|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
এই নীল, সমুদ্র |
আর এই দাগগুলো দেশ। আর এই সব ছবি। আর ছবি দেখতে
আসা
নানা দেশের মানুষজন। কত কাল থেকে বছরে এক বার এই মহাতীর্থে।
এক আশ্চর্য-ভ্রমণের গল্প লিখছেন শিলাদিত্য সেন |
স্কুটারটা স্পিড কমিয়ে মুহূর্তের জন্য পাশে এসে দাঁড়াল। চালক ভদ্রলোক প্রায় আমার কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিসিয়ে ‘ওই ফুটপাথটা আপনাদের হাঁটার জন্যে’ বলেই সাঁ করে স্পিড বাড়িয়ে উধাও হয়ে গেলেন। খেয়ালই করিনি, হাঁটার তোড়ে কখন ফুটপাথ থেকে রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছি।
পানাজি, গোয়া। আড়াইটের শো-টা ধরতেই হবে, আইনক্স থ্রি-তে, একশো মিনিটের সাদাকালো ফরাসি ছবি দি আর্টিস্ট। ফিল্ম উইদিন ফিল্ম, হলিউডের নির্বাক যুগের এক নায়ককে নিয়ে, Jean Dujardin সে চরিত্রে সেরা অভিনেতার শিরোপা পেয়েছেন এ বারের কান ফেস্টিভ্যালে। এত সব মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কি খেয়াল থাকে কোনটা ফুটপাথ, কোনটা রাস্তা! আর গুলিয়ে যাবে না-ই বা কেন, দু’টোতেই তো হেঁটে সমান সুখ। কালো মসৃণ রাস্তার মতোই অনেকটা চওড়া ফুটপাথ, তাতে অফিসকাছারি-দোকানপাট-বাড়িঘরদোরের স্থাপত্য, অনতিদীর্ঘ, আকাশ ছোঁয় না।
আকাশের অমন নিষ্কলুষ ম্যাপ মাথার উপর থাকলে হাঁটতে হাঁটতে আপনার মনে হতেই পারে: চিত হয়ে নীল আকাশ দেখছেন, তাজা একটা হাওয়ায় দুলছে গনগনে রোদ, সিনেমার উৎসব, থুড়ি পিকনিকে কোথাও এতটুকু দুঃখ বা ভিজে ভাব নেই। পানাজিতে এখন ফি-বছর ভারত সরকারের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ইফি (ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়া), নভেম্বর ২২/২৩ থেকে ডিসেম্বর ২/৩। এ বার নিয়ে বছর আষ্টেক টানা গোয়ায় হলেও তার আগে গোটা দেশ ঘুরে বেড়াত উৎসবটা, এ বছর দিল্লি তো অন্য বছর দেশেরই অন্য কোনও শহর। |
|
‘মাই অস্ট্রেলিয়া’ |
কত বার
দিল্লি গিয়েছি, মুম্বই তিরুবনন্তপুরম হায়দরাবাদে উজিয়েগিয়েছি, সিনেমা দেখতে। এ বার নিয়ে ষোলো বছর হল ইফি-তে এলাম।
শুধু কি সিনেমা দেখতে আসি, সিনেমার ভিতর দিয়ে আসলে দেশ বেড়াতে আসি। বিদেশে, আমার দেশের বাইরে তো বেড়াইনি কখনও, সিনেমার উৎসবে এসে সারা দুনিয়ার নানান দেশের মানচিত্র আর মানুষজনকে ছুঁয়ে ফেলি ছবির ভিতর দিয়ে। আজ যেমন হনহনিয়ে হাঁটছি আড়াইটের শো-এ মার্কিন মুলুকে পাড়ি জমাব বলে। বিশ-তিরিশ দশকের সন্ধিক্ষণে হলিউডের নির্বাক যুগের নস্টালজিয়ায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন Michel Hazanavicius দি আর্টিস্ট-এর ফরাসি চলচ্চিত্রকার।
দশ মিনিটের মধ্যে দু-তিনটে ছোট রাস্তা আর অলিগলির বাঁক পেরিয়ে যেই বড় রাস্তায় এসে উঠলাম, আকাশটা যেন নদীতে মিশে গেল। রাজপথের উল্টো ফুটপাথে সিমেন্টের রেলিংয়ের পাশে-পাশে বহমান মাণ্ডবী। শান্ত নিস্তরঙ্গ সে-নদীর মাঝখানে মধ্যদুপুরে জিরিয়ে নিচ্ছে একটা বড় স্টিমার। অপরাজিত মনে পড়ে গেল। অপুও এমন মধ্যদুপুরে কলেজ পালিয়ে বন্ধুর সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে বসে স্টিমার দেখত, ভোঁ শুনত স্টিমারের। বন্ধুটি শুধিয়েছিল ‘বিলেত যাবি না?’ অপু বলেছিল, ‘তুই একটা জাহাজের চাকরি জোগাড় করে দে।’ হয়তো কোনও অজানা দেশের উপকূল, হয়তো কোনও দূর অনিশ্চিত শহরে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখত অপু...
|
২ |
সত্যজিতের প্রতিদ্বন্দ্বী-র ইংরেজি নামটা মনে করতে পারছিলেন না সুইডিশ ভদ্রমহিলা, নাম মারিয়া। টিকিট সংগ্রহের লম্বা লাইনে ঠিক আমার আগে দাঁড়িয়ে দোনোমোনো করছিলেন ইন্ডিয়ান প্যানোরামা-য় কোন ছবিটা দেখবেন। ইফি-তে কিন্তু টিকিট কাটতে হয়, অবশ্যই অর্থ নয়, কার্ডের বিনিময়ে, প্রেস-এর লোকজনের জন্যে বরাদ্দ পাঁচটা ছবি, ডেলিগেটদের জন্যে তিন। মারিয়া পিছন ফিরে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন ছবিটা দেখব?’ ব্যস্, আলাপ পৌঁছে গেল সত্যজিৎ-এ,সত্তর দশকের শুরুতে সুইডেন গিয়েছিলেন সত্যজিৎ, প্রতিদ্বন্দ্বী দেখার পাশাপাশি তাঁর কাছে তখন সিনেমার ক্লাসও করেছেন মারিয়া-রা। চল্লিশ বছর আগের তারুণ্যের দিনগুলিতে ফিরতে ফিরতে আলো হয়ে উঠছিল মারিয়ার মুখ, গলায় সত্যজিৎ-মুগ্ধতা: ‘কী চমৎকার চেহারা, কী অপূর্ব কণ্ঠস্বর!’
ভিন্দেশি মানুষজনের সঙ্গে এ ভাবে কথাবার্তা বলতে বলতেই যেন এক আশ্চর্য-ভ্রমণে পা বাড়াই। তাতে আমি একা নই, আমার ভ্রমণসঙ্গীরা আসেন সারা ভারতের নানা প্রান্ত থেকে, কেরল-কর্নাটক-ওড়িশা-অসম-মহারাষ্ট্র থেকেই ফিল্ম-পাগল লোকজন আসেন সবচেয়ে বেশি। পানাজি-র ওল্ড জি এম সি বিল্ডিং, ম্যাকিনেজ প্যালেস, আর আইনক্স মাল্টিপ্লেক্স মিলিয়ে একটা টানা লম্বা বিশাল চত্বর সকাল থেকে আমাদের ছোটাছুটিতে জেগে ওঠে। মধ্যাহ্নভোজনের পর ব্যস্ততা কমিয়ে একটু ঝিমোয়, বিকেলের পর সন্ধের মুখে কফির কাপ কিংবা বিয়ারের গ্লাস হাতে সেজেগুজে ফের রঙিন, ঝলমলে। ওখানে আমাদের দৈনন্দিন, রোজকার পরিশ্রম প্রায় ভিন্দেশে ভ্রমণই হয়ে ওঠে। সাংবাদিক বৈঠক থেকে সিনেমা অবধি আমাদের ভারতীয়দের দলটা তখন নতুন মানুষ নতুন দেশ আবিষ্কারের আনন্দে মাতোয়ারা। একদা পর্তুগিজদের গোয়া আবার ক’টা দিনের জন্য যেন বিদেশের বন্দর!
|
৩ |
হলুদ হয়ে আসা বিকেলে এলোমেলো হাওয়ায় গাছপালার শুকনো হলুদ পাতাপুতি উড়ে আসত আইনক্স চত্বরটায়। তেমনই এক অপরাহ্ণে স্তব্ধ হয়ে দেখলাম পোল্যান্ড-ইজরায়েলের যৌথ ছবি মাই অস্ট্রেলিয়া, Ami Drozd নিজের ছেলেবেলার অকিঞ্চিৎকর ভাঙা টুকরো স্মৃতি পর পর জুড়ে করেছেন ছবিটা। শেষ হওয়ার পর আইনক্স-এর বাইরে এসে দাঁড়াতেই, সান্ত্বনা বরদোলৈ’র সঙ্গে চোখাচোখি, বলতে থাকেন ‘আমার তো কিস্লোস্কি-র ক্যামেরা বাফ মনে পড়ে যাচ্ছিল, সেই নিজেকে নিয়ে ছবি করা...।’
সান্ত্বনা অসমের শিশুচিকিৎসক, কিন্তু ’৯৬-’৯৭-তে বিধবাদের যন্ত্রণাময় জীবন নিয়ে একটি ছবি বানিয়ে রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। জাতীয় পুরস্কার তো পেয়েইছিল তাঁর ‘অদাহ্য’, দিল্লিতে ’৯৮-এর ইফি-তেও প্রতিযোগিতায় রুপোর ময়ূর পেয়েছিল। শুধোই, ‘আর ছবি করতে ইচ্ছে করে না?’ পড়ন্ত বেলার শেষ আলোটুকু মুছে নেয় তাঁর চুলের রুপোলি রেখা, ‘এমন ছবি দেখলে তো ইচ্ছে করেই।’ উত্তরের সঙ্গে একটু যেন অন্যমনস্কও সান্ত্বনা: ‘আচ্ছা কত কাল, বলুন তো কত কাল হল আমরা ইফি-তে আসছি?’ আমারও তখন মনে হতে থাকে, আরে তাই তো, কত কাল ধরে ইফি-তে আসছি!
|
৪ |
স্পিলবার্গ-এর ‘টিনটিন’ নিয়ে কলকাতায় এত হইচই, অথচ ইফি-তে এ বার একটা স্প্যানিশ অ্যানিমেশন ছবি দেখে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারিনি। ছবিটা ছিল ‘স্কেচেস অন স্ক্রিন’ বিভাগে। সঙ্গে ‘থ্রিডি সিনেমা’, ‘ইউরোপিয়ান ডিসকভারিজ’, ‘ফেস্টিভ্যালস ক্যালাইডোস্কাপ’, ‘আ কাট অ্যাবাভ’, ‘সিনেমা অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নানান বিভাগ, তাতে নানা ধরনের ছবি।
স্পেনের Fernando Trueba, Tono Errando, Javier Mariscal তিন পরিচালক মিলে বানিয়েছেন অমন জীবন্ত একটা অ্যানিমেশন ছবি চিকো অ্যান্ড রিতা। কিউবার এক পিয়ানোবাদক চিকো আর এক গায়িকা রিতা-র বেদনাবিধুর রোম্যান্স, ‘মিউজিক্যাল জার্নি’, আমাদের হাভানা থেকে টেনে নিয়ে যায় নিউইয়র্ক প্যারিস হলিউড লাস ভেগাস-এ। শুধু রং আর রেখায় কতটা বেড়ানো
হয়ে যায়!
গোয়া থেকে যে ট্রেনটায় ফিরছিলাম সেটা কর্নাটক-অন্ধ্র-ওড়িশা হয়ে হাওড়ায় ঢোকে। শুক্লপক্ষের রাত, গতিময় ঘুমন্ত ট্রেনে হয়তো আমিই একা জেগে। কাচের জানলার পাশে বসে আবছা দিগন্ত পাহাড় বন নদী পেরোতে থাকি, পেরোতে থাকি আধঘুমন্ত অপরিচিত স্টেশন। আবার আমার অপরাজিত মনে পড়ে যায়... গ্লোব হাতে অপু সর্বজয়াকে বোঝাচ্ছে... এই দাগগুলো দেশ, আর এই নীল সমুদ্র। রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া সেই রহস্যময় যাত্রায় হঠাৎ মনে হতে থাকে ইস্ ট্রেনটা যদি কলকাতায় না ফিরে আমায় অন্য কোথাও নিয়ে যেত! |
|
|
|
|
|