প্রত্যাশিত ভাবেই বিষ মদ-কাণ্ডে রাজ্যের মন্ত্রী এবং শাসক দলের নেতাদের মন্তব্যের ‘প্রভাব’ পড়ল সর্বদল বৈঠকে। তদন্ত চলাকালীন ওই ঘটনার জন্য সরাসরি সিপিএম-কে দায়ী করে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো মন্ত্রী এবং নেতারা যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তা প্রত্যাহার করে ‘দুঃখপ্রকাশে’র দাবি জানাল বিরোধী শিবির। সরকার পক্ষ তাদের অবস্থানে অনড় থাকায় লিখিত বক্তব্য জানিয়ে বৈঠক থেকে বেরিয়ে এল বিরোধী বামফ্রন্ট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় সর্বদল বৈঠকের ক্ষেত্রে যে ঘটনা এই প্রথম।
পার্থবাবুর মন্তব্যের ‘প্রভাব’ পড়ছে দেখে সোমবারের বৈঠকে বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, ওই বক্তব্য ‘দল’ হিসেবে তৃণমূলের। রাজ্য সরকার বা প্রশাসনের নয়। কিন্তু বিরোধীরা স্বাভাবিক ভাবেই সেই ব্যাখ্যায় ‘সন্তুষ্ট’ হয়নি। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র পরে বলেছেন, “আমাদের খুব ক্ষুদ্র দাবি ছিল। ওই বিবৃতি প্রত্যাহার করে দুঃখপ্রকাশ করতে হবে। ওঁরা তা করলেন না। পার্থবাবু ওই মন্তব্য করেছিলেন বিধানসভার চৌহদ্দির মধ্যে। নিজের ঘরে ক্যামেরা ডেকে। সুতরাং, তৃণমূলের মহাসচিব হিসেবে কথা বলেছেন এই যুক্তি টেকে না!” |
এ বারের অভিজ্ঞতার পরে সরকার-বিরোধী আদানপ্রদানমূলক সম্পর্কে (যা মমতার জমানায় দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে) কি প্রভাব পড়তে পারে? বিরোধী দলনেতা বলেন, “আমরা একটি ঘটনা দিয়ে সব ঘটনার বিচার করি না। অনেক ধৈর্য নিয়ে আমরা অপেক্ষা করেছি, আরও ধৈর্য দেখাব! একটা দিয়ে সব ঘটনাকে বিচার করতে যাব না!”
রাজ্য সরকার অবশ্য মনে করছে, বিরোধীরা ‘বিপ্লবী নাটক’ করলেও চোলাই মদের সমস্যা দূরীকরণে বেশ কিছু ‘সদর্থক’ সিদ্ধান্ত সর্বদল বৈঠক থেকে নেওয়া গিয়েছে। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঠিক হয়েছে, সচেতনতা কর্মসূচি চালানো হবে। বেআইনি মদের মতো সামাজিক ব্যাধি দূর করতে প্রশাসনিক স্তরে নজরদারি কমিটিও কাজ করবে।” স্পিকার যাকে ‘ঐকমত্য’ বলছেন, তার মধ্যে অবশ্যই বিরোধীরা ছিল না। তৃণমূল ছাড়াও ছিল সরকারের শরিক কংগ্রেস এবং তার বাইরে এসইউসি এবং গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা।
বস্তুত, চোলাই মদের ঠেক ভাঙতে প্রশাসনিক স্তরে নজরদারি বা সচেতনতার জন্য প্রচার এর কোনওটিই অভিনব কর্মসূচি নয়। বিভিন্ন সরকারের আমলে নানা সময়েই এই ধরনের উদ্যোগের পরেও চোলাই মদের কারবার অব্যাহত থেকেছে। কারণ, প্রশাসনের তরফে কর্মসূচি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চালানো হয়নি। এ বার মগরাহাটে বিষ মদে বহু মানুষের মৃত্যুর পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা চেয়েছিলেন, এই সামাজিক সমস্যা মোকাবিলায় সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে যৌথ প্রস্তাব নিতে। যাতে তাঁর সরকারের ‘সদিচ্ছা’ নিয়ে কোনও প্রশ্ন না-থাকে। কিন্তু সিপিএম-কে পার্থবাবুদের আক্রমণ এবং তার জেরে বিরোধীরা মাঝ পথেই সর্বদল বৈঠক থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় অন্তত এই ঘটনায় শাসক ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে ‘তিক্ততা’ রয়ে গেল। |
একই সঙ্গে ‘অনুচ্চারিত’ থেকে গেল চোলাই সমস্যার মূলও। রাজ্য সরকারের ‘রক্ষণশীল’ মদ নীতির কারণেই চোলাই মদের রমরমা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকেরই অভিযোগ। তাদের বক্তব্য, যথেষ্ট সংখ্যক মদের দোকান খোলার অনুমতি সরকার দেয় না বলেই গরিব মানুষের মধ্যে চোলাই মদ জনপ্রিয় হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে দেশি মদের জোগান বাড়িয়ে চোলাই রোখা সম্ভব বলে তাদের মত। কারণ, মদ না-খাওয়ার প্রচারে যে আখেরে কোনও কাজ দেয় না, সেটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। কিন্তু ঘটনা হল, এ দিনের সর্বদলে এই মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি। উল্টে পরিষদীয়মন্ত্রীর মন্তব্য, “পানের দোকানের চেয়ে বেশি মদের দোকান খুলে দিয়ে গিয়েছে বামফ্রন্ট!”
এ হেন লাগাতার কটাক্ষের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধীদের পাল্টা প্রশ্ন, সর্বদল বৈঠক ডাকার পরেও ‘কুৎসামূলক অভিযোগ’ তোলা হচ্ছে কেন? বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে এসে সিপিএম বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা বলেন, “প্রথম দিন থেকে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করছি মানে আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ভাবলে চলবে না! যাঁদের আসামি বলে দেগে দিচ্ছেন, তাঁদের ডেকে আবার আলোচনা করছেন কেন?” এই চোখা প্রশ্নের সরাসরি জবাব পার্থবাবু দেননি। বরং তিনি বলেছেন, “তৃণমূলের তরফে যা বলেছিলাম, তার থেকে এক চুলও সরে আসছি না! সূর্যবাবুরা কিছু দাবি জানিয়ে বেরিয়ে যাবেন, এই পরিকল্পনা নিয়েই এসেছিলেন! এই রকম বিপ্লবী নাটক আমরা অনেক দেখেছি! যদি কেউ এঁদের মোদো সিপিএম বলে, তার দায়িত্ব তো আমরা নিতে পারি না!” বিরোধী দলনেতার প্রতি পার্থবাবুর সরাসরি কটাক্ষ, “সূর্য ডুবি ডুবি, কী করবে ভেবে পাচ্ছে না! কোনও না কোনও প্রশ্নে রোজ বিধানসভা অচল করার চেষ্টা করছেন ওঁরা। তবে এখনও সফল হননি!”
পার্থবাবুর এ দিনের আক্রমণের পরে শাসক-বিরোধী ‘ট্র্যাক-টু’ আদানপ্রদান বজায় থাকে কি না, তা-ই এখন দেখার। মাতৃবিয়োগের জন্য মুখ্যমন্ত্রী এ দিনের বৈঠকে ছিলেন না। বৈঠকের সুপারিশ স্পিকারের মারফত তাঁকে জানানো হবে।
সূর্যবাবু এ দিন বলেন, “মূল দোষীদের আড়াল করতে এবং নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে সরকার বিরোধীদের উপরে দোষ চাপাচ্ছে। এতগুলো মানুষের মৃত্যুর জন্য বিলাপ হচ্ছে আর এখানে আমরা প্রলাপ শুনছি!” সরকারে গাফিলতি বোঝাতে বিরোধী দলনেতার প্রশ্ন:
• মগরাহাটে ৩১ মে-র পরে বেআইনি মদভাটি ভাঙতে আর পুলিশি অভিযান হল না কেন?
• দক্ষিণ ২৪ পরগনায় চার জন ডেপুটি আবগারি কমিশনারের তিন জনকে বদলি করে মাত্র এক জনকে রেখে দেওয়া হল কেন?
• এই ধরনের ঘটনায় ওয়াই কার্বোনেট, ইথানলের মতো ওষুধ লাগে। দুষ্প্রাপ্য না-হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতালগুলিতে তা মজুত ছিল না কেন?
•
মেথিলেটেড স্পিরিট মদে মেশালে অন্য রং হবে, তার জন্য ওই নির্দিষ্ট রকমেরই রাসায়নিক বিক্রির অনুমতি দেওয়ার যে ব্যবস্থা বাম আমলে চালু করা হয়েছিল, সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হল কেন?
•
মেডিক্যাল টিম পাঠাতে এত সময় লাগল কেন?
•
১০-১২টি মৃতদেহ স্তূপাকারে ভ্যানে চাপিয়ে ‘অমানবিকতা’ দেখানো হল কেন?
এর কোনওটিরই উত্তর পার্থবাবু দেননি। বরং বিধানসভা থেকে বেরিয়ে গিয়েও মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ফিরে এসে সুব্রতবাবু সাংবাদিকদের বলে গিয়েছেন, “দক্ষিণ ২৪ পরগনাকে ঘটনা ঘটানোর জন্য ওঁরা যে বেছে নিয়েছেন, এত কথা থেকেই পরিষ্কার! আর কে কবে কোথায় কী খেয়ে অসুস্থ হবে, তার জন্য কি সরকার তৈরি হয়ে বসে থাকবে?”
পার্থবাবুদের পক্ষে ‘স্বস্তিজনক’ যে, জোট-শরিক কংগ্রেস সরকারেরই পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাবের কথায়, “সূর্যবাবুদের এই ভাবে বৈঠক থেকে চলে যাওয়া উচিত হয়নি। পার্থবাবু কোথায় কী বলেছেন, সেটা বিচার্য নয়! বিচার্য বিষয় হচ্ছে, কী ভাবে এই সামাজিক ব্যাধি দূর করা যায়।”
পার্থবাবুদের মতোই স্পিকারেরও মত, “সূর্যবাবুরা বোধহয় পূর্বপরিকল্পিত ভাবে এসেছিলেন থাকবেন না বলে!” আর সূর্যবাবু পাল্টা বলেছেন, “স্পিকারকে নিয়ে আর কী মম্তব্য করব? উনি তো ডান দিকে (পার্থবাবুদের আসন যেখানে) তাকিয়ে যা করার করেন!” |