্ট্রেলিয়াবাসী উলফ্রেন্ড গোমস্ ভারতে বেড়াতে এসে শুনেছিলেন ব্যান্ডেল চার্চের ঐতিহ্যের কথা। এ দিন তা সচক্ষে দেখতে আসেন ওই যুবক। সব দেখে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “দারুণ লাগছে। দুর্দান্ত পরিবেশ এখানে।” বেড়াতে এসে অনেকে ঐতিহাসিক ইমামবাড়াও ঘুরে গেলেন। পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করতেও দেখা গেল তাঁদের।
এক সময়ের ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরও মেতে উঠেছিল বড়দিনের আনন্দে। এখানেও নানা অনুষ্ঠান হয়। শ্রীরামপুরের দুই শতকের প্রাচীন সেন্ট ওলাফ গির্জায় অবশ্য এ বার প্রার্থনা হল না। কেননা, গির্জাটির এখন ভগ্নদশা। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই গির্জাটি ‘নিরাপদ নয়’ বলে ঘোষণা করেছেন সেটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা শ্রীরামপুর কলেজ কর্তৃপক্ষ। এ দিন দুপুরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় শ্রীরামপুরের চেশায়ার হোমে। হোমের প্রধান সিস্টার লিন্ডা গোমেজ-সহ অন্যান্য সিস্টাররা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হোম সংলগ্ন গির্জায় জমজমাট অনুষ্ঠান হয় শনিবার রাতে। |
পোলবার রাজহাট থেকে শুরু করে চন্দননগরের ছুটি পার্ক, নিউ দিঘা, অ্যাকোয়ামেরিনা, চন্দননগরের কেএমডিএ পার্ক, ওয়ান্ডার ওয়ার্ল্ড হুগলির এই সমস্ত পিকনিক স্পটগুলিতে তিল ধারণের জায়গা ছিল না এ দিন। হুগলির বিভিন্ন প্রান্ত তো বটেই, অন্যান্য জেলা থেকেও প্রচুর লোকজন ওই সমস্ত জায়গায় আসেন শীতের মিঠে রোদ গায়ে মেখে। বিভিন্ন জায়গায় নদীর ধারেও চড়ুইভাতিতে মেতে ওঠেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ। ব্যাডমিন্টন থেকে ক্রিকেট, দোলনা থেকে বোটিং অথবা শুধুই নির্ভেজাল আড্ডা বড়দিনে সব কিছুই হাজির দেদার আনন্দের মোড়কে। ভিড় সামলাতে এবং অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে জেলা পুলিশের তরফে নজরদারি বাড়ানো হয়েছিল। সন্ধ্যা নামতেই শ্রীরামপুর, চন্দননগর, ব্যান্ডেল, চুঁচুড়া-সহ বিভিন্ন শহর আলোর মালায় সেজে ওঠে। রেস্তোরাঁগুলিতে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। তবে, এ বার আরামবাগ মহকুমার চাঁদুর, খানাকুলের রামমোহনের বাগান, গোঘাটের গড় মান্দারণের মতো পিকনিক স্পটগুলিতে ভিড় তুলনামূলক ভাবে কম ছিল।
প্রতি বছর হাওড়ার বাগনান থেকে ৫৮ গেটে সপরিবারে পিকনিক করতে আসেন স্বপন মুখোপাধ্যায়। এ দিনও তাঁকে দেখা গেল ওই পিকনিক স্পটে। স্বপনবাবুর কথায়, “গঙ্গার ধারে এই এলাকায় আমরা প্রতি বছর চড়ুইভাতি করি। আগে চড়ুইভাতির শেষে নৌকায় কিছু ক্ষণ ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু কোলাঘাটে দুর্ঘটনার পর দু’বছর এখানে নৌকাবিহার বন্ধ ছিল। এ বছর ফের তা চালু হওয়ায় আমরা খুশি।”
শুধু ৫৮ গেটেই নয়, হাওড়ার ফুলেশ্বরেও এ বার উপচে পড়েছে ভিড়। পিকনিকের আসর জমজমাট। হিন্দি গানের তালে তালে কোমর দুলিয়েছেন অনেকেই। আর বেলা বাড়তেই ভাত, মাছের মুড়ো দিয়ে ডাল, পাঁঠার মাংস, চাটনি, মিষ্টিতে কব্জি ডুবিয়েছেন তাঁরা। এই ভিড়ের জন্য দু’টি জায়গাতেই অস্থায়ী দোকান বসেছে। ফুলেশ্বর বাংলো লাগোয়া বাজার বেলা ১টাতেও খোলা ছিল বড়দিন উপলক্ষে। প্রতি বছরই সকাল থেকে ‘পিকনিক পার্টি’র গাড়িতে উলুবেড়িয়া শহরে যানজট হয়। এ বছর গরুহাটা, স্টেশন রোড-সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ থাকায় শহরে যানজট হয়নি। ৫৮ গেটে পুলিশ মোতায়েন থাকলেও ফুলেশ্বর বাংলোতে অবশ্য কোনও পুলিশি প্রহরা চোখে পড়েনি।
ভিড় ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামী ‘পিকনিক স্পট’গুলিতেও। ডায়মন্ড হারবারের পুরনো কেল্লার ধারে প্রবল ঠাণ্ডা হাওয়া উপেক্ষা করেও মানুষ মেতেছেন আনন্দে। একই ছবি দেখা গিয়েছে রায়চক, ফলতা বা কাকদ্বীপের বকখালি, গঙ্গাসাগরে। রায়য়দিঘির জটাদেউল মন্দির দেখতে প্রতি বছরই শীতের ছুটিতে ভিড় জমান সাধারণ মানুষ। বড়দিনে মন্দির সংলগ্ন এলাকায় বসে যায় পিকনিকের আসর। |
পর্যটকের ভিড়ে এ দিন জমজমাট ছিল সুন্দরবনও। শনিবার রাতে বাসন্তীর ক্যথলিক গির্জায় শ’য়ে শ’য়ে মানুষ আনন্দে মেতে ওঠেন। রাতের অন্ধকার চিরে ছড়িয়ে পড়ে আতসবাজির রোশনাই। গির্জায় জ্বালানো হয় মোমবাতি। রাস্তাঘাটও সাজিয়ে তোলা হয় রঙবাহারি আলোয়। একই ছবি গোসাবাতেও। সেখানকার ক্যথলিক গির্জায় প্রার্থনা হয়। এখানেও দেখা যায় আলোর বাহার। কোথাও কোথাও মেলা বসেছে। রবিবার সকাল থেকেই সজনেখালি, পাখিরালা, ঝড়খালিতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন পর্যটকেরা। বর্ধমান থেকে ঘুরতে আসা স্কুল শিক্ষক সৌরভ দাস বলেন, “ছুটিতে কয়েকটা দিন নদীর বুকে ঘুরে বেড়ানো, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা, সুন্দরবনকে ভাল করে দেখতেই আসা।’’ বেশির ভাগ পর্যটকই বাঘ দেখতে পাননি। তাতে অবস্য আফশোস নেই। নদীর ধারে হরিণ, শুয়োর আর রং-বেরংয়ের পাখি দেখে তাঁরা খুশি।
উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট পুরসভার উদ্যোগে মির্জাপুরে ইছামতীর পাশে শহিদ দীনেশ মজুমদার শিশু পার্ক ও ইছামতী পিকনিক গার্ডেনে কয়েকশো ঝাউ গাছের মাঝে খড়ের ছাউনির ঘরগুলিকে কেন্দ্র করে বসে যায় পিকনিকের আসর। কেউ কেউ পাশের জলাশয়ে নৌকায় ঘুরে বেড়ান। ইছামতীর ‘প্রতীর সৈকত’ও ছিল ভিড়ে ঠাসা। টাকি গেস্ট হাউসের পাশে নারকেল গাছে ঘেরা শচীন্দ্র বনবীথিও দেখা গিয়েছে একই ছবি। বড়দিন উপলক্ষে বনগাঁর ছয়ঘরিয়ায় যশোহর রোড সংলগ্ন সেন্ট যোশেপ গির্জা আলোয় সাজানো হয়। বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। হাজার হাজার মানুষ সন্ধ্যা থেকে ভিড় জমান। খ্রিস্টানপাড়ায় শনিবার গভীর রাত থেকে প্রতিটি বাড়ির বাইরে ঝুলছে বাহারি আলো। রঙিন কাগজে সাজানো হয় চারপাশ। চলে কেক, কমলালেবু বিতরণ। এছাড়াও, পাটশিমুলিয়া এবং গুমায় বড়দিন উপলক্ষে একই রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বহু মানুষ রবিবার বিভূতিভূষণ পার্ক ও পারমাদন অভয়ারণ্যের পাশে পিকনিক করতে আসেন। এ ছাড়াও, অশোকনগরের সংহতি পার্ক এবং মিলেনিয়াম পার্কে সকাল থেকেই দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষ ভিড় জমান। সকাল থেকেই ছুটির মেজাজে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলও। বিভিন্ন গির্জায় প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। সাজানো হয় ‘ক্রিসমাস ট্রি’। গঙ্গার ধারে পিকনিকও বসে যায়। সন্ধ্যায় শহরের রেস্তোরাঁগুলিতে কেক কাটা হয়। সান্তাক্লজ উপহার দেন ছোটদের।
|