প্রবন্ধ ২...
সহসা মৃত্যুর স্তূপ
দৈনন্দিন জীবন যেমন
প্রশ্নটা অনেক বার শুনেছি আপনারা কাগজে এমন বীভৎস ছবি ছাপান কেন? সকালের চা-টা তেতো হয়ে যায়, শরীর খারাপ লাগে, সারা দিন একটা আতঙ্ক তাড়া করে ফেরে, বাড়িতে ছোট ছেলেমেয়ে থাকলে কাগজটা লুকিয়ে রাখতে হয়। এটা কি ঠিক?
‘হ্যাঁ, ঠিক’ কিংবা ‘না, ভুল’ বলে দিতে পারিনি। মনে হয়েছে, উত্তরটা পরিস্থিতির ওপর, নির্ভর করে। নিছক মনকে ধাক্কা দেওয়ার জন্যেই এমন দৃশ্য পরিবেশন করা হলে আপত্তি যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ধাক্কা দেওয়া অনেক সময় জরুরি হতে পারে। সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় মানববোমার ছিন্নমুণ্ড দেখে বহু মানুষের মনে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া হবে, স্বাভাবিক, কিন্তু সেটাই হয়তো ওই ছবি ব্যবহারের বড় যুক্তি এক হাজার শব্দ ব্যয় করেও আত্মঘাতী হিংসার ভয়াবহতা এমন ভাবে এক ধাক্কায় বোঝানো যেত কি? তাই অনেক ভেবেচিন্তেই জবাব দিয়েছি, চার পাশের দুনিয়াটা হিংস্র, রক্তাক্ত, ভয়ংকর হয়ে থাকবে আর আমরা রোজ সকালে কাগজ খুলে সমুদ্রতীরে সূর্যোদয়ের কিংবা আরও একটি রেকর্ড ভাঙার আনন্দে উদ্ভাসিত সচিন তেন্ডুলকরের ছবি দেখে চায়ের কাপে আরাম চুমুক দেব? তা হলে আর সংবাদপত্রেকে আর সমকালের দর্পণ বলার মানে কী?
সে দিন, ১৬ ডিসেম্বর সকালে চায়ের কাপ হাতে ময়না তদন্তের জন্য ভ্যানরিকশ’য় নিয়ে যাওয়া স্তূপাকার লাশগুলি (ছবি: দিলীপ নস্কর) দেখে চেনা যুক্তি, চেনা তর্কগুলো মনে পড়ল। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় এল আর একটা প্রশ্ন। এই দৃশ্য আমাদের ঠিক কতটা ধাক্কা দিল? আমরা, যারা রোজ সকালে চায়ের কাপ হাতে খবরের কাগজ পড়ি? চা-টা একটু বিস্বাদ লাগল নিশ্চয়ই, গা-টা ঈষৎ গুলিয়ে উঠল, কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িটা পাশে এসে দাঁড়ালে যেমন হয়, কিন্তু তার বেশি কিছু? তীব্র রাগ? অসহনীয় যন্ত্রণা? ‘এমন ভাবে আর একটা প্রাণও নষ্ট হতে দেব না’ বলে চোয়াল-শক্ত-করা প্রতিজ্ঞা?
অর্থহীন, অবান্তর প্রশ্ন? ঠিক। আমরা তো জানিই, এই মৃত্যু যতটা করুণ, ততটাই অনিবার্য। চোলাই মদ যাদের প্রকৃত পানীয়, তারা মাঝে মাঝে বিষক্রিয়ায় প্রাণ হারাবেই। আমরা হৃদয়হীন নই, কিন্তু হৃদয়ের অপচয় করে লাভ কী? দেশের যথেষ্ট উন্নতি হলে, শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার হলে আস্তে আস্তে এই উপদ্রব কমবে, তত দিন যতটা পারা যায় নজর রাখা এর বেশি কী-ই বা করার আছে? আমরা অসহায়। আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছি। বস্তুত, হাল ধরিইনি কখনও।
এই হাল-না-ধরা নিষ্ক্রিয়তাটা খুব ভয়ঙ্কর। যে কোনও প্রত্যক্ষ হিংসার চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর, কারণ এই নিষ্ক্রিয়তাকে সরাসরি আক্রমণ করারও কোনও উপায় নেই। এ ঠিক অবহেলাও নয়, দায়িত্বে ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগও এ ক্ষেত্রে খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়। দায়িত্ব, দায়িত্বের বোধ, সে সব তো অনেক পরের কথা। এ একেবারেই দেখতে না-পাওয়া, দেখতে না-পারা। যে মানুষগুলো রোজ সন্ধের পরে চোলাই মদ পান করে বেসামাল হয়ে যায়, রোজ একটু একটু করে দেহযন্ত্রটিকে বিনষ্ট করতে থাকে, ক্রমশ অশক্ত, অসুস্থ, অক্ষম হয়ে অকালে বসে যায় বা মরে যায়, ওই গোটা জনসমষ্টিটা আমাদের দৃষ্টির বাইরেই বসত করে। রেডারের নজরের বাইরে থাকা বোমারু বিমানের মতো। জানি, তুলনাটায় একটা গোলমাল আছে বোমারু বিমান অলক্ষ্যে অন্যদের মারে, ওই মানুষগুলো অলক্ষ্যে নিজেদের মারে। দৈনন্দিন, ধারাবাহিক, নিরবিচ্ছিন্ন মৃত্যু। কেবল মাঝে মাঝে বিষের মাত্রাটা বেশি চড়ে যায়, তখন অনেকগুলো জীবন হঠাৎ স্তূপাকার লাশ হয়ে ভ্যানরিকশ’য় চড়ে মর্গে যায়, তার ছবি ওঠে, সে ছবি দেখে আমরা জিভে ও তালুতে অল্প, বেশি নয়, অল্প আওয়াজ করি ‘ওঃ! এদের আর শিক্ষা হবে না!’ এবং মুণ্ডপাত করি পুলিশ, প্রশাসন, রাজনৈতিক দলের। কেন চোলাই মদের সমস্ত ঠেক অবিলম্বে ভেঙে দেওয়া হবে না, সেই প্রশ্ন তুলি সজোরে।
ভুল কিছু করি না। চোলাই মদের গোটা বন্দোবস্তটাই এক বিপুল অনাচার। সমাজ, রাজনীতি, প্রশাসনের নিয়ামক যাঁরা, তাঁরা এই ভয়ানক ও বিপজ্জনক অনাচারের সাম্রাজ্য বিস্তারে বাধা দেন না, তাকে প্রশ্রয় দেন, পুষে রাখেন, তার থেকে টু-পাইস করে নেন, মাঝে-মধ্যে অনেকগুলো মানুষ একসঙ্গে বিষক্রিয়ায় মারা গেলে দিন কয়েক ভাটি ভাঙার অভিযান চলে, যেমন এখন চলছে, অচিরেই শোরগোল ঝিমিয়ে পড়ে, যেমন পড়বে। নিশ্চয়ই এ সব বন্ধ হওয়া উচিত। কিন্তু সে তো সকলের সদা সত্য কথা বলাও উচিত। উচিত-অনুচিত নিয়ে এখানে কোনও গোল নেই, প্রশ্ন হল, উচিত কাজটা যাদের করার, তারা কেন সেটা করবে?
প্রশাসন বলতে যাঁদের বোঝায়, তাঁরা মানুষের মঙ্গল করার অদম্য বাসনায় প্রাণপাত করবেন, স্থানীয় স্বার্থের সমস্ত ঘাঁটি চুরমার করে দিয়ে এই বিষ নির্মূল করবেন ভাবতে খুব ভাল লাগতে পারে, কিন্তু দুনিয়া তো ঠিক এ ভাবে চলে না। সমাজের চাপ না থাকলে প্রশাসন অচল থাকে, রাজনীতি নিষ্ক্রিয়। সমাজ মানে যাঁদের প্রভাব আছে, প্রতিপত্তি আছে, অর্থাৎ ‘পিপল লাইক আস’। নানা অঞ্চলে গ্রামের মেয়েরা বার বার চোলাই মদের কারবার ভাঙার চেষ্টা করেছেন, কারণ ঘরের পুরুষ দিনের পর দিন নেশার কবলে সামান্য রোজগারটুকু সমর্পণ করে আসে, গরিবের সংসারে খুদকুঁড়োও জোটে না। কোথাও কোথাও বউ-ঝিদের চাপে সাময়িক কাজ হয়েছে, স্থায়ী সমাধান হয়নি। পিপল-লাইক-আস চাপ দিলেই সব সমস্যার প্রতিকার হবে, আমাদের গণতন্ত্র এখনও এত লায়েক হয়ে উঠতে পারিনি, আরও কয়েক শতাব্দী লাগবে হয়তো। কিন্তু প্রতিকারের জন্য আমাদের একটা চাপ না থাকলে কিছুই হবে না।
আমরা কখন চাপ দিই? যখন সমস্যাটা আমাদের অসহনীয় হয়। সেটা দু’ভাবে হতে পারে। এক, সমস্যায় আক্রান্ত যাঁরা, তাঁদের প্রতি যদি আমরা ‘সিমপ্যাথি’ বোধ করি। দয়া নয়, সহানুভূতি। দয়া টেকে না, এক দীর্ঘশ্বাসে বা দু’ফোঁটা চোখের জলে সাফ হয়ে যায়। সহ-অনুভূতি থাকে। দুই, সহানুভূতি থাক বা না থাক, যদি সমস্যা দূর করার জন্য আমাদের কমিটমেন্ট বা দায়বোধ থাকে। চোলাই মদের শিকার যারা, ‘পিপল লাইক দেম’, তাদের জন্য দুটোর কোনওটাই আমাদের নেই। থাকবে কী করে? সহানুভূতি বা দায়বোধ, কোনওটাই আকাশ থেকে পড়ে না, জীবনধারার পলি জমে জমে তৈরি হয়। আমাদের জীবনধারায় ‘ওদের’ প্রতি বড়জোর দয়ার জন্ম হতে পারে, সহানুভূতি বা দায়বোধের কোনও অবকাশ নেই। তাই ‘ওদের’ ভয়াবহ মৃত্যু আমাদের বিচলিত করে, হয়তো বিষণ্ণও, কিন্তু ক্রুদ্ধ করে না, এ দৃশ্যকে অ-সম্ভব করে তোলার প্রতিজ্ঞা জাগায় না। যদি জাগাত, আমরা প্রশাসনকে চাপ দিতাম।
চাপ দেওয়ার দরকারও হয়তো কমত, কারণ জীবনযাত্রার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই আমরা তখন ওই ওদের পাশে থাকার চেষ্টা করতাম, ওরা কী ভাবে বেঁচে আছে তার খোঁজ রাখতাম, সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরে সস্তার নেশায় নিজের অস্তিত্বটাকে প্রতিনিয়ত বিনষ্ট করার, বিপন্ন সংসারটা আরও বিপন্ন করে তোলার যে গ্লানি ওই মানুষগুলোর হৃদয়ে, তা আমাদের অন্তরকে আঘাত করত। তার পর আমরা ওদের জন্য কী করতে পারতাম, কতটা করতে পারতাম, সে সব তার পরের কথা। প্রথম কথা হল, আমরা ওই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার দৈনন্দিন প্রক্রিয়াটির দিকে একটু মনোযোগী হলে সেই বেঁচে থাকার চেহারা একটু বদলানোর চেষ্টা করতে পারতাম। শাসন করার একটা সৎ অধিকারও জন্মাত তখন। রবীন্দ্রনাথের কথা ধার করে বললে, সেটা পাহারাদারের শাসন না হয়ে অভিভাবকের শাসন হয়ে উঠতে পারত।
হয়নি। হওয়ার নয়। আমরা অগণিত মানুষের বেঁচে থাকার খোঁজ নিইনি, নিই না। আসলে স্তূপাকার লাশের ওই ছবিটা কেবল মৃত্যুর নয়। পিলসুজের নীচে জীবনের ছবিটাও ওই একই রকম।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.