প্রবন্ধ ১...
গতকালটা ছিল না
ভিপ্রায় কিংবা আদর্শ ঘিরে একটি রহস্য সম্প্রতি তৈরি হল জ্যোতির্বিজ্ঞানে। আর, মজার ব্যাপার, এ রহস্য সৃষ্টি হল অন্য একটি রহস্য সমাধানের সূত্রে। সব কিছুর কেন্দ্রে গত শতাব্দীর এক আবিষ্কার। যেমন-তেমন নয়, সে এক মহা-আবিষ্কার। তাৎপর্যে যার তুলনা নিকোলাস কোপারনিকাস-প্রবর্তিত বিপ্লব। মানুষের বিশ্ব-ভাবনা একদা যতখানি নতুন দিশা পেয়েছিল ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র থেকে পৃথিবীর সিংহাসন উৎপাটনে, তা ততখানি নতুন খাতে বয়েছিল গত শতাব্দীর ওই আবিষ্কারে। যাতে মুছে গিয়েছিল হাজার হাজার বছরের ভ্রান্তিবিলাস। জানা গিয়েছিল, এই ব্রহ্মাণ্ড অনাদি অনন্ত কালের নয়, তার জন্ম হয়েছিল কোনও এক দিন, কোনও এক মুহূর্তে।
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার বোধহয় এই যে, মহামূল্যবান ওই আবিষ্কার যিনি করতে পারতেন, তিনি স্রেফ নিজের ভুলে তা করেননি। আর, যিনি আবিষ্কারটি করেছিলেন, তিনি নেহাত নিজের ঔদাসীন্যে তাঁর যোগ্য সম্মান পাননি। অবশ্য, এমন সব কাণ্ড না ঘটলে বিজ্ঞান মহাকাব্য কীসে? সেই আখ্যানের একটি পর্বে দৃষ্টিপাত করা যাক।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে। জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি-র আবিষ্কর্তা আলবার্ট আইনস্টাইন নিজের তত্ত্ব নিয়ে পড়েছেন ধন্দে। কারণ, তা আভাস দিচ্ছে পরিবর্তনশীল বিশ্বের। বলছে, ব্রহ্মাণ্ডের যুগ যুগ ধরে একই রকম থাকার কথা নয়। তা বদলাতে বাধ্য। আয়তনে হয় বাড়ছে, নয় কমছে। ব্রহ্মাণ্ড কি সত্যিই পরিবর্তনশীল? মানতে পারলেন না আইনস্টাইন। নিজের আবিষ্কৃত ফর্মুলার ইঙ্গিত অগ্রাহ্য করলেন তিনি। বিবিধ কারণে। এক, গ্রিক দার্শনিকদের যুগ থেকে চলে আসছে অপরিবর্তনীয় বিশ্বের ধারণা। এ ব্যাপারে তিনি সনাতনপন্থী। দুই, ১৯১৭ সাল পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দূরবিনে এমন কিছু দেখেননি, যাতে মনে হয় ব্রহ্মাণ্ড বড় বা ছোট হচ্ছে। অতএব? আবিষ্কৃত ফর্মুলায় কোনও গলদ আছে ভেবে শোধরানোর জন্য তাকে একটু বদলে দিলেন আইনস্টাইন। হায়, এর ফলে ব্যর্থ হলেন ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম আবিষ্কারে। নিজের উদ্ভাবিত ফর্মুলাকে ভুল ভাবার আইনস্টাইন পরে বলেছিলেন, এ ত্রুটি তাঁর ‘জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল’।
সত্যিই তাই। নয়তো তিনি কেন উদাসীন থাকবেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক তথ্যে? আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ৪১টা নক্ষত্রপুঞ্জের আলো বিশ্লেষণ করে বলেন, ওগুলো স্থির নেই, ক্রমাগত ছুটছে।
১৯২৭ সাল। ব্রাসেলস থেকে প্রকাশিত অখ্যাত জার্নাল ‘অ্যানালস দ্য লা সোসাইতে সায়েন্তিফিক দ্য ব্রাসেলস’-এ ছাপা হল একটি পেপার। লেখকের নাম অ্যাবে জর্জ লেমাইত্রে। তিনি পদার্থবিজ্ঞানী। তবে সেটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি আবার চার্চের পাদ্রিও বটেন। ফরাসি ভাষায় লেখা তাঁর প্রবন্ধের উপজীব্য সেই ছুটন্ত নক্ষত্রপুঞ্জ বা গ্যালাক্সি। তবে, শুধু তা নয়। ছোটাছুটির হিসেব এবং আইনস্টাইন-আবিষ্কৃত জেনারেল রিলেটিভিটির ফর্মুলা মিশিয়ে লেমাইত্রে আবিষ্কার করেছেন এক বিচিত্র নিয়ম। কী রকম? ছোটার দরুন যে-কোনও গ্যালাক্সি অন্য যে-কোনও গ্যালাক্সি থেকে অনবরত দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু সরছে ওই নিয়মে। দুটো গ্যালাক্সির মধ্যে দূরত্ব যত বেশি, তাদের সরে যাওয়ার বেগও তত বেশি। ধরা যাক, এক জোড়া গ্যালাক্সি। তাদের মধ্যে দূরত্ব ১ লক্ষ আলোকবর্ষ। আর এক জোড়া গ্যালাক্সি। তাদের দূরত্ব ২ লক্ষ আলোকবর্ষ। তা হলে, প্রথম দুটো যদি একটা অন্যটা থেকে সেকেন্ডে ৫০০ কিলোমিটার বেগে দূরে সরে যায়, দ্বিতীয় দুটো একে অন্যের থেকে সরে যাচ্ছে সেকেন্ডে ১০০০ কিলোমিটার হিসেবে। অর্থাৎ, এই ব্রহ্মাণ্ড ক্রমাগত বেলুনের মতো স্ফীত হচ্ছে। আর তা হচ্ছে একটা
নিয়ম মেনে।
১৯২৭ সালে ব্রাসেলস শহরে পদার্থবিজ্ঞানীদের বিখ্যাত সম্মেলন। উপস্থিত আইনস্টাইন। অনেক উৎসাহ নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন ৩০ বছর বয়সী লেমাইত্রে। আইনস্টাইন যদি পেপারটি পড়ে মতামত দেন। পাদ্রির বেশভূষায় এই পদার্থবিজ্ঞানীকে দেখে খুব একটা পছন্দ হল না আইনস্টাইনের। পেপার পড়ে ওঁর মন্তব্য শোনাল বেশ রূঢ়: ‘আপনার গণনা দেখছি নির্ভুল। তবে, বিজ্ঞানটা যাচ্ছেতাই!’
লেমাইত্রে হতাশ। তবে হতোদ্যম নন। চালিয়ে গেলেন গবেষণা। ন’বছর বয়েসে ঠিক করে ফেলেছিলেন, হবেন পাদ্রি এবং বিজ্ঞানী। তাঁর মনে হয়েছিল, কোনও বিরোধ নেই ধর্ম আর বিজ্ঞানে। দুটোই ঈশ্বরের লীলা বোঝার প্রয়াস। বিশ্বতত্ত্বে গবেষণাও ওই বিশ্বাসের প্ররোচনায়। গবেষণার ফলাফলে দৃঢ়তর হল লেমাইত্রের ঈশ্বর-ভাবনা। ব্রহ্মাণ্ড যদি এখন প্রসারণশীল হয়, তবে আগে তা নিশ্চই আয়তনে ছিল ছোট। এ ভাবে সময়ে ক্রমশ পিছিয়ে গেলে, সূ-দূ-র অতীতে কোনও এক মুহূর্তে তা ছিল একটা বিন্দুর সমান ক্ষুদ্র। সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি থেকে সময় শুরু হয়েছে। তার আগে সময় বলে কিছু ছিল না। ওই মুহূর্ত, লেমাইত্রের ভাষায়, ‘আ ডে উইদাউট আ ইয়েস্টারডে’। আর, জন্মকালে সেই বিন্দুসম বিশ্ব? তা হল ‘আদি পরমাণু’। ব্রহ্মাণ্ড অনাদি অনন্ত কালের হলে ঈশ্বর অনাবশ্যক। কিন্তু, তা যদি সৃষ্টি হয়, তা হলে তো, লেমাইত্রের মনে হল, সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব মানতে হয়।
না, গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে ওই ধর্মীয় সিদ্ধান্ত লেমাইত্রে যোগ করেননি ১৯২৭ সালে প্রকাশিত পেপারে। ও সব পরের ব্যাপার। সে দিনের প্রবন্ধটি স্মরণীয় বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের বিচারে। এই ব্রহ্মাণ্ড যে প্রসারণশীল, এবং প্রসারণ যে নির্দিষ্ট নিয়মানুযায়ী, তা প্রথম বলা হয়েছিল ওই পেপারে।
হায়, তবু এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি থেকে লেমাইত্রে এক রকম বঞ্চিত। কিছু ইতিহাস-সচেতন গবেষক বাদ দিলে, সবাই প্রসারণশীল বিশ্বের আবিষ্কর্তা হিসেবে চেনেন অন্য এক বিজ্ঞানীকে। প্রসারণের বেলায় গ্যালাক্সিদের দূরত্ব আর বেগের ওই যে নিয়ম, তা-ও এখন ওই বিজ্ঞানীর নামের সঙ্গে যুক্ত। কে তিনি? এডুইন হাবল। ১৯২০-র দশকে যিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরি-র দূরবিনে চোখ রেখে বহু গ্যালাক্সির ছুটে চলার বেগ মেপেছিলেন। তাঁর খ্যাতির উৎস ১৯২৯ সালে ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত জার্নাল ‘প্রসিডিংস অব দি ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’-এ ছাপা একটি পেপার। যাতে ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণ ও তার নিয়ম তুলে ধরেছিলেন হাবল। যে প্রবন্ধে দু’বছর আগে ছাপা লেমাইত্রের পেপারের লেশমাত্র উল্লেখ ছিল না।
ইংরেজি ভাষায় বিখ্যাত জার্নালে ছাপার বদলে ফরাসি ভাষায় অখ্যাত জার্নালে পেপার প্রকাশের জন্যই কি লেমাইত্রে স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত? উত্তর ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ যা-ই হোক, এ ব্যাপারে তীক্ষ্ন মন্তব্য করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেমস পিবলস। বলেছেন, ‘নিজেদের বিষয়ের ইতিহাস সম্পর্কে পদার্থবিদদের মনোভাব বেশ স্বাস্থ্যকর। আমরা বিষয়টা প্রায় এড়িয়েই যাই।’
এ বছরের গোড়ায় বিস্মৃত সেই পর্বটিকে খুঁচিয়ে তুলেছিলেন একদল বিশেষজ্ঞ। ১৯২৭ বা ১৯২৯ নয়, ওঁদের অস্ত্র ছিল ১৯৩১ সালের এক প্রকাশনা। হ্যাঁ, ওই বছর লন্ডনের রয়াল অ্যাস্ট্রনমিকাল সোসাইটি-র সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন, লেমাইত্রের পেপারটি এত মূল্যবান যে তার ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হবে সোসাইটির মাসিক পত্রিকায়। কিন্তু কী আশ্চর্য, প্রকাশিত অনুবাদ থেকে যে বহু প্যারাগ্রাফ উধাও। বিশেষত যেগুলিতে তুলে ধরা হয়েছিল প্রসারণের নিয়ম। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, এ হেন অনুবাদের মূলে নিশ্চয়ই ছিল চক্রান্ত। যার উদ্দেশ্য ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণ এবং তার নিয়মের আবিষ্কর্তা হিসেবে হাবল-এর দাবি অটুট রাখা। এমনও হতে পারে যে, অনুবাদের কাজটি করেছিলেন স্বয়ং ওই আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
সত্যি? রহস্যের গন্ধ পেয়ে তদন্তে নেমেছিলেন আমেরিকায় স্পেস টেলিস্কোপ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী মারিও লিভিও। তাঁর অন্য পরিচয়টাও বলা দরকার। ১৯৯০ সালে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ‘হাবল টেলিস্কোপ’ নামে যে দূরবিন পাঠিয়েছিল মহাশূন্যে, তার সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণে যুক্ত ছিলেন লিভিও। হয়তো সে কারণে হাবল-এর নামে কালিমালেপনে কিঞ্চিৎ বিব্রত হয়েছিলেন তিনি। খতিয়ে দেখতে লন্ডনে রয়াল অস্ট্রনমিকাল সোসাইটির মহাফেজখানায় কয়েকশো নথি ঘেঁটেছেন তাই। লিভিও খুঁজে পেয়েছেন সোসাইটির মাসিক পত্রিকার সম্পাদককে লেখা লেমাইত্রের একখানি চিঠি। যা উড়িয়ে দিয়েছে চক্রান্তের অভিযোগ। হ্যাঁ, কারণ, সেই পেপারটির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন স্বয়ং লেমাইত্রে। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, গ্যালাক্সিদের ছুটে চলার বেগের আলোচনা ইংরেজি অনুবাদে তিনি রাখছেন না, কারণ ‘তার আর তেমন দরকার নেই’।
সুতরাং, তৈরি হল নতুন রহস্য। কেন লেমাইত্রে ভাবলেন ও-রকম? এটা ঠিক যে, তাঁর ১৯২৭-এর পেপারের চেয়ে হাবল-এর ১৯২৯-এর প্রবন্ধে গ্যালাক্সিদের বেগের মাপ আরও নিখুঁত। কিন্তু, তাতে কী? ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণশীলতা কিংবা তার নিয়মের আবিষ্কর্তা তো তিনিই, হাবল নন। এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি থেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে তবে তিনি কেন রাখলেন দূরে? সেই সময়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহলে তাঁর চেয়ে ঢের বেশি খ্যাতিমান হাবল-এর প্রতি সম্ভ্রমে? না কি পাদ্রিসুলভ নিরাসক্তিতে?
কোনটা ঠিক উত্তর?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.