প্রথমে যাদবপুর বিদ্যাপীঠে সর্বসমক্ষে প্রধান শিক্ষককে মারধর, তাহার পর পরীক্ষায় টোকাটুকির জেরে ফেল-করা ছাত্রীকে পাশ করাইবার দাবিতে স্কুলে ঢুকিয়া স্কুল পরিচালন কমিটির সহ-সভাপতির গুণ্ডামি। চমৎকার সব নজির স্থাপিত হইতেছে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাজগতে। যাঁহারা এই সব দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়া রাজ্যের মুখ উজ্জ্বল করিতেছেন, তাঁহারা অনেকে রাজ্যের নবীন শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য, সমর্থক বা স্থানীয় নেতা। তাঁহারা হয়তো ভাবিতেছেন, ইহাতে তাঁহাদের দলের মুখ উজ্জ্বল হইতেছে! অথচ বাস্তবে কিন্তু ইহাতে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের মুখ পুড়িতেছে। বিদ্বজ্জনরা স্কুলে ঢুকিয়া দলপরিচয়ভুক্ত স্থানীয় বাহুবলীদের এ ধরনের যথেচ্ছাচারকে ধিক্কার জানাইয়াছেন। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিপদ সম্পর্কে দৃশ্যত সচেতন। যাদবপুরের ঘটনায় এক নিগ্রহকারীকে বিলম্বে গ্রেফতার করার নির্দেশে তাহা স্পষ্ট।
জমানা বদলের পরেই স্কুলে-স্কুলে এ ধরনের গুণ্ডামি ও সমাজবিরোধী দৌরাত্ম্য কিন্তু রাজ্যের শিক্ষা ও সমাজের ক্ষেত্রে এক বিপজ্জনক অশনি-সঙ্কেত। শুরুতেই এই প্রবণতার মূলোৎপাটন করিতে না পারিলে শিক্ষায়, সমাজে ষাট-সত্তরের দশকের নৈরাজ্য ফিরিয়া আসার শঙ্কা বাস্তব। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের শাসনক্ষমতা হাসিল করিয়াই দলবাজিমুক্ত, রাজনীতিমুক্ত প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা কায়েমের প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন। তাঁহার সে দিনের আশ্বাসে অবিশ্বাস করার কোনও কারণও ছিল না। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট হইতে রাজ্যের প্রতিটি বিষয় নিয়ন্ত্রণের যে-ধারা সাড়ে তিন দশকের অনুশীলনে রেওয়াজে পরিণত হইয়াছিল, তৃণমূল নেত্রী তাহা রদ করার কথা দিয়াছিলেন। প্রশাসনকে রাজনীতিমুক্ত করা, পুলিশকে দলপরিচয়নির্বিশেষে অভিযুক্ত আইনভঙ্গকারীদের গ্রেফতার করার আহ্বানও তাঁহার কণ্ঠে শুনা যায়। বাস্তবে কিন্তু দেখা যাইতেছে, স্কুল পরিচালন কমিটির নির্বাচন, ছাত্র সংসদের নির্বাচনে গণ্ডগোল, এমনকী বোমাবাজি হইলেও পুলিশ তাহার মোকাবিলায় বিশেষ তৎপরতা দেখাইতেছে না, যত ক্ষণ না উপরতলা হইতে নির্দিষ্ট আদেশ আসে। যাদবপুর বিদ্যাপীঠে যে দুর্বৃত্তটি প্রধান শিক্ষককে নিগ্রহে লিপ্ত হয়, তাহাকেও পত্রপাঠ গ্রেফতার করা হয় নাই। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই অবশেষে পুলিশ ব্যবস্থা লয়। সে ক্ষেত্রেও নিগ্রহকারীকে পাকড়াও করিয়াও তাহার উস্কানিদাতা স্থানীয় কাউন্সিলর ও অন্য নেতাদের অব্যাহতি দেওয়া হইয়াছে কেন, সে প্রশ্নও অপ্রাসঙ্গিক নয়। পুলিশ কেন সমাজবিরোধী দৌরাত্ম্য দেখিলেই কড়া ব্যবস্থা লইতে দ্বিধাগ্রস্ত?
উত্তরটা কিন্তু প্রশাসনকে এবং তাহার কর্ণধার মুখ্যমন্ত্রীকেই দিতে হইবে। তাহাই রাজধর্মের দাবি। রাজধর্ম হইল প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা। শাসক সেই রাজধর্মে স্থিত বুঝিলে তাঁহার দলের লোকেরাও আইনের শাসনে অন্তর্ঘাত করিতে, নিজের হাতে আইন তুলিয়া লইতে ভয় পায়। তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষেত্রে যদি তাহা না ঘটিয়া থাকে, বিভিন্ন স্তরের নেতা ও কর্মীরা যদি ক্ষমতাকে যথেচ্ছাচারের অনুমতিপত্র হিসাবে গণ্য করেন, তাহা হইলে সেটা বড় দুর্লক্ষণ। অনুগামীদের মন হইতে এই বিভ্রম যত শীঘ্র দূর করা যায়, ততই আইনের শাসন ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা রাজ্যে কার্যকর হইবে। আর তাহা করার দায়িত্বও দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীরই। সর্ব স্তরের দলীয় সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ করা যাইতেছে না, ইহা কোনও যুক্তি হইতে পারে না। জনসাধারণ পক্ষপাতহীন সরকার ও প্রশাসন দেখিতে চাহেন। সে জন্যই রাজ্যে তাঁহারা পট-পরিবর্তন ঘটাইয়াছেন। দলকে নিয়ন্ত্রণ করিয়া প্রশাসনকে নিরপেক্ষ না করিলে পরিবর্তনটি প্রহসন হইয়া উঠিবে। প্রশাসককে এ জন্য কঠোর ও ক্ষমাহীন হইতে হইবে। প্রশ্নটি কেবল শাসকের ভাবমূর্তির নয়, তাঁহার দায়বদ্ধতারও। |