হাতির দামালপনা রুখে মায়া-রাজ্যে ফের কমল ফোটাতে পুরনো জাদুতেও ভরসা রাখছে বিজেপি। জাদুটা অটলবিহারী বাজপেয়ীর। তাঁর উদার ও সর্বজনগ্রাহ্য ভাবমূর্তির। শারীরিক ভাবে অশক্ত হলেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ও দর্শনকেই উত্তরপ্রদেশে ভোটের প্রচারে সামনে রাখতে চায় বিজেপি। শুধু তাই নয়, জাতীয় স্তরেও অন্যান্য দলের কাছে বিজেপি-কে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলে এনডিএ-র পরিসর বাড়ানোর ক্ষেত্রেও ফের অটল-জাদুতে ভরসা রাখছে বিজেপি।
আগামিকাল জন্মদিন বাজপেয়ীর। অশক্ত হয়ে পড়ার পর থেকে জন্মদিনে তাঁর দর্শন পায় না আমজনতা। লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো হাতে গোনা এক-আধজনই নিয়ম করে দেখা করে এসেছেন এই ক’বছর। কিন্তু ব্যতিক্রম এ বারে। লালকৃষ্ণ আডবাণী থেকে বিজেপি-র ছোট-বড় নেতারাও যাবেন জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। দলের নেতারা স্থির করেছেন, বাজপেয়ীর জন্মদিনকে রাজ্যে-রাজ্যে ‘সুশাসন দিবস’ হিসাবে পালন করা হবে। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান ইতিমধ্যেই বিজ্ঞাপন দিয়েছেন সংবাদপত্রে। বাজপেয়ীর প্রায় ছ’দশকের রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন বক্তৃতার সংকলন প্রকাশ করা হয়েছে সদ্য। অসুস্থতার কারণে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে তিনি সশরীরে থাকতে না পারলেও তাঁর আদর্শ ও বক্তৃতাই প্রচার করা হবে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। লক্ষ্য, ভোটারদের মধ্যে বাজপেয়ীর মতো উদার ও সর্বজনগ্রাহ্য নেতার ভাবমূর্তির স্মৃতিকে ফের সজাগ করে তোলা। ভোপালের বিজেপি নেতা তথা বাজপেয়ীর ভাগ্নে অনুপ মিশ্রের কথায়, “এক সময় তাঁর মুখে সরস্বতী ভর করে থাকত। আর আজ তিনি কথা বলতে পারেন না। নিয়তির এমনই পরিহাস।”
বিজেপি নেতারা প্রায় একবাক্যেই স্বীকার করেন, বাজপেয়ীর মতো বড় মাপের নেতার বড় অভাব দলে। রাজনীতিতে তিনি আজ সক্রিয় থাকলে দলের চেহারাটাই ভিন্ন হত। তবু আজও তিনি দলের ‘সর্বোচ্চ’ নেতা। বাবরি-পর্বের আগে-পরে, দল যখন কট্টর হিন্দুত্বে সওয়ার, তখনও তাঁর উদার ভাবমূর্তি থেকে লাভবান হয়েছে বিজেপি। কট্টর হিন্দুত্ব নাপসন্দ যাঁদের, তাঁদের কাছেও কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে বিজেপি-কে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা ছিল তাঁর। পরবর্তী প্রজন্মের নিতিন গডকড়ীরা শুধু নন, সমসাময়িক আডবাণীও বুঝতে পারছেন, কট্টর হিন্দুত্বে বাজি রেখে এখন আর বিশেষ লাভ হবে না ভোট-ময়দানে। জোর দিতে হবে উন্নয়নে, সমাজের বিভিন্ন স্তরের কাছে দল ও নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর দিকে। আর সেই কাজে বাজপেয়ীর চেয়ে ভাল ‘আইকন’ আর কে হতে পারেন বিজেপি-তে! আডবাণীর কথায় মিলল তার স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, “এর আগে যতগুলি যাত্রা করেছি, বাজপেয়ীজি সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু এ বারের যাত্রায় তাঁকে সক্রিয় ভাবে পাশে না পাওয়ার অভাবটা সব থেকে বেশি অনুভব করেছি। তবু যাত্রা শুরুর এক দিন আগে আমি তাঁর বাড়িতে গিয়ে সবিস্তার জানিয়ে তাঁর আশীর্বাদ নিয়েই যাত্রায় বেরিয়েছিলাম।” বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন বিজয় গোয়েল। তিনি বললেন, “অটল-জাদু এখনও মুগ্ধ করে রাখে সকলকে। তাঁর পরোক্ষ উপস্থিতিই দলের কর্মীদের কাছে শক্তি সঞ্চার করে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় এখনও বাজপেয়ীর ছাপ অমলিন। রথযাত্রায় আডবাণীজির বক্তৃতা শুনেও দেহাতের অনেকে বলেছেন, অটলজিকে দেখতে এসেছি। তাঁর কথা শুনে ভাল লাগল। এমনই ব্যক্তিত্ব তাঁর।”
এ হেন বাজপেয়ীকে ভোট ময়দানে ‘নামানোর’ পিছনে অন্য কৌশলও রয়েছে বিজেপি-র। প্রায় চার দশকর সংসদে কাটিয়েছেন বাজপেয়ী। তার মধ্যে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সক্রিয় রাজনীতিতে থাকা পর্যন্ত লখনউয়েরই সাংসদ ছিলেন তিনি। জাত-ধর্মের উপরে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও ব্রাহ্মণদের প্রতীকও ছিলেন তিনি। উত্তরপ্রদেশে এ বারে ব্রাহ্মণ ভোট নিজের দিকে টানতে চাইছে বিজেপি। উচ্চবর্ণের ভোট কাড়তেই কলরাজ মিশ্রের মতো মুখকে লখনউয়ে প্রার্থী করা হয়েছে। দলের নেতারা আশা করছেন, এর পাশাপাশি বাজপেয়ীকে ‘ভোট প্রচারে নামিয়ে দিলে’ উচ্চবর্ণকেও পাশে পাওয়া যাবে।
তবে শুধু উত্তরপ্রদেশ নয়, লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির তখ্ত দখলের স্বপ্নে গোটা দেশেই বাজপেয়ীকে ফের প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চাইছেন বিজেপি নেতৃত্ব। তাঁরা মনে করছেন, এক সময় বাজপেয়ীর নামেই প্রায় কুড়িটির বেশি দল এনডিএ-র ছাতার তলায় এসেছিল। বাজপেয়ীর মতো ব্যক্তিত্বই পারেন, সকলকে এক সঙ্গে নিয়ে চলতে। কুশলী প্রশাসক হিসাবে বাজপেয়ীকে এখনও সকলে মনে রাখে। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “শুধু সমর্থক দল নয়, বিরোধী দলের মধ্যেও বাজপেয়ী জনপ্রিয়। তাঁকে সামনে রেখে এনডিএ-তে যদি আরও দল আসতে সম্মত হয়, বিজেপি-র সেই সুদিন ফিরে আসে, তা হলে ক্ষতি কী?
দল তো দলের কাজ করে যাবে। কিন্তু বাজেপয়ীর ‘উপস্থিতি’ সব সময়ই অনুঘটকের কাজ করে। ফলে আজও দল তাঁরই দ্বারস্থ।” |