ডাক্তারকে খবর দেওয়ার জন্য ‘কলবুক’ লেখা হলেও পাঠানোর লোক নেই। এ দিকে স্ত্রী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। কলবুক নিয়ে নিজেই দৌড়লেন তমলুকের তারক মাইতি!
মগরার সুমনা দত্তের ছেলের অপারেশন হবে। ডাক্তারেরা তৈরি। কিন্তু ট্রলি ঠেলে নিয়ে যাবে কে? পাড়ার ছেলেরা সঙ্গে ছিল। তারাই ট্রলি ঠেলে নিয়ে গেল ওটি-তে!
স্বামীকে কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন হাবড়ার রাধারানি দত্ত। রোজ সকালে ওয়ার্ডে এসেই দুর্গন্ধ সামলাতে তাঁকে নাকে রুমাল দিতে হয়। এক দিন কোমরে কাপড় গুঁজে নিজেই নেমে পড়লেন ওয়ার্ড সাফ করতে!
তিনটে ছবি খাস কলকাতা ও আশপাশের তিনটি সরকারি হাসপাতালের। কেন এমন অবস্থা?
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের ব্যাখ্যা: এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালগুলোয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ও সাফাইকর্মীর প্রায় তিন হাজার পদ ফাঁকা। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছিল পূর্বতন বাম সরকারের আমলে। গ্রুপ ডি পদে চাকরিপ্রার্থীদের পরীক্ষা নিয়ে সফল প্রার্থীদের তালিকা বেরোয় গত ১৫ জুন। ২৮১৭টি পদে নিয়োগের প্যানেল তৈরি হয়। তবে প্রক্রিয়া আর এগোয়নি। বরং নতুন সরকার জানিয়ে দিয়েছে, হাসপাতাল-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগের কথা এখনই ভাবা হচ্ছে না।
অতএব, সঙ্কটে পড়েছে পরিষেবা। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, লোক থাকলেও কি সব সময়ে ঠিকমতো পরিষেবা পাওয়া যায়?
স্বাস্থ্য-কর্তাদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, সরকারি হাসপাতালে অধিকাংশ চতুর্থ শ্রেণির কর্মী কাজ করেন না। কিছু বলতে গেলে আন্দোলনের হুমকিও দেওয়া হয়। এ হেন ‘কর্মসংস্কৃতি’ না-ফেরালে লোক নিয়েও পরিষেবার হাল ফেরানো যাবে না বলে স্বাস্থ্য-কর্তাদের দাবি। এক কর্তার কথায়, “বহু হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী হিসেবে যাঁদের নাম নথিভুক্ত, তাঁরা কাজে আসেন না। ওঁদের হয়ে অন্যেরা আসেন। ওঁরা শুধু মাসান্তে এসে বেতন নিয়ে যান। আবার বয়স ভাঁড়ানোয় অনেকের বয়স সত্তর ছাড়িয়েছে!” উপরন্তু স্বাস্থ্য-কর্তারা জানাচ্ছেন, এই ধরনের পদে
বেশ কিছু উচ্চ শিক্ষিতকেও নেওয়া হয়েছে। তাঁদের অনেককে দিয়ে করণিকের কাজ করানো হয়। ফলে সাফাই বা ট্রলি ঠেলার লোক মিলছে না। শুধু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজেই এমন প্রায় কুড়ি জন রয়েছেন বলে দফতর-সূত্রের খবর।
অন্য দিকে ইউনিয়নগুলো এই সব অভিযোগ পুরোপুরি উড়িয়ে না-দিলেও তাদের পাল্টা দাবি: বহু ক্ষেত্রে গ্রুপ সি কর্মীর অভাব থাকায় গ্রুপ ডি’দের দিয়েই তাদের কাজ করাতে হয়। এক নেতার প্রশ্ন, “একই লোক ট্রলি ঠেলবে, আবার কম্পিউটারও চালাবে? সেটা করানোর চেষ্টা হলেই প্রতিবাদ হয়।”
বস্তুত চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের দিয়ে যে তাঁদের দায়িত্বের বাইরেও বহু কাজ করানো হয়, তা মেনেছেন একাধিক হাসপাতালের কর্তা। যাঁদের মন্তব্য, “সবাই ফাঁকিবাজ হলে তো পরিষেবা অচল হয়ে যেত!” কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের এক ডাক্তারের কথায়, “ইমার্জেন্সি ওটি থেকে ওয়ার্ড, ড্রেসিং থেকে শুরু করে এক্স-রে করা কিংবা স্যালাইন-অক্সিজেন চালু করার কাজও বেশির ভাগ হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা করেন। অনেক সময়ে ডাক্তারেরাও বিভিন্ন যন্ত্র চালানোর জন্য তাঁদের উপরে বেশি নির্ভর করেন। বহু ক্ষেত্রে কার্যত টেকনিশিয়ানের কাজও করেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা।”
তাই চতুর্থ শ্রেণির পদ দিনের পর দিন শূন্য থাকলে আখেরে রোগীদেরই ভোগান্তি বাড়ে বলে আক্ষেপ করেছেন হাসপাতাল-কর্তাদের অনেকে। ভোগান্তি নিরসনের ব্যাপারে স্বাস্থ্য দফতরের কাছেও এই মুহূর্তে তেমন দিশা নেই। স্বাস্থ্য-সচিব সঞ্জয় মিত্র বলেন, “আগে দেখা হচ্ছে, কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে। কারণ, নিয়োগে বেশ কিছু গরমিল নজরে এসেছে। আমরা বার বার আউটসোর্সিংয়ের কথা বলছি। সেটাও ঠিকঠাক হচ্ছে না। সাফাইকর্মীর চাকরি পেয়েও অনেকে ঝাঁটা হাতে নিতেই রাজি নন! এ ভাবে তো চলতে পারে না!”
চলছেও না। কল বুক নিয়ে তাই ডাক্তারের কাছে দৌড়তে হচ্ছে তারক মাইতিদের। |