|
|
|
|
পথহারা বৃদ্ধাকে ঘরে ফিরিয়ে সংবর্ধিত ভ্যানচালক |
আনন্দ মণ্ডল • তমলুক |
তাঁকে যে কেউ মঞ্চে ডেকে সংবর্ধনা দিতে পারে, এত প্রশংসা-বাক্য ব্যয় হতে পারে তা তাঁর কাছে অভাবনীয়। আলো-ফুল-বক্তৃতা থেকে তাঁর অবস্থান বরাবরই বহু দূরে।
সব ‘অভাবনীয়’ই সত্যি হয়ে যাওয়ায় বিস্ময়ের ঘোর আর কাটছিল না। বিস্ময় ছাপিয়েও যেন বিড়ম্বনা। শনিবার দুপুরে পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক জেলাসদর থেকে খানিক দূরের বল্লুকহাটের সংবর্ধনা-মঞ্চে জড়োসড়ো হয়েই রইলেন বছর ছাব্বিশের হেমন্ত সাউ। স্থানীয় খারুই গ্রামের বাসিন্দা এই ভ্যানরিকশা চালককে তাঁর দায়িত্ববোধের জন্য আশপাশের এলাকার মানুষ কার্যত ডেকে এনেই সংবর্ধনা দিলেন এ দিন।
স্থানীয় বধূ অণিমা বেরা শোনালেন হেমন্তের সেই দায়িত্ববোধের কথা। সেটা গত ৯ ডিসেম্বরের কথা। ভাড়া খাটতে সকাল-সকালই বুড়ারি বাজারের স্ট্যান্ডে ভ্যান নিয়ে পৌঁছেছিলেন হেমন্ত। এক সত্তরোর্ধ্ব মহিলা এগিয়ে এসে চিয়াড়া গ্রামে যেতে চান। বেশভূষায় সম্ভ্রান্ত। গা ভর্তি গয়না। কাছেই চিয়াড়া, হেমন্ত বেরিয়ে পড়েন সওয়ারি নিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারেন, অসংলগ্ন কথা বলছেন বৃদ্ধা। চিয়াড়া গ্রামে আত্মীয়বাড়ি রয়েছে বললেও আত্মীয়ের নাম বলতে পারছেন না। বিস্তর ঘোরাঘুরিই সার। বৃদ্ধা এর পর নিয়ে যেতে বলেন বল্লুক গ্রামে। |
|
নিজস্ব চিত্র। |
সেখানে দুপুর পর্যন্ত ঘুরেও আর ঠিকানা মেলেনি। হেমন্ত আধবেলা বৃথা-শ্রমে এক মুহূর্তের জন্য বিরক্ত তো হনইনি, উল্টে মায়ের মতোই যত্নআত্তি করেছেন বৃদ্ধার। শেষমেশ বল্লুক গ্রামের লোকজনের কাছে সসংকোচে জানিয়েছেন, বৃদ্ধা হয়তো পথ ভুল করেছেন, সবাই মিলে তাঁকে বাড়িতে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করা যায় কি না। হেমন্ত ও গ্রামের লোকজন মিলে অনেক সাধ্যসাধনার পরে জানতে পারেন বৃদ্ধার বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের দুধকুমড়া গ্রামে। নাম মুক্তাবালা গুড়িয়া। সেটুকু সূত্র ধরেই দাসপুরের চেনা-পরিচিতদের ফোন করে গ্রামবাসীরাই মুক্তাদেবীর বাড়িতে খবর দেন। বিকেলে বাড়ির লোকজন এসে নিয়ে যান তাঁকে।
মুক্তাদেবীর বাড়ির লোকজনের কাছেই বল্লুকবাসী জেনে ছিলেন, বৃদ্ধা মানসিক ভারসাম্যহীন। মাঝেমধ্যেই তিনি সবার অজান্তে এ-দিক সে-দিক চলে যান। এ নিয়ে পরিবারের লোকজনের উৎকণ্ঠাও প্রভূত। সে দিন সকালেও বৃদ্ধা অন্যদের অজান্তে বেরিয়ে পড়েছিলেন। শারীরিক ও মানসিক ভাবে অশক্ত মুক্তাদেবীকে নিয়ে দিনভরই উদ্বেগে ছিলেন বাড়ির লোক। তার উপরে গা ভর্তি গয়না থাকায় নিরাপত্তা নিয়ে অন্য উৎকণ্ঠাও তৈরি হয়েছিল।
মা-কে সুস্থ শরীরে ফিরে পাওয়ার জন্য হেমন্তকেই কুর্নিশ করছেন মুক্তাদেবীর ছেলে কর্ণদেব। তিনিও শনিবার এসেছিলেন বল্লুকে। এ গ্রামের বাসিন্দারা শীতবস্ত্র আর ফুল দিয়ে সংবর্ধনা জানান হেমন্তকে। কর্ণদেব তাঁর হাতে গুঁজে দেন কিছু টাকা। হেমন্তের কাছে তাঁদের পরিবারের ঋণ যে অপরিশোধ্য, বারে বারেই বলেছেন সে কথাও। অণিমাদেবীও বলেন, “হেমন্ত আমাদের গ্রাম, এ তল্লাটের গর্ব।” বিস্মিত, বিড়ম্বিত হেমন্তর নিজের মন্তব্য, “ওই ঘটনার জন্য আমাকে নিয়ে এত কিছু হতে পারেভাবতেই পারছি না। দিন আনি, দিন খাই। সে দিন বৃদ্ধাকে নিয়ে দিনভর ঘুরেছি। আর ভাড়া খাটতে পারিনি। কী-ই বা করতাম বলুন। রাস্তায় ছেড়ে যেতে তো পারি না। আমাদেরও মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান, সংসার আছে। মানুষ তো, মানুষের কাজে লাগব না!” |
|
|
|
|
|