হাওয়াইচটি উইকেট, নরম আলোয় ফেদার টাচ

টুনিদির নতুন র‌্যাকেট
(সাদা ফ্রক, রঙিন রুমাল)
প্রজাপতি শাটল কক-এ
আমি স্লিপ, গলির ক্রিকেট!


পদ্যটা এই পর্যন্ত পড়তেই পাড়ার রকে প্রবল আন্দোলন ছ্যা ছ্যা, হ্যা হ্যা, মার ব্যাটাকে! ব্যাটা রান করতে পারে না, ব্যাট ঘাড়ে ছন্দ মেলাতে পারে না তা-ও পদ্য ঝাড়ে! যত বলি যে প্রথম লাইনের র্যাকেটের সঙ্গে দ্বিতীয় লাইনের ফার্স্ট ব্র্যাকেট-এর একটা সূক্ষ্ম আঁতাঁত আছে, তা কে শোনে কার কথা। টিঙ্কু বলল, নিজে একটা কার্টুন, আর টুনিদিকে নিয়ে ছড়া কাটছে, সাহস দেখেছ! আমি বলতে যাচ্ছিলাম, আমি টুন আর ও টুনি, দোঁহে মিলে ছড়া বাঁধব যেন টুনটুনি, তাতে তোর কী? কিন্তু কিছু বলার আগেই বাবলুর মন্তব্যে সবাই চুপ মেরে গেল তোচনদার কানে গেলে ছাল তুলে নেবে! তোচনদা অখিল বঙ্গ গলি ক্রিকেটের স্বঘোষিত চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন্স। এই সিজন-এ অলরেডি তিনটে কোয়ার্টার সেঞ্চুরি। লোকে বলে বারান্দায় টুনিকে দেখলে তোচনের স্কোয়্যার কাট-এর জোর দ্বিগুণ হয়ে যায়। আর টুনি নাকি ওই নতুন র্যাকেটের তারজালির মধ্যে দিয়ে তোচনকে
চোখে হারায়!
শীত আসছে কলকাতায়! নেহাতই মধ্যবিত্ত আলস্যে ভোরের দিকটায় আড়মোড়া ভেঙে, রোদ উঠলে বেমালুম নিরুদ্দেশে, আর সন্ধে নামলে বাড়ির বখে যাওয়া ছোট ছেলের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে। নিন্দুকেরা বলে কলকাতায় ঠান্ডা পড়ে না, শীতের আগমন বোঝা যায় মূলত দু’টি ঘটনার মাধ্যমে ভরদুপুর থেকে অলিতে-গলিতে ব্যাট-বলের খটখট আর সন্ধেবেলা পাড়ার পরিদের মর্তে নেমে আসা। এই দ্বিতীয় অপার্থিব ঘটনাটির জন্য আমাদের মতো ছেলে-ছোকরারা মুখিয়ে থাকে সারা দিন। পিংকি, মিতু, বুবু-রা সকালবেলায় স্কুল-ড্রেস-স্কার্ট-ব্লাউজ (টুনিদি অবশ্যই শাড়ি), জোড়া বিনুনি, হোলি চাইল্ড কিংবা ব্রাহ্ম বালিকা। বিকেলে টোপাকুল গালে ফেলে অথবা তেঁতুলের আচার চাটতে চাটতে বাড়ির দিকে। আচারওয়ালার ছদ্মবেশ না ধরলে ওদের ধরে কার সাধ্যি। এক বার টিঙ্কু ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল ল্যাম্পপোস্টের পিছনে। দু’চারটে টোপাকুলের বিচি ফুটপাথে বাউন্স করে যেই ওর পায়ের কাছে এসেছে ওমনি ডেকে উঠেছে ‘পিংকি...’। তা সেই পাঁজরভাঙা ডাকের উত্তরে খুকি বলল ‘ইউ আর এ মাংকি!’ অগত্যা ল্যাজ হাতে টিঙ্কুর পাড়ার রকে প্রত্যাগমন এবং প্রতাপকে বুকে জড়িয়ে ‘তোমার এই প্রসারিত বক্ষে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সন্ধেবেলা নরেনের রক্তাক্ত আলুর দমের হরির লুঠ দিয়ে শান্তি-স্বস্ত্যয়ন।
তোচনদার স্কোয়্যার কাট সাতগলির মোড়ের বাড়িটায় ঠোক্কর খেয়ে ভেতরে ঢুকে যেতেই ও পাড়ার জনতা হই হই করে উঠল। আমরা আবার হারলাম। টুনিদির বারান্দায় তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই। শুধু পর্দাটা ফাঁক হয়ে আছে। একটু পরেই সন্ধে নামবে। এখন রোদ্দুর ঠিক এক চিলতে। গার্লস স্কুলের পাশ দিয়ে গলিটা যেখানে হঠাৎ বাঁক নিয়ে একটু চওড়া হয়ে গেছে, ঠিক সেইখানে একটা ল্যাম্পপোস্টের নীচে রোদ্দুরটা আটকে আছে। উল্টো দিকের বাড়ির বারান্দায় ঝুলছে একটা কাঠের বোর্ড। তাতে খানচারেক পেল্লায় বাল্ব-হোল্ডার লাগানো। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এই জায়গাটা, এই নিতান্ত মধ্যবিত্ত, চুন-খসা, শ্যাওলা-ঢাকা দেওয়াল-পাঁচিলের মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে স্বর্গের বাগানের চাদর জড়িয়ে নেবে গায়ে! আর পিংকি, মিতু, বাবু (আর অবশ্যই টুনিদি) পরি হয়ে নেমে আসবে হাতে র্যাকেট আর ফেদার কক নিয়ে। আর আমরা? ভ্যাবলা-ক্যাবলা-হাবলু-টাবলু সম্প্রদায় বুকে পাথর নিয়ে কখনও বারান্দায়, কখনও পরবর্তী ল্যাম্পপোস্টের আড়ালে, অথবা মোড়ের দোকানে কাকার সিগারেট কিনতে যাওয়ার নাম করে সাড়ে চুয়াত্তরের ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো হেঁটে যাব ঘাড়টাকে মোক্ষম সময়ে নব্বই ডিগ্রি ঘুরিয়ে। এতে রিস্ক আছে বইকি। হাঁটছ সামনে, ঘাড় ডাইনে, খোলা ম্যানহোল, তুমি হরিবোল! ঠ্যাং ভেঙে বাবলু মাসখানেক বিছানায়। সান্ধ্য আড্ডা সেরে বাড়ি ফেরার পথে আমরা ওর জানলায় দাঁড়িয়ে আঁখো দেখা হাল শুনিয়ে যাই, অবশ্যই আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। বাবলুর এই অধঃপতনে আমাদের চাতক পক্ষী সমাজের সামগ্রিক কোনও ক্ষতি হয়নি, যা হল টাবলুর দুর্ঘটনায়।
প্রতি সন্ধ্যায় সাড়ে ছ’টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে টুনিদি নেমে আসে ব্যাডমিন্টন কোর্ট-এ। সাদা ফ্রক, রঙিন রুমাল। টুনিদি কোর্ট-এ নামলে ডুমগুলোর(মানে বাল্ব) ঔজ্জ্বল্য বেড়ে যায়। বাকি পরিদের ডানায়ও যেন আগুন লাগে। কেউ শর্মিলা ঠাকুর, কেউ কাবেরী বোস! আর আমাদের পাঁচ-ছ’জোড়া চোখ বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজিক পজিশন-এ, মন-ক্যামেরায় অ্যাকশন শুরু করে দেয় রাতের প্লে-ব্যাকের জন্য চাহিদা। হঠাৎক্রিং...। গলির মোড়ে সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি শুনেই টুনিদি বলে উঠল, আর পারছি না। তার পর টুক করে উড়ে গেল দোতলায়। আমার পাশের বারান্দা থেকে চাপা গলায় টাবলু বলল, ‘শালা তোচন! তিনটে কোয়ার্টার মেরেই কী রোয়াব দেখেছিস!’ এ এক ঘোরতর অপমান। আমার পাড়ার পরি বেপাড়ার পদ্মলোচন উড়িয়ে নিয়ে যাবে? পরের দিন সন্ধ্যায় হাইস্পিড-এ সাইকেল চালিয়ে টাবলুর কোর্ট-এ প্রবেশ। ঘাড় নিচু করে শরীর বেঁকিয়ে জাল কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার মাচো কেতা দেখাতে গিয়ে পতন ও মূর্ছা! ফলস্বরূপ স্বর্গের ব্যাডমিন্টন কোর্ট অন্ধকার। নেড়িদের প্রত্যাবর্তন আর সাইকেল দেখলেই উদ্দাম সংকীর্তন। আমরা বাক্যহারা। শুধু একটাই উপলব্ধি টাবলুর মতো আমরা প্রত্যেকে এক একটি অভিমন্যু। কোর্ট-এ ঢুকে পড়েছি, কিন্তু জাল কেটে বেরনোর রাস্তা জানা নেই।
যখন সবাই ধরে নিয়েছি যে এই সিজন-এ আমাদের সুখস্বপ্ন মানে শুধুই হেমা মালিনী, তখনই জিতু এসে খবর দিল বাবাইদের ছাদে খেলা হচ্ছে। বোঝো! বাবাইদের ছাদ এ পাড়ায় সবচেয়ে উঁচু। জিতুদের বাড়ির লাগোয়া। অন্য কোনও ছাদ থেকে দেখার তো কোনও উপায়ই নেই। তার ওপর কলকল, খলখল হাসির আওয়াজ আরও দুঃসহ। জিতু নেহাত নাবালক। আট আনার লোভে শীতের রাতে উদ্বাহু হয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে রাজি হয়ে গেল। ফেদার নিচে পড়লেই নিয়ে চম্পট দিতে হবে। কিন্তু বিধাতা কোনও কালেই প্রেমিকদের প্রতি সদয় নন! ঠিক যখন ফেদারটি পড়ছে, ছাদের দরজা ঠেলে জিতুর বাবার প্রবেশ। ওপরে ফেদার, নিচে ফাদার। জিতুর কান তিন দিন টাটিয়ে রইল। বেঁচে যাওয়া আট আনা দিয়ে আমরা ন্যাড়া ক্যাম্বিস বল কিনলাম।
কাজের ব্যাপারে বাঙালির যে অনীহা (ইদানীং একটু কমেছে শোনা যাচ্ছে), প্রেমের ক্ষেত্রে সেটা অনেকটাই পুষিয়ে দেওয়া গেছে। যে বাঙালি এভারেস্ট-এর সন্ধি বিচ্ছেদ করে ‘এভার রেস্ট’, সে-ই প্রেমের জন্য বাহাত্তর ঘণ্টা অবিরাম সাইকেল চালায় (পাড়ার হাবলুদা), গরুর গাড়িতে বিশ্বভ্রমণের প্ল্যান ভাঁজে (ভ্যাবলা) আর স্কুলের ছুটি পড়লেই সকাল থেকে সাতগলির মোড়ে ক্যাম্বিস বলে নকিং শুরু করে (এই অধম)। কিন্তু হায়! মধ্যবিত্ত ভেতো বাঙালি সমাজে কাঙাল প্রেমিকের সংখ্যা যে তেত্রিশ কোটি! এ দিকে টিমে চান্স পাবে বড়জোর সাত থেকে আট জন (সেভেন এ সাইড)। হাবুদাকে টিমে নেওয়ার জন্য হাতে পায়ে ধরলাম। উড়িয়ে দিল ‘তুমি বাপু স্ট্রোকলেস ওয়ান্ডার, তোমাকে কী করে নিয়ে যাব ডাউন আন্ডার?’ তার ওপর তোচনদার টিমের সঙ্গে ফিরতি ম্যাচ। ইজ্জত কি সওয়াল। অগত্যা রকে বসে একস্ট্রা প্লেয়ার সাজা। তবে বাঙালির ভাগ্যেও শিকে ছেঁড়ে।
প্রতাপ খোঁড়াতে খোঁড়াতে মোড়ের দোকানে বরফ লাগাতে যেতেই হাবুদা ফিল্ডিং খাটতে বলল। প্রথমে আত্মসম্মানে লাগলেও বুঝলাম এই সুযোগ। ব্যাট হাতে তোচন, কভার অঞ্চলে বারান্দায় টুনিদি, আর পয়েন্টে আমি। টুনিদিকে শীর্ষবিন্দু ধরলে একটি চমৎকার ত্রিভুজ! তোচন যে দূরত্বে, আমিও প্রায় সে দূরত্বে আর টুনিদি জেড অ্যাক্সিস বরাবর। পরিদের যা অবস্থান! কী ব্যঞ্জনা! ক্যাচও উঠল, একটু বেশিই উঠল। আমিও দু’হাত তুলে ‘লিভ ইট’ বলে ডাক ছেড়েছি। মহাভারত স্মরণ করি। চোখে অর্জুন মার্কা ফোকাস। কয়েক সেকেন্ড পরেই তোচনদা এন্ড! আর ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল। গলি থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি টার্ন নিয়েই সোজা আমার দিকে। প্রবল হর্ন এবং ব্রেকের আর্তনাদ। আমি ক্যাচ ও ম্যাচ এবং মান ও জানের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে খানিকটা অবচেতনেই লাফিয়ে এক পাশে। ট্যাক্সি বেরিয়ে গেল। বল নেমে এল মাটিতে। তার পরের পনেরো মিনিট গ্রেট তোচনের ব্যাট হাতে নটরাজ নাচন। শেষ ছয়টা পড়ল টুনিদির বারান্দায় এবং যবনিকা পতন।
সে দিন অনেক দেরি করে এ পাড়া ও পাড়া পালিয়ে সাতগলিতে ঢুকেছি এক প্রকার লুকিয়ে। অবাক হয়ে দেখি ল্যাম্পপোস্টের পাশে ব্যাডমিন্টন কোর্ট-এ আবার আলো জ্বলছে। মাথা নিচু করে (এবং চোখ প্রায় বন্ধ রেখে) দ্রুত পায়ে জায়গাটা পেরিয়ে যাব, হঠাৎ, ‘ভাই একটু খেলবে?’ থমকে দাঁড়িয়ে দেখি টুনিদি একা! হাতে দু’টো র্যাকেট। বলল, ‘নতুন র্যাকেটটা একটু দেখে নিতাম।’ আমি থ! আমার হাতে রাতপরির র্যাকেট? তার আঙুলের ছাপে আমার আঙুল! টুনিদি ভ্রু কুঁচকে (আরও সুন্দর দেখায়) জিগ্যেস করল ‘ক্যাচটা কী করে ফেললে?’ আমি মুখ নিচু করলাম এবং মনে মনে বললাম ক্যাচটা ধরলে তোমার কষ্ট হত, টুনিদি। আর বলামাত্র একটা গল্পের গরু এক লাফে ল্যাম্পপোস্ট-এর মাথায় চড়ে বসল আর হাম্বা রবে সারা পাড়াকে জানিয়ে দিল লাভ অল!

ছবি: সুমন চৌধুরী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.