সম্পত্তি লুঠপাটের ঘটনায় ‘প্রত্যক্ষদর্শী’ হিসেবে কারও বয়ান আদালতে পেশ করেছে পুলিশ। অথচ ‘সাক্ষী’ জানেনই না এমন ‘স্বীকারোক্তি’ নেওয়া হয়েছিল!
কোথাও একই ব্যক্তিকে একই দিনে প্রায় একই সময়ে ‘অভিযুক্ত’ দেখানো হয়েছে ভিন্ন এলাকার একাধিক সংঘর্ষের ঘটনায়!
জমি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরের বেশ কিছু মামলার কাগজপত্র খতিয়ে দেখতে গিয়ে এমনই ‘অসঙ্গতি’ নজরে এসেছে রাজ্যের আইন ও বিচার দফতরের অফিসারদের। জানা গিয়েছে, এই বিষয়গুলোই সামনে রেখেই সরকার ওই সব মামলা প্রত্যাহারের আর্জি জানাবে আদালতে। রাজ্যের আইন ও বিচারমন্ত্রী মলয় ঘটক বলেছেন, “সরকার কেবল মামলা প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করতে পারে। সংবিধানে এই ক্ষমতা রয়েছে সরকারি আইনজীবীদের। তাই তাঁদেরই আদালতে দাঁড়িয়ে ওই আর্জি জানাতে হবে। একই সঙ্গে কেন ওই আর্জি, তা-ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে হবে। সেই প্রস্তুতিই চলছে।” ক্ষমতায় আসার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলন সংক্রান্ত মামলা প্রত্যাহার করবে সরকার। তাঁর নির্দেশে একটি ‘রিভিউ কমিটি’ তৈরি হয়। আইন দফতর সূত্রের খবর, দুটি থানা মিলিয়ে প্রায় ৫০০ মামলা রয়েছে। রিভিউ কমিটি প্রথম দফায় নন্দীগ্রামের ২৪টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। আরও ৪৮টি মামলার খুঁটিনাটি দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে সিঙ্গুরেরও ১৭টি মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
মহাকরণ সূত্রে জানা গিয়েছে, মামলাগুলির বিষয়বস্তু ও আইনি পরিস্থিতি বুঝতে পূর্ব মেদিনীপুর ও হুগলির সরকারি আইনজীবীদের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করেন আইন দফতরের অফিসারেরা। সেই প্রক্রিয়াতেই বেশ কিছু অসঙ্গতি সামনে এসেছে।
সম্প্রতি নন্দীগ্রামে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির লোকজন জড়িত এমন কিছু মামলা খতিয়ে দেখার সময় আইন দফতরের অফিসারেরা কয়েক জন বাসিন্দাকে ডাকেন। পুলিশের খাতায় তাঁরা বাড়ি লুঠপাট, সংঘর্ষের ঘটনায় ‘প্রত্যক্ষদর্শী’। মহাকরণ সূত্রের খবর, পুলিশের নেওয়া ‘জবানবন্দি’ তাঁদের দেখানো হলে সেগুলো তাঁরা অস্বীকার করেন। তাঁদের বক্তব্য, পুলিশ কখনও তাঁদের ডাকেনি। এমন জবানবন্দিও তাঁরা দেননি।
অশান্ত নন্দীগ্রামে বিবদমান সিপিএম ও তৃণমূলের অভিযোগের ভিত্তিতে নন্দীগ্রাম ও খেজুরি থানায় প্রতিদিন গড়ে ১০-১২টি মামলা হত। তার অধিকাংশই মারামারি, ঘর পোড়ানো বা জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ। কিন্তু সেগুলির তদন্ত করতে সারা জেলা খুঁজেও পর্যাপ্ত অফিসার জোগাড় করা যায়নি। ফলে তখনকার মতো ‘তদন্ত’ শেষ করতে অন্য জেলা থেকে অফিসার নিয়ে আসে পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ। আর তাতেই ‘জোড়াতালি’ দিয়ে তদন্ত শেষ করার অভিযোগ উঠছে।
রাজ্য প্রশাসনের একাংশের মতে, ওই সময় নন্দীগ্রাম ও খেজুরির সব গ্রামে পুলিশ পৌঁছতে পারত না। গাছ ফেলে বা রাস্তা কেটে অবরোধ করা হত। তাই ‘কাগজে-কলমে’ মামলা শেষ করার দিকেই পুলিশের বেশি নজর ছিল। পুলিশি নথি বলছে, বহু মামলায় ৬০ জনেরও বেশি লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। অভিযোগ, দ্রুত ‘তদন্ত’ শেষ করতে পুলিশ তাঁদের সকলকে ‘পলাতক’ দেখিয়ে চার্জশিট পেশ করে। পুলিশি নথিতে এ-ও দেখা দিয়েছে, যে ব্যক্তি ভাঙাবেড়িয়ায় সংঘর্ষের ঘটনায় অভিযুক্ত, সে দিনই তিনি অভিযুক্ত মহেশপুরে অপহরণের মামলায়। আইন দফতরের অফিসারেরা এই অসঙ্গতিগুলি খতিয়ে দেখছেন। |