উৎসবের এত বৈচিত্র্য খুব বেশি শহরে দেখা যায় না, যেমনটা দেখা যায় নবদ্বীপে। প্রাচীন ইতিহাসের শহর তথা বৈষ্ণবতীর্থ নবদ্বীপে সারা বছরই লেগে থাকে পর্যটকের ভিড়। দোল বা রাসের মতো বড় উৎসবে সারা পৃথিবী থেকে লাখো মানুষের সমাগম হয়। আবার নবদ্বীপে দেড়শোরও বেশি মঠ মন্দিরে রথযাত্রা, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, গাজনের মতো উৎসবে ভিড় জমান হাজারো মানুষ। সঙ্গে রয়েছে শহরের লক্ষাধিক বাসিন্দাদের নিজস্ব পারিবারিক নানা উৎসব। শীতের বইমেলা বা বিদ্যাসাগর মেলার মতো উৎসবও শহরের বার্ষিক উৎসবপঞ্জির অর্ন্তর্ভুক্ত। সোজা কথায় উসব নিয়েই বাঁচে নবদ্বীপ।
অসংখ্য মানুষ, আলো, শব্দ, কীর্তন, ভোজ, পরিক্রমা, প্রসাদ-এইসব অনুষঙ্গে গড়া নবদ্বীপের উৎসবময় জীবন কতটা নিরাপদ? আমরি কান্ডের পর তারই সুলুক-সন্ধানে নেমেছেন দমকলের কর্তারা। আর নিরাপদ যে নয়, সে কথা সাফ জানাচ্ছে খোদ দমকল দফতরই। আমরি কান্ডের পর থেকে দমকল দফতর হাসপাতাল, নার্সিংহোম, হোটেল, যাত্রী নিবাস, মঠ মন্দিরের অতিথি নিবাস কিংবা উৎসব বাড়ি যেখানেই গিয়েছেন, দেখেছেন আগুন নিয়ে কেউই ভাবেন নি সেভাবে। পরিদর্শনে গিয়ে দমকল কর্তারা উল্টে শুনেছেন, ‘‘আগুন লাগলে দমকল আসে, এটাই জানি। অন্য ব্যবস্থা আবার কী?’’ আবার কেউ অবাক হয়ে বলেছেন, ‘‘ আগুন নেভানোর যন্ত্র! সেটা আবার কী?’’ নবদ্বীপ দমকলের ওসি শক্তিপদ দে বলেন, ‘‘এই শহরে দু’ডজনেরও বেশি উৎসব বাড়ি, অসংখ্য মঠ, মন্দির, হোটেল সবই কার্যত ন্যুনতম অগ্নি সুরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়াই চলছে। আমরা সবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি।’’
নবদ্বীপের সবথেকে বেশি জনসমাগম যেসব মঠ মন্দিরে, তাদের অন্যতম রাধারমণবাগ সমাজ বাড়ি। মঠের পূর্ণদাস বাবাজি মহারাজ বলেন, ‘‘আমাদের আশ্রমে প্রথাগত অগ্নি সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই বটে কিন্তু এমন ভাবে পরিকাঠামো তৈরি, যা দমকলের অগ্নিনির্বাপণ বিধি বেশিরভাগটাই মেনে চলে। যেমন মন্দিরের প্রবেশ পথ দু’টি প্রতিটি ১৬ ফুট করে লম্বা ও চওড়া। দমকলের গাড়ি অনায়াসে ঢুকতে পারবে। রয়েছে পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা। উৎসবের মণ্ডপ বিরাট হলেও সেখানে কেউ রাত্রিবাস করেন না। চার দিকে খোলা জায়গা থাকায় আগুনের সম্ভাবনা অনেকটাই কম। তবুও আমরা আগামীদিনে অনুষ্ঠান, উৎসবের আগে দমকলের সাথে কথা বলেই যাবতীয় ব্যবস্থা নেব।’’
রানিরঘাটে রাধারানি আশ্রমের শ্যামল ভৌমিক বলেন, ‘‘সে ভাবে আগুন ঠেকানোর মতো কোনও ব্যবস্থা নেই। তবে মন্দিরের নিজস্ব দু’টি বিরাট জলাধার রয়েছে। মন্দিরের প্রবেশ পথও এত বড় যে, দমকলের গাড়ি অনায়াসে প্রবেশ করতে পারবে। সর্বোপরি মন্দির থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে গঙ্গা। আমাদের মন্দিরের রান্নার জায়গাটি মূল মন্দির থেকে বিচ্ছিন্ন। তবুও আমরা সম্প্রতি মন্দির জুড়ে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য একটি সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছি। শীঘ্র কাজ শুরু হবে।’’
দোলে কয়েক লক্ষ মানুষের সমাগমে তিল ধারণের জায়গা থাকে না শহরে। সেই সময়ে দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠে, শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠে হাজার হাজার মানুষ আসেন পরিক্রমা করতে। দেবানন্দ গৌড়িয় মঠের প্রধান আচার্য মহারাজ বলেন, ‘‘আমরি কান্ড বলে নয়, আমরা কয়েক বছর ধরেই ওই উৎসবের সময় দমকলের পরামর্শ মতেই সব আয়োজন করি। পুরো বিষয়টাই দমকলের সাথে কথা বলে আবার নতুন করে ভাবাও হচ্ছে।’’
আমরি কান্ডের পর মঠ মন্দির কমিটি নড়েচড়ে বসলেও বাকিদের অবশ্য কোনও হেলদোল নেই। নবদ্বীপ খেয়াঘাট সংলগ্ন গোটা দশেক হোটেলের মধ্যে মাত্র একটিতেই সরাই লাইসেন্সসহ কিছুটা অগ্নিসুরক্ষার বন্দোবস্ত রয়েছে। হোটেল মালিক অখিল কুন্ডু বলেন, ‘‘হোটেলের প্রতিটি তলায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রসহ অন্য বন্দোবস্ত রেখেছি।’’ আর এক হোটেল ব্যবসায়ী সুরেশ রায় বলেন, ‘‘আমরা কয়েকজন হোটেল মালিক মিলে অগ্নিসুরক্ষার ব্যাপারে যা যা করণীয়, তার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছি।’’ দমকলের ওসি শক্তিপদবাবু বলেন, ‘‘রাজ্যের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই শহর অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। সারাটা বছরই এখানে দেশ বিদেশের বহিরাগতদের আনাগোনা। অথচ সেভাবে সুসংগঠিত কোনও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা কোথাও নেই। আমরা নিয়ম করে পরিদর্শন করছি এবং গোটা শহরকে ঘিরে একটি রিপোর্ট তৈরি করছি তবে শহরের মানুষ সচেতন না হলে বিপদ এড়ানো যাবে না’’ |