চিকিৎসকের শপথ লইবার সময়ে নব্য-দীক্ষিতদের বলিতে হয়, ‘ব্যধির যন্ত্রণা অপেক্ষা চিকিৎসার যন্ত্রণা যেন অধিক না করিয়া তুলি।’ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা যে খাদ্য নিরাপত্তা নীতি পাশ করিয়াছে, তাহাতে মনে হয় নেতাদেরও এই শপথটি করা প্রয়োজন। দরিদ্রের জন্য যথেষ্ট এবং যথাযথ খাদ্যের ব্যবস্থা করিতে হইবে, সন্দেহ নাই। কিন্তু বিপুল পরিমাণ চাল-গমে বিপুল ভর্তুকি দিবার সিদ্ধান্ত দরিদ্র মানুষের সমস্যার নিরসন না করিয়া বরং দেশকে দরিদ্র করিয়া তুলিবে। গত ছয় দশকে ইহা প্রমাণিত যে রেশন ব্যবস্থার দ্বারা পুষ্টিবিধানের প্রচেষ্টা ফুটাপাত্রে জল ঢালিয়া তৃষ্ণা নিবারণের সমান। এক দিকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সরবরাহ করিতে বিপুল খরচ হয়। অপর দিকে, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থার কারণে দরিদ্রের নিকট যাহা পৌঁছায় তাহার মান খারাপ, পরিমাণও সামান্য। রেশন ব্যবস্থাকে কেবলমাত্র দরিদ্রের জন্য সীমিত করিবার পরেও পরিস্থিতির উন্নতি হয় নাই। শিশু-অপুষ্টির যে ভয়াবহ চিত্র নানা রাজ্য হইতে নিয়মিত পাওয়া যাইতেছে, তাহাতে স্পষ্ট যে খাদ্যশস্যে বিপুল ভর্তুকি বাবদ, এবং খাদ্য দফতরের কর্মীদের জন্য বেতন-পেনশন বাবদ সরকার যাহা খরচ করিয়াছে, তাহার একটি বড় অংশই নষ্ট হইয়াছে।
ইহাতে স্বাভাবিক ভাবেই প্রত্যাশা জাগে যে, সরকার হয় খাদ্যবণ্টন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনিবে, অথবা সরকারি খাদ্যবণ্টন ব্যতীত পুষ্টিবিধানের অপর উপায়গুলি অনুসন্ধান করিবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সরকারি ব্যবস্থার ছিদ্র না বুজাইয়া আরও বড় ছাঁকনি তৈরি করিয়া সাগরপার করিবার প্রস্তাব দিয়াছেন। রেশন দোকানে আরও চাল-গম-শস্য আরও শস্তায় সরবরাহ করাই তাঁহাদের মতে পুষ্টিবিধানের সেরা উপায়। ইহাতে কাহার লাভ? অর্থনীতির দৃষ্টিতে লাভ নাই, কারণ সরকারি ক্রয় আরও বাড়িবার ফলে শস্যের দাম আরও বাড়িবে, অর্থভাণ্ডার সঙ্কুচিত হইবে। প্রশাসনের দৃষ্টিতে ইহাতে ঝুঁকি বাড়িবে, কারণ শস্যের সরকারি মূল্য কম এবং বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় দুর্নীতি রোধ করা আরও কঠিন হইবে। শহর এলাকায় রেশন ব্যবস্থাকে সঞ্জীবিত করিতেও বিস্তর কাঠখড় পোড়াইতে হইবে। লাভ কেবল রাজনীতির দুই টাকায় চাল, তিন টাকায় গম দিবার প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক প্রচারের সুবিদিত অস্ত্র। জনমোহিনী ঘোষণার অন্তরালে রহিয়া যায় গুদামে খাদ্যশস্যের স্তূপ, যাহা পচিয়া নষ্ট হয়।
জনগণের টাকায় লঙ্গরখানা চালাইবার কাজ সরকারের উপযুক্ত কাজ নহে। ক্ষুধা দূর করিবার নীতি বলিতে কেবল স্বল্পমূল্যে অথবা বিনামূল্যে খাদ্যশস্য সরবরাহ নীতি বুঝিব কেন? দরিদ্র মানুষ যাহাতে বাজার হইতে প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনিবার ক্ষমতা অর্জন করে, তাহা নিশ্চিত করাই সরকারি নীতির লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন। তাহার জন্য দরিদ্র পরিবারগুলির স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি সরকারকে মিটাইতে হইবে। স্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণ হইবার পূর্বেই পড়াশোনা ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইবার জন্য একটি পরিবারের বহু প্রজন্মকে সামান্য আয়ে বাঁচিতে বাধ্য করে। পিতা-পুত্র-পৌত্রক্রমে মানুষ দারিদ্রকবলিত হইয়া রহিয়া যায়। এই সকল পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা সম্পূর্ণ করিবার উপায় করিলে দারিদ্রের সেই শিকল ভাঙিবে। দরিদ্র পরিবারগুলিকে বংশানুক্রমে ভর্তুকির অন্নের উপর নির্ভরশীল না করিয়া উপার্জনক্ষম করাই কি শ্রেয় নহে? ম্যালেরিয়া-ডায়ারিয়া দূর করিয়া সুস্থ জীবন দিলে দরিদ্র পরিবারগুলির আয় কি বাড়িবে না? একদিকে শিল্প-বাণিজ্যের বিকাশের দ্বারা অর্থনীতির বৃদ্ধি, অপরদিকে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের উন্নতির দ্বারা দারিদ্র নিরসন, পুষ্টিবিধানের এবং ক্ষুধা-বিতাড়নের এগুলিই যথাযথ উপায়। আরও শস্তায় আরও খাদ্য দিলে কিছু দরিদ্র মানুষের কিছু উপকার হইতে পারে, কিন্তু ক্ষুধা-অপুষ্টি-দারিদ্র ঘুচিবে না। |