হাজার হাজার এসএমএস আর ই-মেল ইনবক্স ভরিয়ে দিচ্ছে। এত ফ্যাক্স আসছে যে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। কংগ্রেসের সদর দফতর থেকে শুরু করে প্রতিটি সাংসদের বাড়িতে থেকে থেকেই টেলিফোন বেজে উঠছে। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, এমনকী সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধীর বাড়িতেও একই অবস্থা। আঞ্চলিক দল, কিংবা নির্দল সাংসদরাও রেহাই পাচ্ছেন না। গত এপ্রিল মাসে এক বার এমন দুঃসহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সংসদে লোকপাল বিল পেশ হওয়ার পর থেকে ফের একই কাণ্ড। সব এসএমএস, ই-মেল বা ফ্যাক্সের দাবি একটাই ‘দুর্নীতি দমনে সব থেকে বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন লোকপাল গঠন করতে হবে। সিবিআইকে লোকপালের আওতায় রাখতে হবে। তা না হলে লক্ষ লক্ষ দেশবাসীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।’
সাংসদদের কপালে তাই ফের চিন্তার ভাঁজ। অণ্ণা ও তাঁর সঙ্গীরাই কি এত মেসেজ, ই-মেল আর ফ্যাক্স পাঠাচ্ছেন? নাকি যাঁরা পাঠাচ্ছেন, তাঁরা সকলেই অণ্ণার কট্টর সমর্থক? আলাদা আলাদা ব্যক্তির থেকে মেসেজ, ই-মেল, ফ্যাক্স এলেও বয়ান হুবহু মিলে যাচ্ছে কী ভাবে?
সব প্রশ্নের উত্তর জানেন এক জন। রিকেন পটেল। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই কানাডার নাগরিক এবং তাঁর সংগঠন ‘আওয়াজ’ অণ্ণার হয়ে এই ভাবে প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছে। অণ্ণার আন্দোলনের প্রত্যেক ধাপে তাঁরা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছেন হরেক দাবিপত্র। |
আর সেই সব ‘অনলাইন পিটিশন’-এ যে কোনও ব্যক্তি নিজের নাম ‘রেজিস্টার’ করা মাত্রই তাঁর নামে একটা করে ই-মেল বা ফ্যাক্স পৌঁছে যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলির কাছে। এ ছাড়া এমন কিছু ওয়েবসাইট রয়েছে, যেখান থেকে একসঙ্গে অনেককে এসএমএস পাঠানো যায়। লোকসভা-রাজ্যসভার সাইটেই দেওয়া রয়েছে সাংসদদের মোবাইল নম্বর। ‘আওয়াজ’-এর উৎসাহ পেয়ে অনেকে সাংসদদের মেসেজও পাঠাচ্ছেন। দিল্লির যন্তরমন্তর বা মুম্বইয়ের কোনও জায়গা বেছে বিরাট বিলবোর্ড বসাচ্ছে ‘আওয়াজ’। সেখানে যাঁরা সই বা মন্তব্য করবেন, সবই পৌঁছে দেওয়া হবে মনমোহন-সরকারের দোরগোড়ায়। কী ভাবে, তা এখনও ঠিক হয়নি। বিলবোর্ডটার ছবি তুলে তা ইন্টারনেটে ছড়ানো হতে পারে, আবার আস্ত বিলবোর্ডটাকে মন্ত্রী-সাংসদদের কাছে পৌঁছে দেওয়াও হতে পারে!
কে এই রিকেন পটেল? অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বাল্লোই কলেজের এক প্রাক্তন ছাত্র। হাভার্ডে ‘পাবলিক পলিসি’-তে স্নাতকোত্তর। ছাত্রাবস্থা থেকেই নানা আন্দোলনে যোগ দিতেন। ২০০৭ সালে তৈরি করেন ‘আওয়াজ’। দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান ছাড়াও মানবাধিকার ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে নানা দেশে প্রচারের কাজে যুক্ত রয়েছে এই সংগঠন। সদস্য-সংখ্যা এক কোটিরও বেশি এবং তা প্রতি মুহূর্তে বেড়ে চলেছে। তিব্বত এবং মায়ানমার নিয়ে চিনের অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর জন্য সে দেশে ‘আওয়াজ’-এর ওয়েবসাইট ‘ব্লক’ করে দেওয়া হয়েছে। নানা দেশে ‘স্প্যাম’ ই-মেল পাঠিয়ে সরকারি কাজকর্ম অচল করে দেওয়ার চেষ্টারও অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগ অবশ্য খারিজ করে দিয়েছেন রিকেন। কিন্তু তাঁর সংগঠন অণ্ণাদের হয়ে মাঠে নামার পর থেকে দিল্লির যে এক বিশাল মাথাব্যথা বেড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।
রিকেনদের কর্মপন্থাটা আসলে খুব সোজা। ‘আওয়াজ’-এর নিজস্ব সাইট বা ‘ইন্ডিয়া এগেনস্ট কোরাপশন’-এর সাইটের মতো কয়েকটা বিশেষ সাইটে কিছু ‘লিঙ্ক’ দেওয়া থাকছে। তাতে মাউস ক্লিক করলেই খুলে যাচ্ছে অণ্ণার সমর্থনে ‘অনলাইন দাবিপত্র’। কখনও ‘আওয়াজে’রই সদস্যরা তাঁদের পরিচিতদের কাছে ই-মেল বা ওই লিঙ্কটি পাঠাচ্ছেন। ‘আওয়াজ’-এর ফেসবুক পেজকেও ব্যবহার করা হচ্ছে এই কাজে। উৎসাহী ব্যক্তিকে শুধু নিজের নাম, ই-মেল আইডি-র মতো কয়েকটা তথ্য ওই অনলাইন দাবিপত্রে লিখে দিতে হচ্ছে। এর পর ‘আওয়াজ’-এর বিশেষ সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে সেটি ই-মেল বা ফ্যাক্সের আকারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে কখনও প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়, কখনও কোনও নির্দিষ্ট সাংসদের ঠিকানায়। অণ্ণা লোকপালের দাবিতে যন্তর মন্তরে অনশনে বসার সময় থেকে শুরু। প্রথম ৩৬ ঘণ্টাতেই পাঁচ লক্ষ মানুষ ফেসবুক বা ই-মেলের মাধ্যমে প্রচারে অংশ নেন। ‘আওয়াজ’-এর নিজস্ব হিসেবে, ওই সময় অন্তত ৮ লক্ষ ই-মেল ও ১৫ হাজার ফ্যাক্স গিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলির কাছে। ছোট দলগুলি নাকি এক রকম হাত জোড় করে বলেছিল, ‘আপনারা সামনে এসে বলুন। এই ই-মেল, ফ্যাক্সের অত্যাচার বন্ধ করুন।’ এর পর রামলীলায় অণ্ণার অনশনের সময় প্রতি সেকেন্ডে দু’জন ‘আওয়াজ’-এর প্রচারে অংশ নেন। অণ্ণা গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁর মুক্তির দাবিতেও একই কাণ্ড ঘটে। সরকারি সূত্রের বক্তব্য, তখনই এর পিছনে কারা রয়েছে, গোয়েন্দাদের তা খুঁজে বার করতে বলা হয়। দেখা যায়, সমস্ত ই-মেল, ফ্যাক্সের মূল উৎস নিউ ইয়র্কের ব্রডওয়েতে ৮৫৭ নম্বর বাড়ির তিনতলায়। সেটাই রিকেনের ঠিকানা। ‘আওয়াজ’-এর শিবেন্দ্র সিংহ চৌহান আনন্দবাজারকে বলেন, “এপ্রিল থেকে আমরা অণ্ণা এবং ‘ইন্ডিয়া এগেনস্ট কোরাপশন’-এর সঙ্গে কাজ করছি। বিশ্বের সমস্ত দেশেই দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে আমরা সাহায্য করি। তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে শক্তিশালী করাটা আমাদের কাজ। ফলে সরকারের কানে দাবি পৌঁছতে, জনমত গঠন করে চাপ তৈরি সহজ হয়। ব্রাজিল, স্পেনে আমাদের চাপেই কড়া দুর্নীতি দমন আইন হয়েছে। ভারতেও তাই বহু কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়েছে।”
কংগ্রেস-সহ নানা দলের সাংসদদের কিন্তু প্রশ্ন, রিকেন পটেল ও তাঁর সঙ্গীরা কীসের বিনিময়ে সাহায্য করছেন অণ্ণাকে? কেউ কি পিছন থেকে অর্থের জোগান দিচ্ছে? কংগ্রেসের অনেকেরই সন্দেহ, বিজেপি তথা আরএসএস-এর বিদেশি মদতদাতারা এর পিছনে অর্থ ঢালছে। তাঁদের বক্তব্য, এ ভাবে তো পাকিস্তানের মতো দেশও এদের কাজে লাগিয়ে ভারত-বিরোধী প্রচার করতে পারে! মণীশ তিওয়ারি যেমন বলেন, “আমি নিশ্চিত, সরকার খতিয়ে দেখবে এর পিছনে কোনও সাম্প্রদায়িক বা রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি আছে কি না।” শিবেন্দ্র কিন্তু হাসতে হাসতে বললেন, “আওয়াজ ধনী সংগঠন। বিশ্বের প্রচুর মানুষ নিয়মিত চাঁদা দেন। সরকারি সংগঠন থেকে চাঁদা দিই না। এককালীন চাঁদার পরিমাণেরও ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া রয়েছে। দফতরেরও প্রয়োজন নেই। আইফোন, ক্যামেরা, স্যাটেলাইট মোডেম থাকলেই ভার্চুয়াল অফিস খুলে ফেলতে পারি।”
তাই এক ‘অন্য রকম’ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি কেন্দ্র। ‘সাইবার-আন্দোলনে’র উৎসমুখ সন্ধানের পর কংগ্রেস তথা কেন্দ্র পাল্টা প্রচারে গিয়ে বোঝাতে চাইছে, অণ্ণার পিছনে সমর্থনের সবটাই মেকি ও অবাস্তব। কিন্তু রিকেন পটেলের প্রচারের সঙ্গে সরকারি প্রচার পারে কি না, সেটাই দেখার।
|