দেড় বছর পরে
কামরায় গাড়িভরা ঘুম, পার রাতের জঙ্গলমহল
কামরাগুলো বড্ড ফাঁকা। গুটিকয় যাত্রী কম্বল মুড়ে ঘুমোচ্ছিলেন। কনকনে ঠান্ডা। মাঝে মাঝে হিমেল হাওয়ার ঝাপটা। রাত বাড়ছে। নাকও ডাকছেন কেউ কেউ। উদ্বেগহীন। চক্রধরপুর-হাওড়া প্যাসেঞ্জার ছুটছে হাওড়ার দিকে। বছর দেড়েক পরে। মোট আসনের মাত্র ২০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে।
জ্ঞানেশ্বরী-কাণ্ডের পর থেকে রাতের এই ট্রেন বন্ধ ছিল। নিরাপত্তার অভাবে। বৃহস্পতিবার রাতে ট্রেনটি যায় হাওড়া থেকে চক্রধরপুর। শুক্রবার রাতে আবার চক্রধরপুর থেকে হাওড়া। কিন্তু যাত্রী এত কম কেন? এই ট্রেন তো ফাঁকা যায় না। সেই স্বাধীনতার আগে থেকে চলছে। এত ফাঁকা তো থাকে না। হয়তো প্রচারের অভাবে, হয়তো নাশকতার ভয়ে। আদ্রার ডিআরএম অমিতকুমার হালদারের আশা, “দ্রুত ট্রেনটি আবার ভরে উঠবে।” নাশকতার ভয় নেই? মুখের চাদর সরিয়ে এক যাত্রী বললেন, “কী করব! ঘরে বসে থাকলে তো পেট চলবে না। কলকাতায় যেতেই হবে।”
অযোধ্যা পাহাড় লাগোয়া বরাভূম, উরমা, বিরামডি, কাঁটাডি স্টেশন এই ট্রেনের চলার পথেই। অযোধ্যা পাহাড় মানেই গা ছমছম। মাওবাদীদের ঘাঁটি যে!
সন্ধে সাড়ে ৭টা। সুনসান বরাভূম স্টেশন। তিন-চার জন অদূরে কাঠকুঠো জ্বালিয়ে আগুনের তাপ নিচ্ছেন। কোথাও হাঁকডাক নেই। ৭টা ২০ নাগাদ ঘোষণা হল, চক্রধরপুর-হাওড়া প্যাসেঞ্জার ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে। কোনও যাত্রীর কি মনে পড়ল, ২০০৯ সালের কথা? ফেব্রুয়ারি মাসের এক দুপুরে দিনেদুপুরে দাঁড়িয়ে ছিল টাটানগর-ধানবাদ সুবর্ণরেখা এক্সপ্রেস। হঠাৎ হামলা। রেল রক্ষী বাহিনীর ৩ জওয়ানকে মেরে তিনটি অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় মাওবাদীরা। তার পর হেঁটে চলে যায় অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে।
গার্ড ও চালককে ফুলের মালা। শুক্রবার রাতে বরাভূম স্টেশনে। ছবি: সুজিত মাহাতো।
ঘোষণার পর কয়েক জন যাত্রী জড়ো হলেন প্ল্যাটফর্মে। ওভারব্রিজ পেরিয়ে প্ল্যাটফর্মে এলেন স্টেশন ম্যানেজার পশুপতি দাসও। বললেন, “সেই ২০১০ সালের ২৮ মে জ্ঞানেশ্বরী কাণ্ডের পরে এই সময়ে এই ঘোষণা শুনলেন যাত্রীরা। এই ট্রেন এখানকার লাইফলাইন।” ট্রেন ঢুকতেই স্থানীয় কিছু মানুষ চালক ও গার্ডকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। মিষ্টিমুখও হল।
ট্রেনের সামনে কোনও পাইলট ইঞ্জিন নেই। ১১ জন সশস্ত্র রক্ষী কামরায় টহল দিচ্ছেন। এত দিন পরে ট্রেন চলছে। কোনও বাড়তি নিরাপত্তা নেই। আদ্রা ডিভিসনের ডিআরএম অমিতকুমার হালদার বলেন, “এখন একটু আস্তেই রাতের ট্রেন চালানো হচ্ছে। ঘণ্টায় ৭৫ কিলোমিটার। তেমন হলে যাত্রিবাহী ট্রেনের সামনে পাইলট রাখা হবে।”
আদ্রার পথে একে একে পেরিয়ে গেল উরমা, বিরামডি, কাঁটাডির মতো একাধিক মাওবাদী নাশকতার সাক্ষী স্টেশন। বিরামডি স্টেশন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। উরমার স্টেশন ম্যানেজারকে অপহরণ করা হয়। বিস্ফোরণে রেল লাইন উড়িয়েও দেওয়া হয়েছে। উরমা স্টেশনে দু’-চার জন যাত্রী উঠলেন। এস ফোরের যাত্রী মানস দরিপা, আশিস দত্ত বলেন, “ব্যবসার কাজে প্রায়ই কলকাতায় যেতে হয়। এই ট্রেন বন্ধ হওয়ায় খুব সমস্যায় পড়েছিলাম।”
ট্রেন ছুটছে। যাত্রীদের আলোচনা কানে আসছিল। এক জন বলছিলেন, “আবার নাশকতা হলে কী করা যাবে? কাজ ফেলে বসে থাকলে পেট তো ভরবে না।” নাশকতার ভাবনা নয়। যাত্রীদের কাছে বড় ভাবনা ছিল, রাতের যাত্রার সুবিধা ফেরত পাওয়া। সেটা তাঁরা পেয়েছেন। ‘রিস্ক জোন’ গড়বেতা, চন্দ্রকোনা রোড, শালবনি পার হল রাত ১টা থেকে ২টার মধ্যে। যাত্রীরা তখন প্রচণ্ড শীতে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমে মগ্ন। কথা হচ্ছিল দুই টিকিট পরীক্ষক বেদান্ত চৌবে ও ভোলানাথ চৌধুরির সঙ্গে। তাঁরা বললেন, “ভয় পেয়ে লাভ নেই। পেশার তাগিদে তো যেতেই হবে। তবে ভাল প্রচার হলে আরও যাত্রী হত। এত ফাঁকায় যেতে হত না।” দুই আরপিএফ কর্মী জানালেন, খুব দরকার না-হলে জঙ্গলমহলের স্টেশনে তাঁদের নামতে বারণ করা হয়েছে।
রাজ্য পুলিশের আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) গঙ্গেশ্বর সিংহ বলেন, “রাতের ট্রেনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমাদের মাথায় রয়েছে।” আর রেল পুলিশ সুপার (খড়গপুর) শঙ্কর চক্রবর্তী বলেছেন, “রাতের ট্রেনের নিরাপত্তা বিশেষ গুরুত্ব গিয়ে দেখা হচ্ছে।”
মেদিনীপুর থেকে ফিরতি চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেনেও একই অভিজ্ঞতা। সেই ফাঁকা কামরা। পরপর স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে একটি প্রায় যাত্রীশূন্য ট্রেন। কিন্তু চলছে তো! রাতের জঙ্গলের গন্ধ আবার গায়ে মাখছে চক্রধরপুর-হাওড়া প্যাসেঞ্জার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.