যে কোনও ক্ষেত্রে দক্ষতা ও উৎকর্ষের জন্য ভারতরত্নে ভূষিত করা যাইবে এই মর্মে প্রধানমন্ত্রীর দফতর হইতে একটি ঘোষণা জারি হইয়াছে। ‘যে কোনও ক্ষেত্র’ বলিলেও আসলে যে খেলাধুলা, বিশেষত ক্রিকেটে দক্ষতার জন্যও ভারতরত্ন দেওয়াই ঘোষণাটির উদ্দেশ্য, তাহা বুঝা কঠিন নয়। এবং সাম্প্রতিক কালের একটি গণদাবির প্রেক্ষিতে মূলত সচিন রমেশ তেণ্ডুলকরকে এই সম্মানে ভূষিত করাই যে ভারতরত্নের জন্য বিবেচিত হওয়ার যোগ্যতামান সম্প্রসারিত ও শিথিল করার লক্ষ্য, এমন অনুমান অসঙ্গত হইবে না। আর এখানেই প্রশ্ন। তবে কি অতঃপর সাহিত্য, শিল্পকলা, দর্শন, বিজ্ঞান ও সমাজসেবার মতো ক্ষেত্রে সমুজ্জ্বল অবদানের সহিত ক্রীড়াক্ষেত্রে পারঙ্গমতাও একই আসনের দাবিদার হইয়া গেল? মুড়ি ও মিছরির দর তবে একই?
সচিন তেণ্ডুলকরের ক্রিকেট-প্রতিভাকে ছোট করিয়া দেখার কোনও কারণ নাই, প্রয়োজনও নাই। ক্রিকেট ভারতের সর্বাধিক জনপ্রিয় খেলাও বটে। কিন্তু খেলাধুলায় কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসাবে তো অন্যান্য পুরস্কারের ব্যবস্থা আছেই। অর্জুন পুরস্কার, রাজীব খেলরত্ন ইত্যাদি। দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন তো দেওয়া হয় সি ভি রমনের মতো বিজ্ঞানী, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের মতো পণ্ডিত, সি রাজাগোপালাচারির মতো রাষ্ট্রনীতিককে। খেলোয়াড়রা তাঁহারা যতই জনপ্রিয় ও কীর্তিমান হউন এই মর্যাদাপূর্ণ তালিকার অন্তর্ভুক্ত হইবেন কেন? তাহাতে কি ‘ভারতরত্ন’ উপাধিটির মর্যাদাই লঘু হইয়া যায় না? ইহার পর হয়তো ভাইচুং ভুটিয়ার নাম উঠিবে, তাহার পর সাইনা নেহওয়াল? দাবির ভিড়ে কিংবা জনপ্রিয়তার মানদণ্ডে চিত্রতারকারাই বা পিছাইয়া থাকিবেন কেন? এই ভাবে ভারতরত্ন কালক্রমে একটি কৌতুককর ও প্রহসনময় সম্মানে পরিণত হইতে পারে। প্রধানমন্ত্রী কি এই দিকটি ভাবিয়া দেখিয়াছেন?
প্রক্রিয়াটি অবশ্য আগেই শুরু হইয়াছিল। অনেক আগেই। নহবতখানা কিংবা বিবাহবাসরে বাদ্য একটি যন্ত্রের দক্ষ বাদককে ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করিয়া সরকার আগেই এই
সম্মানটির গাম্ভীর্য ও মর্যাদা বহুলাংশে অবনমিত করিয়াছিল। রাজতন্ত্রে রাজা যাহার উপর খুশি হইতেন, তাহাকেই যেমন আপন কণ্ঠহার খুলিয়া পরাইয়া দিতেন, আধুনিক গণতন্ত্রেও সেই দৃষ্টিভঙ্গি হইতে অনুগ্রহ বিতরণের রেওয়াজ চালু রহিয়াছে। গণতন্ত্র বলিয়াই সম্ভবত ব্যক্তি-রাজা অপেক্ষা গণের চাহিদা, রুচি ও পছন্দকে অগ্রাধিকার দিবার এমন তৎপরতা। এই গণমুখিতা হইতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট বা ডি-লিট-এর মতো একান্ত ভাবে উচ্চশিক্ষাসম্বন্ধীয় উপাধি জনপ্রিয় গায়ক-বাদকদের মঞ্চে ডাকিয়া সাড়ম্বরে হাতে তুলিয়া দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াটিই ভারতরত্নের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হইলে কোনও জনপ্রিয় কিন্নরকণ্ঠীর জন্য তাহা সুপারিশ করা হয়। তাঁহারাও সি ভি রমন কিংবা সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনের সহিত অভিন্ন পঙ্ক্তিতে বসার অধিকারী হইয়া যান। কিন্তু সত্যই কি এই দুই ধরনের কৃতীর মর্যাদা এক? ইহাতে কি উপাধিটির গুরুত্ব, গাম্ভীর্য ও মর্যাদাই ক্ষুণ্ণ হয় না? সস্তা জনপ্রিয়তার ধারকদের দুনিয়া-কাঁপানো বৈজ্ঞানিক প্রতিভার সহিত একই পুরস্কারে ভূষিত করিলে কি সেই পুরস্কারটিই খেলো হইয়া যায় না? ডারউইন, নিউটন বা আইনস্টাইনের সহিত কি একাসনে বসিতে পারেন পেলে, ব্র্যাডম্যান কিংবা কার্ল লুইস? শেক্সপিয়রের সহিত ডেভিড বেকহ্যাম কিংবা কালিদাসের সহিত সচিন তেণ্ডুলকর? আম জনতার উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন ও উল্লসিত করতালিই কি তবে যাবতীয় গুণগত উৎকর্ষের, সাধনা ও সিদ্ধির কষ্টিপাথর হইবে? |