বিজয় উৎসবের চল্লিশ বছরে ঢাকার পথঘাট-বিশ্ববিদ্যালয় দেখিয়ে
দিল এখানে বঙ্গবিদ্যা ও সংস্কৃতি আপাতত অপরাজেয়।
বিশ্বজিৎ রায় |
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি বসেছিল দ্বিতীয় বঙ্গবিদ্যা সম্মেলন। নানা জায়গার, নানা কিসিমের বাঙালিরা এসেছিলেন বিদ্যাচর্চার এই উঠোনে। যাঁরা জন্মসূত্রে বাঙালি নন, কিন্তু বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাও হাজির। সব বাঙালির জন্য উদার আহ্বান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে আর পার্শ্ববর্তী এম বি এ ভবনের নানা ঘরে একসঙ্গে চলেছে আলাপ-আলোচনা। ইচ্ছে মতো শুনুন এবং দরকার মতো কেটে পড়ুন। কারণটা সোজা। বঙ্গবিদ্যার চর্চা কি কেবল সেমিনারে হয়? ঢাকার রাস্তাঘাটে হয় না! হয় হয়। সেটা জানতেই তো বঙ্গবিদ্যা সম্মেলনে যোগদানকারীরা কখনও সেমিনারে, কখনও শীতের রাস্তায়। ঢাকাই ডিসেম্বর শরীরে, মনে আর জিভে না মাখলে এক রকম বাঙালি সংস্কৃতির টাটকা স্বাদ-গন্ধ মিস করবেন। মিস করাটা বেমালুম আহাম্মকপনা। সুতরাং শীতের বিকেলে পলাশির মোড়ে।
এই ক’দিন সঙ্গে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই আর ডিপার্টমেন্টের দুই ছাত্রবন্ধু জাকির আর শিস, শিস হাসান। তাঁরাই ঢাকার পথ ও মত চেনালেন। পলাশির মোড় হল সেই জায়গা, যেখানে হাজারও খাবার রাস্তায় জন্নত সাজিয়ে বসে আছে। সেই কবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধে পলাশির প্রান্তরে সিরাজ পরাভূত হয়েছিলেন। সেই স্মৃতিতেই এ জায়গার নাম এমন বটে, তবে পরাভবের চিহ্নমাত্র নেই। এই মোড় হল ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের আড্ডাখানা, খাবারমহল। রাত তিনটেতে খিদে পেলেও তাঁরা চলে আসেন এখানে। আসলে ঢাকা বুড়ো নয়, যুবক। সে রাত জাগতে জানে। আমাদের জিভে শীত-বিকেলে নেমে পড়ল গোস্তকাবাব, আর হালিম। হালিম নরম ও গরম। এই ঘন তরলে ডাল আছে, শস্যকণা আছে, আছে মাংস। খেতে খেতে জাকির জানাল, গত তিন-চার বছর ধরে ঢাকায় জমিয়ে শীত পড়ছে। এই শহরে এখন দুটো কর্পোরেশন। উত্তর একের আওতায়, দক্ষিণ আর একের। |
শীতের মোকাবিলা করতে ঢাকা নিউ মার্কেটে বসেছে শীত বস্ত্রের পশরা। দেখলেই কিনতে ইচ্ছে হবে। সুতরাং চল রিকশা নিউ মার্কেট। ঢাকা শহরে রিকশাই ভরসা। সে যে কী বেগে জ্যাম-জমাট রাস্তা অতিক্রম করতে পারে, তা না চাপলে মালুম হয় না। আর সঙ্গে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকেন, তা হলে আপনার রিকশাকে ঠেকায় কে! ঢাকার ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পথে বেজায় খাতির। ছাত্র সঙ্গে থাকলে আপনার রিকশা যে কোনও জায়গায় এঁকেবেঁকে ঢুকে যেতে পারে। আসলে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে আর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অবদান সকলেই মনে রেখেছেন। তাই রিকশায় লহমায় ঢাকা নিউ মার্কেট। কোনও কোনও অংশ পুরনো দিল্লির বাজারের সঙ্গে মিলবে, কোনও অংশ চরিত্রে গড়িয়াহাট। এই নিউ মার্কেটে যাঁদের কেনাকাটা করতে দেখা যাবে তাঁদেরকে নতুন ঢাকার শপিং মল বসুন্ধরায়, যা নাকি জাকিরের তথ্য অনুযায়ী এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম, সেখানে পাওয়া যাবে না। তবে, নিউ মার্কেটে যাঁরা কিনতে আসছেন, তাঁরা সবাই গরিব নন। বাইরে থেকে যা দেখা যায়, তা সব সময় সত্যি নয়। রাতের পুরনো ঢাকায় বাবুর্চিদার দোকানে মোরগ-পোলাও খাওয়ার আগে শিস সে কথা মনে করিয়ে দিল। পুরানা ঢাকার লোকজন লুঙ্গি পরে বাবুর্চিদার দোকানের বেঞ্চে পা তুলে বসে মোরগের ঠ্যাং বাগাচ্ছে। এরা নতুন ঢাকার মতো বারফাট্টাই দেখায় না। টাকা থাকলেই দেখাতে হবে নাকি! নতুন ঢাকার সব জমিজিরেত তো পুরানা ঢাকার লোকদের। তাই বলে শপিং মলে গিয়ে একশো ষাট টাকার কফি খেতে হবে! এমন বুরবকপনা পুরানা ঢাকা করে না।
এক দিন সকালে সোজা জাহাঙ্গির নগর ইউনিভার্সিটি। সেখানে বন্ধু মানস অ্যানথ্রপলজির অন্য রকম শিক্ষক। কিছু দিন হল বন্যাকে বিয়ে করেছেন। বন্যাকে মুচলেকা দিতে হয়েছে তিনি ইসলাম ধর্মাবলম্বী নন, আর মানস মুচলেকা দিয়েছেন তিনি হিন্দু নন। তবে তাঁরা বিয়ে করতে পেরেছেন। জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে নাম ছিল জাহাঙ্গির নগর মুসলিম ইউনিভার্সিটি। একাত্তরের স্বাধীনতার পর ‘মুসলিম’ শব্দটি উঠে যায়। ক্যাম্পাসে ঢুকলেই মন আর চোখ ভরে ওঠে। সুন্দর রাস্তা আর একটু এগোলেই রাস্তার দু’ধারে পর পর অনেক ক’টা জলাশয়। বেঞ্চি পাতা। সেখানে ছেলেমেয়েরা বসে বসে শীত মাখছে, আড্ডা দিচ্ছে, এক সঙ্গে। এখানে প্রেমে, বন্ধুত্বে পর্দা নেই। (ছবিতে তার আভাস।) জাহাঙ্গির নগর অনেক উদার। সে কথা ঢাকার দুই ছাত্রবন্ধু জানেন। তবে এই উদারতা নিয়ে তাঁদের একটু কিন্তু কিন্তু আছে। বন্যা জনপ্রিয় অভিনেত্রী। একদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম-রাজনীতি করা ছাত্রী। তিনি উদারতার পক্ষে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সঙ্গে ছিলেন বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের দুই গবেষক সংঘমিত্রা আর অমৃতা। জাহাঙ্গির নগরের নাট্যবিভাগের সামনে চায়ের তুমুল ঠেক দেখে তাঁদের বিশ্বভারতীর কলাভবনের সামনের জমায়েতের কথা মনে পড়ছিল। আর মনে হল, জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয় ভাব-ভঙ্গিতে বাংলাদেশের যাদবপুর। ভেতরে খোয়াবনামার রিহার্সাল চলছিল। দেখা গেল পর্দা উঠছে, জাহাঙ্গির নগর মন খুলছে, ছেলেমেয়েরা সমানে সমানে তাল মেলাচ্ছে। এ খোয়াব নয়।
|
ঢাকায় কিনতে গিয়ে দেখবেন, পণ্যে-প্রযুক্তিতে ভরপুর বাঙালিয়ানা। সেই বাঙালিয়ানায় মজে শান্তিনিকেতনের সংঘমিত্রা গেঞ্জিবাজ হয়ে উঠলেন। তাঁর চাই নানা কিসিমের বাংলায় গদ্য-পদ্য লেখা গেঞ্জি। গানবাজ দিলখোলা বন্ধুদের তিনি বুকে বাংলা লেখা আর ছবি আঁকা নরম বাংলাদেশী গেঞ্জি দিতে চান। দোকানদার অবশ্য বললেন, ইদানীং বাংলা লেখা গেঞ্জির চাহিদা কমছে। হতে পারে। তবে অপ্রতুল নয় বাংলা। বিশেষ করে গেঞ্জির বুকে তো শুধু রোম্যান্টিক কবিতা আর ছবি নেই, ছবিতে ইতিহাসও আছে। বাংলার হুক্কার ছবি, বিজয় উৎসবের চল্লিশ বছরের গেঞ্জি ইতিহাসকে ছবিতে লেখায় তুলে ধরছে। ইতিহাসকে গণ পরিসরে ব্যবহার করার এমন উদ্যোগ বিলেতে চোখে পড়ে, এ বঙ্গে চোখে পড়ে না। জামা কিনলে তা কেমন করে কাচতে হবে স্পষ্ট বাংলায় সে নির্দেশ লেখা আছে জামা কাপড়ে। দোকানের দরজায় মোটেই পুশ-পুল লেখা নেই, আছে ধাক্কা দিন আর টানুন। প্রত্যেক দিনের কাজে-কর্মে-নির্দেশে-প্রতিনির্দেশে ব্যবহারের জন্য কাজের বাংলা এক রকম করে গড়ে উঠেছে। শিকড়ের টানটাও উৎপাদন আর বিকিকিনিতে হারিয়ে যায়নি।
|
লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক |